দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মাওঃ এইচ এম গোলাম কিবরিয়া (রাকিব)
মিয়ানমারে মুসলিম জনসাধারণের উপর একযোগে গণহত্যা ও অবর্ণনীয় নির্যাতন চালাচ্ছে সেদেশের সেনাবাহিনী, সরকারের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীগোষ্ঠী ও মুসলিমবিদ্বেষী উগ্রপন্থী হিংস্র বৌদ্ধরা। “অহিংসা পরম ধর্ম” এবং “জীব হত্যা মহাপাপ” প্রভৃতি বুলি মুখে আওড়িয়ে তারা নিরীহ মুসলমানদের উপর নির্বিচারে ইতিহাসের বর্বরতম জঘন্য হত্যাকা- চালাচ্ছে। বিশেষ করে মিয়ানমারের তারা রাখাইন রাজ্যে মুসলিম জনসাধারণকে তাদের বসতভিটা থেকে চিরতরে উৎখাত করতে চরম নির্যাতন ও ব্যাপক হত্যাকা- চালাচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরেই তারা রাখাইনের রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর অন্যায় অত্যাচার ও নৃশংসতা চালাচ্ছে। রাখাইন রাজ্যের মংডু ও আকিয়াব এলাকায় চালিয়েছে গণহত্যা ও লুটতরাজ। জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। মংডু এলাকার দক্ষিণ, নয়াপড়া, বমুপাড়া, মাঙ্গালাপাড়া, সম্মন্যাপাড়া রচমাইল, হাদির বিল ও ঝুড়ারপাড়া এবং আকিয়াবের নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, মং লেংপাড়া, বাহারছড়া ছাক্কিপাড়া, জালিয়াপাড়া, রোহাইঙ্গা ও ওয়ালিদপাড়া সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। মুসলিমদের মসজিদে, মাদ্রাসায় বা বিভিন্ন বাড়িতে একত্র করে তারা আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। কোন মুসল্লি জীবন বাঁচাতে বেরিয়ে আসলে তাকে কারফিউ ভঙ্গের অজুহাতে গুলি করে হত্যা করেছে।
এদের মূল উদ্দেশ্য, বার্মার ভূখ- থেকে মুসলিম জাতিকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করা। এজন্য তারা সেখানে পরিকল্পিতভাবে মুসলিম নিধন চালাচ্ছে। মুসলিমদের সমূলে ধ্বংস করতেই বার্মার বিতাড়িত মুসলিমরা যখন প্রাণ নিয়ে ট্রলারে করে অন্যত্র আশ্রয় নিতে প্রয়াসী হন, তখন জালেম নাসাকা বাহিনী অনেক মুসলিমকে সাগরে ডুবিয়ে দেয়। আবার অনেক ট্রলারকে কোথাও ভিড়তে বাধা দেয়। যার কারণে খাবার পানির অভাবে মারা যায়। আবার অনেককে নৌকাতেই সরাসরি গুলি করে হত্যা করে।
বস্তুত মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম নিধনে বৌদ্ধদের এই ষড়যন্ত্র কয়েক শতাব্দী ধরে চলা হিংসাত্মক হিং¯্র কা-। তারা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানগণকে ভাগ্যাহত জনগোষ্ঠীতে পরিণত করেছে। অথচ এককালে তাদের ছিল ‘আরকান’ নামীয় স্বাধীন রাষ্ট্র, ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি।
এ উপমহাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সর্বপ্রথম যে কয়টি এলাকায় মুসলিম বসতি গড়ে ওঠে, আরাকান তার মধ্যে অন্যতম। রোহিঙ্গারা সেই আরাকানী মুসলমানের বংশধর। এক সময় আরাকন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
আরাকানে ১৪৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসন দুইশ’ বছরেরও অধিকাল স্থায়ী হয়। ১৬৩১ সাল থেকে ১৬৩৫ সাল পর্যন্ত আরাকানে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ হয়। এরপর মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। ১৬৬০ সালে আরাকন রাজা থান্দথুধম্মা নিজ রাজ্যে আশ্রিত মোঘল স¤্রাট শাহজাদা সুজাকে সপরিবারে হত্যা করেন। এরপর শুরু হয় মুসলমানের উপর তার নিষ্ঠুর অমানবিক অত্যাচার-নিপীড়ন। প্রায় সাড়ে তিনশ’ বছর মুসলমানদের কাটাতে হয় এই দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে। ১৭৮০ সালে বর্মী রাজা বোধাপোয়া আরাকন দখল করে নেয়। সেও ছিল ঘোর মুসলিমবিদ্বেষী। বর্মী রাজা ঢালাওভাবে মুসলিম নিধন কতে থাকে। ইতিহাস সাক্ষী, ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে ৩০ হাজার বার্মিজ আরাকান আক্রমণ করে মুসলমানদের মসজিদ ও বিভিন্ন স্থাপনা করে দেয়। একই সঙ্গে তারা বহু রোহিঙ্গা মুসলমানকে পুড়িয়ে হত্যা করে এবং প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে।
১৮২৮ সালে বার্মা ইংরেজদের শাসন চলে যায়। তখন মুসলমানরা কিছুটা স্বস্তিতে কাটালে ১৯৩৭ সালে বার্মা স্বায়ত্তশাসন লাভের পর বৌদ্ধদের পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্যাপকরূপ নেয় এবং তারা প্রায় ৩০ লাখ মুসিলমকে হত্যা করে। এ সময় মুসলিমদের উপর অবর্ণীয় ধ্বংসকা- চালানো হয়। ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু মুসলিম জনগোষ্ঠর ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেনি। অধিকন্তু তৎকালীন স্বাধীন বার্মায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিতে শুরু করা হয় নতুন ষড়যন্ত্র। বার্মার স্বাধীনতার পর পরই বার্মার সেনাবাহিনী, পুলিশ ও সরকারি পদে রোহিঙ্গাদের নিষিদ্ধ করা হয। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে জেনারেল নে উইন রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে মিয়ানমার থেকে মুসলিম বিতাড়নের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করেন। তিনি নানাভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে ফায়দা লুটেন এবং মুসলিম নির্যাতনে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করেন। এরপর ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সনদ দেয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে কেড়ে নেয়া হয় তাদের ভোটাধিকার। তারপর চূড়ান্তভাবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্মূলে ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় অপারেশন ‘ড্রাগন কিং’। এই অমানবিক অভিযানের প্রেক্ষিতে তখন রোহিঙ্গা মুসলমানরা অনেকে প্রতিবেশী মুসলিম দেশ বাংলাদেশের দিকে পাড়ি জমায়। তখন শুধু ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দেই আড়াই লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলিম বার্মার বৌদ্ধদের বর্বর আক্রমণের মুখে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে বাধ্য হয় শরণার্থী হিসেবে। বার্মা পরবর্তীতে নতুন অঙ্গীকার নিয়ে মায়ানমার নাম ধারণ করলেও সেখানে মুসলিম নিধন অব্যাহতই থাকে। ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে অনেক মানুষ বৌদ্ধধর্ম পরিত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করে বলে সেখানকার উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা মুসলমানদেরকে সেখান থেকে নির্মূল করার ফন্দি আঁটে। তাই তাদেরকে সেদেশ থেকে বিতাড়িত করতে নানা রকম জুলুম ও হত্যাকা- অব্যাহত গতিতে চালিয়ে যায়। অথচ সেই অপরাধ ঢাকার জন্য মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে মিথ্যা তথ্য বলা হয়, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে আগত বাঙালি গোষ্ঠী। সুতরাং, রোহিঙ্গা মুসলমানদের মিয়ানমারে থাকার কোন অধিকার নেই। কিন্তু মিয়ানমার সরকার কখনো তাদের বক্তব্যের সমর্থনে কোনো দলিল হাজির করতে পারেনি। বরং রোহিঙ্গারা সেখানকার আদি বাসিন্দা, যুগ-যুগান্তের ইতিহাসই সে কথা প্রমাণ করে। তবুও বৌদ্ধপ্রভাবিত মিয়ানমার সরকার সেখানকার মুসলিম জনগণের উপর বিভিন্ন অমানবিক নির্যাতন চালায়। (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।