দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মাওঃ এইচ এম গোলাম কিবরিয়া (রাকিব)
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
যাতে করে তারা দেশ ছেড়ে পালায় অথবা বৌদ্ধদের দমন-পীড়নে নিঃশেষ হয়ে যায়। রোহিঙ্গাদেরকে সাধারণত স্থানীয়ভাবে ‘কালারস’ নামে অভিহিত করা হয়। তাদের সাথে বৌদ্ধদের আচরণ প্রসঙ্গে মিয়ানমারের ‘দ্য ভয়েস’ নামক সাময়িকী একজন পাঠকের মতামত উদ্ধৃত করেছে, “আমাদের উচিত, কালারস হত্যা করা অথবা ধ্বংস করা। তা না হলে এ দেশ থেকে বৌদ্ধ ধর্মের অস্তিত্ব মুছে যাবে।”
এতে সহজেই বোঝা যায়, মিয়ানমারের বৌদ্ধরা মুসলিম ও ইসলাম সম্পর্কে কতটা ভয়ঙ্কর বিশ^াস পোষণ করে। আর সেই সূত্র ধরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে মুসলিমনিধনে মেতে উঠেছে তারা।” এভাবেই বার্মা স্বাধীন হবার পরেও সেখানে মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তারা পরিকল্পিত গণহত্যা ও নৃশংসতা চালাতে থাকে। এমনি করে মুসলিম রোহিঙ্গাদেরকে সমূলে উৎখাত করার জন্য সেখানে একের পর এক বহু অভিযান পরিচালনা করা হয়, যেমন-
৫ম বর্মী রেজিমেন্ট-এর সামরিক অভিযান- নভেম্বর ১৯৪৮ইং।
বার্মা টেরিটেরিয়াল ফোর্স (ইঞঋ)-এর অভিযান-১৯৪৮ থেকে ১৯৫০ইং।
দ্বিতীয় জরুরি ছিন রেজিমেন্ট-এর সামরিক অভিযান-নভেম্বর ১৯৪৮ইং।
মাউ অভিযান-অক্টোবর ১৯৫২ থেকে ১৯৫৩ইং।
মনে-থোন অভিযান-অক্টোবর ১৯৫৪ইং।
সমন্বিত অভিবাসন ও সামরিক যৌথ অভিযান-জানুয়ারি ১৯৫৫ইং।
ইউনিয়ন মিলিটারি পুলিশ (টগচ)-অভিযান-১৯৫৫ থেকে ১৯৫৮ইং।
ক্যাপ্টেন হটিন কিয়াও অভিযান-১৯৫৯ইং।
শোয়ে কি অভিযান-অক্টোবর-১৯৬৬ইং।
কি গান অভিযান-ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ইং।
মেজর অং থান অভিযান-১৯৭৩ইং।
সাবি অভিযান-ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ইং।
মেজর অং থান অভিযান-১৯৭৩ইং।
সাবি অভিযান-ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৮ইং।
নাগা মিন (ড্রাগন রাজা) অভিযান-ফেব্রুয়ারি ১৯৭৮ থেকে ১৯৭৯ইং। (এ অভিযানে প্রায় ৩ লক্ষ রোহিঙ্গা বাস্তুহারা হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় এবং ৪০ হাজার রোহিঙ্গা মারা যায়।) সোয়ে হিন্থা অভিযান-আগস্ট ১৯৭৮ থেকে ১৯৮০ইং।
গেলোন অভিযান-১৯৭৯ইং। তাউঙ্গকের গণহত্যা-১৯৮৪ইং। তাউঙ্গি (পশ্চিম বার্মা)-এর মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা। পিয়াই ও রেঙ্গুনসহ বার্মার অনেক অঞ্চলে এই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। পি থিয়া অভিযান-জুলাই ১৯৯১-৯২ (এতে ২ লক্ষ ৬৮ হাজার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। নাসাকা অভিযান-১৯৯২ থেকে অব্যহত।
মুসলিমবিরোধী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-ফেব্রুয়ারি ২০০১ইং।
সিটিওয়ে’তে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা-ফেব্রুয়ারি ২০০১।
মধ্য বার্মার মুসলিমবিরোধী সর্বাত্মক দাঙ্গা- মে ২০০১।
মধ্য বার্মার মুসলিমবিরোধী ভয়ঙ্কর দাঙ্গা (বিশেষত পিয়াই/ প্রোম, বাগো/পেগু শহরে) ৯/১১-এর পরবর্তী থেকে অক্টোবর ২০০১ইং।
সেনা বাহিনী ও বৌদ্ধদের যৌথ মুসলিম নিধনে অভিযান-জুন ২০১২ থেকে অব্যাহত। সাম্প্রতিক (বিশেষ করে ২০১৬ইং) সেনা বাহিনী, সরকারি মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীগোষ্ঠী ও বৌদ্ধভিক্ষুদের সম্মিলিত মুসলিমনির্মূল অভিযান। উল্লেখ্য, ১৯৬২ সালে উ নু সরকারকে উৎখাত করে জেনারেল নে উইনের নেতৃত্বাধীন সামরিক জান্তা মিয়ানমারের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার পর প্রায় তিন দশনক স্বৈরশাসন চালিয়ে বিদায় নিলেও গনতন্ত্রকে ফিরে আসতে দেয়া হয়নি। বরং মানবাধিকার ও আইনের শাসনকে হত্যা করে সামরিক গোষ্ঠী আরো দ্ইু দশক ক্ষমতা আঁকড়ে থাকে। এরপর ২০১১ সালে নির্বাচন হলেও সামরিক গোষ্ঠীই কৌশলে রাষ্ট্রক্ষমতা কব্জ করে রাখে। তখন থেকে মিয়ানমার শাসন করেছে দেশটির সেনাসমর্থিত রাজনৈতিক দল দ্য ইউনিয়ন সলিডরিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি)। অতঃপর ২০১৫ সনের নভেম্বরের নির্বাচনে অং সান সুচি’র দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)বিশাল জয় অর্জন করে। আর এর মধ্যদিয়ে দীর্ঘ ৫০ বছরের সামরিক গোষ্ঠীর শাসনের অবসান হয় এবং শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সুচির হাত ধরে মিয়ানমারে ফিরে আসে গণতন্ত্র। অং সান সুচি এ নতুন গণতান্ত্রিক সরকারে বিশেষ কারণে প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট হতে না পারলেও তিনি এ সরকারের বিশেষ শীর্ষপদধারী হিসেবে রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা নির্বাচিত হয়েছেন। যার মাধমে অং সান সু চি এই সরকারে অনেকটা প্রধানমন্ত্রীর মতোই ভূমিকা পালন করতে পারছেন। অং সান সু চি’র দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসায় মুসলমানদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছিল। কারণ, একে তো তিনি গণতন্ত্রপন্থী হওয়ায় দেশের সকল নাগরিক সমান অধিকার পাওয়ার আশাবাদী হওয়াই স্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত, মিয়ানমারের মুসলিম জনগোষ্ঠী সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে অং সান সু চি’র দলকে জেতাতে অনেক শ্রম দিয়েছেন এবং কষ্ট করেছেন। এ সম্পর্কে টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ ইসলাম বলেন, “আমরা আমাদের অবস্থা সম্পর্কে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, মিয়ানমার সরকার এবং বিশেষ করে অং সান সু চি’র দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সুচি এখনো আমাদের জন্য কোন কিছু করেননি। অথচ ১৯৯০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গারা এমনকি আমার বাবা-মা তার পক্ষে নির্বাচনী অভিযানে অংশ নিয়েছেন।” সে কারণে সকলে আশাবাদী ছিলেন যে, এবার গণতন্ত্র চালু হওয়া মিয়ানমারে শান্তিতে নোবেল পাওয়া অং সান সু চি’র মাধ্যমে মুসলমানরা শান্তি ও নাগরিক অধিকার ফিরে পাবেন। তাদের উপর সাম্প্রদায়িক অপশক্তির চালানো অন্যায় ও জুলুম-নির্যাতনের অবসান হবে। কিন্তু দুঃখজনক যে, অং সান সু চি’র দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পরও, সেই সাথে তিনি এ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর সমতুল্য রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা হওয়ার পরও এবং সর্বপরি সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও মিয়ানমারের মুসলমানদের উপর সাম্প্রদায়িক হত্যাকা- ও জুলুম-নির্যাতন বন্ধ হয়নি, তা নতুন মাত্রা নিয়ে আরো প্রবল বেগে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিভিন্ন দিক দিয়ে তার তা পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
গত ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের রাখাইন সীমান্ত চৌকিতে এক হামলার জের ধরে সেদেশের সরকারি বাহিনী ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের নামে চরমভাবে মুসলিমনিধনে মেতে উঠেছে। রাখাইনের সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর তারা ব্যাপকহারে দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। তারা মুসলমান পুরুষদের নির্বিচারে হত্যা করছে, মহিলা ও কিশোরীদের ধর্ষণ করছে, তাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও ব্যাপক লুটতরাজ চালাচ্ছে তাদের গণহারে হত্যাকা- থেকে বৃদ্ধ ও শিশুরাও নিস্তার পাচ্ছে না। (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।