বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
আহমেদ জামিল : প্রেসিডেন্ট ওবামার ক্ষমতার মেয়াদের শেষপ্রান্তে এসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তার সবচাইতে ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত মিত্র ইসরাইলের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। যদিও এটি সাময়িক। কারণ রিপাবলিকানদলীয় ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের পর মার্কিন ও ইসরাইলের সম্পর্কের এ টানাপোড়েন থাকবে না। সম্পর্ক নতুন করে দৃঢ় ও ঘনিষ্ঠ হবে। তখন ইসরাইলের স্বার্থকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি পরিচালিত হবে। যে কারণে ট্রাম্পের ক্ষমতায় বসার ব্যাপারে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ইসরাইল। তবে এ কথাও সত্য যে প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা ইসরাইলের অনুকূলে নয়। ইসরাইল ও প্যালেস্টাইন এই দুই রাষ্ট্রভিত্তিক মধ্যপ্রাচ্য সংকটের স্থায়ী সমাধানের পথ নতুন করে খুঁজতে শুরু করছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোসহ ইউরোপের প্রভাবশালী বহুদেশ ইতোমধ্যে প্যালেস্টাইনকে স্বাধীন সার্কভৌম রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতিসংঘের সদস্যপদও লাভ করেছে প্যালেস্টাইন। জাতিসংঘে এখন উড়ছে প্যালেস্টাইনের জাতীয় পতাকা।
কূটনৈতিকভাবে ইসরাইল এখন অনেকটা কোণঠাসা। ওবামা প্রশাসনের শেষ মেয়াদে এসে ইসরাইলের স্বার্থবিরোধী ভূমিকা নেতানিয়াহুর সরকারকে যথেষ্ট বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলেছে। ধারণা করা যায়, ইসরাইলের মধ্যপ্রাচ্যে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য আরবদেশগুলো থেকে জাতীয়তাবাদী সরকার উৎখাতের পর যে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এহেন পরিস্থিতিতে বর্তমান সময়ের বৃহৎ শক্তি রাশিয়া এবং ভবিষ্যৎ পরাশক্তি চীন আরব বিশ্বে তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের অনারব আঞ্চলিক শক্তি ইরান। অর্থাৎ বর্তমান সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে ভূরাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলগত অবস্থানের দিক হতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। যে কারণে সিরিয়া সংকট নিরসনে ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি এখন প্রায় নেই বললেই চলে।
বোধকরি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা তার ক্ষমতার মেয়াদের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে উপলব্ধি করতে পেরেছেন ইসরাইলের স্বার্থে চালিত পররাষ্ট্রনীতি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ও কর্তৃত্বকে দুর্বল করে দিয়েছে। এদিকে ফিলিস্তিন এলাকায় ইহুদি বসতি নির্মাণের বিরুদ্ধে ব্যাপক সোচ্চার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। ওবামা প্রশাসনও এখন বিষয়টিকে ভালভাবে গ্রহণ করছে না। এটি দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক মধ্যপ্রাচ্য সংকট নিরসনে মার্কিন পরিকল্পনার পরিপন্থী বলে মনে করছে ওবামা প্রশাসন। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখ-ে ইসরাইলী বসতি স্থাপন বন্ধের বিরুদ্ধে রায় প্রদান করে। নিরাপত্তা পরিষদে বাধাহীনভাবে পাস হয় এ সংক্রান্ত প্রস্তাব। ৮ বছরের অচলাবস্থা ভেঙে গেল ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেয়া থেকে বিরত থাকার কারণে নিরাপত্তা পরিষদ এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারলো।
একে ক্ষমতা ত্যাগের আগে ওবামা প্রশাসনের ইসরাইলের প্রতি চপেটাঘাত বলা যেতে পারে। ১৯৪৮ সাল থেকে ইসরাইল সম্পর্কে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি একতরফা। এখানে নীতিনৈতিকতা এবং আন্তর্জাতিক আইন সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয়েছে। অসংখ্যবার জাতিসংঘে আরব দেশগুলোর ইসরাইলী আগ্রাসন ও প্যালেস্টাইনী জনগণের ওপর হত্যা, নির্যাতন, উচ্ছেদ, ভূমি দখল, অবরোধ ও তাদের মানবাধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে আনীত প্রস্তাবের বিরোধিতা করে সব মার্কিন প্রশাসন ইসরাইলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দিয়েছে। এদিকে গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বলেছেন, অধিকৃত ফিলিস্তিনী ভূখন্ডে ইসরাইলী বসতি নির্মাণ চলমান থাকায় দ্বিরাষ্ট্র সমাধান এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রক্রিয়া হুমকির মুখে রয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি আরো বলেছেন, অধিকৃত ফিলিস্তিনী ভূখন্ডে ইসরাইলের অবৈধ ইহুদি বসতি নির্মাণ বন্ধ করতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাস হওয়া প্রস্তাবে ভেটো না দেয়ার কারণ হলো ইসরাইলের হাতে অধিকৃত ভূখন্ডে যথেচ্ছ বসতি নির্মাণের লাইসেন্স তুলে দিতে চায়নি ওবামা প্রশাসন। কেরির এ বক্তব্যকে ফিলিস্তিন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস স্বাগত জানালেও কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ফিলিস্তিন ভূখ- থেকে ইহুদি বসতি নির্মাণ বন্ধের প্রস্তাব আসে মিসরের প্রেসিডেন্ট সিসির তরফ হতে। কিন্তু ভাবী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আপত্তির কারণে মিসরের প্রেসিডেন্ট প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিলেও, নিউজিল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সেনেগাল ও ভেনেজুয়েলার অনুরোধে ভোটের আয়োজন করা হয়। ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদে এ প্রস্তাব ১৪ ভোটে পাস হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র ভোটদানে বিরত থাকে। ভেটো প্রদান না করায় ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ করেছে। ইসরাইলের সাথে সুর মিলাচ্ছেন ভাবী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ভেটো না দেয়ায় ভীষণ নাখোশ হয়ে ওবামা প্রশাসনের কঠোর সমালোচনা করেছেন ট্রাম্প। তিনি ইসরাইলকে শক্ত থাকার ও সবুর করার আহ্বান জানিয়ে আগামী ২০ জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণের পর ‘দেখবেন’ বলে ইসরাইলকে আশ্বস্ত করেছেন। এটি নিশ্চিত করে বলা যায় যে, ট্রাম্পের গ্রিন সিগন্যাল পেয়েই ইসরাইল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব পাসের ক’দিন না যেতেই অর্থাৎ নিরাপত্তা পরিষদের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে পশ্চিমতীরের গ্রিনলাইন বরাবর নতুন করে ৬শ’ ইহুদি বসতি নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে। এখন এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কী পদক্ষেপ গ্রহণ করে সেটিই দেখার বিষয়।
প্রসঙ্গের সূত্র ধরে বলা হচ্ছে, মরহুম ফিলিস্তিনী নেতা ইয়াসির আরাফাত এবং প্রয়াত ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিনের সমঝোতা এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের মধ্যস্থতায় গত শতকের ’৯০-এর দশকে অসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়। পশ্চিমতীর ও গাজাকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ভিত্তি রচিত হয়। এর মাধ্যমে প্যালেস্টাইন ও ইসরাইল দুই রাষ্ট্রভিত্তিক মধ্যপ্রাচ্য সংকট নিরসনের পথ তৈরি হয়। কিন্তু লিকুদ দলের বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর শুরু থেকেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র মেনে নেয়ার ব্যাপারে তার অনীহার কথা জানিয়ে আসছেন। তিনি আলোচনা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে স্পর্শকাতর হওয়ার পরও পশ্চিমতীরে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ নতুন করে শুরু করেন।
বারাক ওবামা মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকে প্যালেস্টাইন ও ইসরাইলের মধ্যকার বৈরী সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে নতুন করে সমঝোতার ক্ষেত্র তৈরির জন্য নেয়া নানা উদ্যোগ ইসরাইলের আপত্তির মুখে ভেস্তে যায়। আলোচনায় প্যালেস্টাইনিরা অনেক ছাড় দিলেও ইসরাইল কোনো ছাড় না দিয়ে অনমনীয়তা দেখিয়ে এসেছে। সর্বোপরি প্যালেস্টাইনী ভূখ-ে ব্যাপক হারে ইহুদি বসতি নির্মাণের উদ্যোগ ভবিষ্যৎ প্যালেস্টাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নস্যাতের শামিল। এত কিছু করেও ইসরাইল স্বস্তিতে নেই। অতিসম্প্রতি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে প্যালেস্টাইনের অধিকৃত ভূখ-ে ইহুদি বসতি স্থাপনবিরোধী প্রস্তাব পাসের পর এবার স্বাধীন-সার্বভৌম প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠনে আন্তর্জাতিক তৎপরতার শুরুর আশঙ্কা করছে ইসরাইল।
এমনকি ভাবী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যতই হম্বিতম্বি করুন না কেন শেষ পর্যন্ত তিনিও বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে অতিইসরাইলকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতি পরিহার করতে পারেন। কারণ মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রভাব ও কর্তৃত্ব ফিরে পেতে হলে ট্রাম্প প্রশাসনকে অবশ্যই ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি অনুসরণ করতে হবে। মেনে নিতে হবে, দুই রাষ্ট্রভিত্তিক মধ্যপ্রাচ্য সংকটের সমাধান সূত্র। এদিকে তৃতীয় বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের পাশাপাশি ইউরোপের প্রভাবশালীসহ অন্যান্য দেশ প্যালেস্টাইনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতিসংঘ ও প্যালেস্টাইনকে রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নেবার কারণে জাতিসংঘে এখন প্যালেস্টাইনী পতাকা উড়ছে। এদিকে ইউনেস্কো পূর্ব জেরুজালেমকে প্যালেস্টাইনের অংশ বলে ঘোষণা দিয়ে ইসরাইলকে কূটনৈতিকভাবে বেশ বেকায়দায় ফেলেছে। বিব্রত করেছে।
অন্যদিকে ইসরাইলের মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক একচ্ছত্র কর্তৃত্ব এখন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন ইরানের আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে উত্থানের কারণে। সেই সাথে একথাও শোনা যায় যে, মুসলিম জাহানের একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তান তার জানি দুশমন ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরাইলের প্রতি কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে। এছাড়া ইসরাইলের অভ্যন্তরে ইহুদি নিয়ন্ত্রিত পিন্স নাউমুভমেন্টসহ বিভিন্ন শাস্তিকামী ও মানবতাবাদী ইহুদিরা ইসরাইলের পাশে স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিও জোরদার করেছে।
দেশের অভ্যন্তরে জনমতকে বেশিদিন উপেক্ষা করা নেতানিয়াহুর পক্ষে কতটা সম্ভব হবে সেটিও ভাববার বিষয়। যা হোক, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলকে রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে এবং তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে তাকে অবশ্যই প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করতে হবে। অধিকৃত প্যালেস্টাইন ভূখ-ে ইহুদি বসতি নির্মাণ এবং প্যালেস্টাইনীদের ওপর দমন-নির্যাতন বন্ধ এবং স্বাধীন-সার্বভৌম প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুযোগদানের মাধ্যমে এ ধরনের সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। আর ইসরাইলের মুরুব্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি অনুসরণ না করলে এ অঞ্চলে তার প্রভাব ও কর্তৃত্ব একেবারে শেষ হয়ে যেতে পারে। তাই বলা চলে, ইসরাইলের বসতি নির্মাণ ইস্যুতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
য় লেখক : কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।