Inqilab Logo

রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

জাল কাগজে বিদেশীদের ভিসা

প্রকাশের সময় : ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম : জাল কাগজপত্রে মিলছে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশীদের ভিসা। বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি সিন্ডিকেট মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে ভিসা ইস্যু করে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। এই সুযোগে বেপরোয়া হয়ে উঠছে ভিনদেশী অপরাধীরা। জড়িয়ে পড়ছে ভয়ংকর অপরাধে। অবৈধভাবে অবস্থানকারী এসব বিদেশী চোরাচালান, হত্যা, ডাকাতি, প্রতারণা, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে জড়িত বলে সম্প্রতি সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছে। কিন্তু যাদের কারণে বিদেশীরা অবৈধভাবে দেশে অবস্থান করার সুযোগ পাচ্ছে তারা থেকে যাচ্ছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশস্থ বিদেশী অফিস, প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কয়েক লাখ বিদেশী নাগরিক চাকরি করছেন। অনেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার কারণেও এদেশে বসবাস করছেন। বৈধভাবে বসবাসকৃত বিদেশী নাগরিকদের ভিসা দিয়ে থাকে বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ভিসা বিভাগ। কিন্তু কাজটি করতে গিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়াধীন এ দপ্তরের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী অবৈধ অর্থ উপার্জনের জন্য জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ কাজে জড়িত বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের দুর্ধর্ষ জালিয়াতচক্রও। অভিযোগ রয়েছে এ জালিয়াতচক্রটি গড়ে উঠেছে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের এক উপ-পরিচালকের নেতৃত্বে। গত বছর তার অধীনস্থ একজন উপ-সহকারী পরিচালকের বড় ধরনের কয়েকটি জালিয়াতির ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। তবে অদৃশ্য শক্তি ও শক্ত খুঁটির জোরে ওই উপ-পরিচালক এখনও স্বপদেই বহাল আছেন।
সূত্র জানায়, দেশে ভিনদেশী অপরাধীদের অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় গত বৃহস্পতিবার পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ৬৪ জেলা পুলিশ সুপার ও সব কয়টি মেট্রোপলিটনের পুলিশ কমিশনারকে অবৈধ বিদেশীদের তালিকা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাজধানীর কয়েকটি ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে টাকা লুট হওয়ার ঘটনায় একাধিক বিদেশী নাগরিক জড়িত বলে পুলিশ ও র‌্যাব নিশ্চিত হয়েছে। ওই সব প্রতারককে ধরতে সব কয়টি ইমিগ্রেশন ও সীমান্ত এলাকার কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
সূত্রমতে, ঢাকায় বিদেশী নাগরিকদের জন্য দুই ধরনের ভিসা ইস্যু করে বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর। বিজনেস (বি-ভিসা) এবং এমপ্লয়মেন্ট (ই-ভিসা)। একটি বিজনেস ভিসা ইস্যু করতে যে প্রতিষ্ঠান বিদেশী নাগরিককে চাকরি দিয়েছে সেই কোম্পানির ফরোয়ার্ডিং লেটার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স, এনএসআই, এসবি’র ছাড়পত্র প্রয়োজন হয়। বসবাসের উদ্দেশ্যে আসা বিদেশী নাগরিক বিমান থেকে এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করে ‘অ্যঅরাইভ্যাল ভিসা’ পেয়ে থাকেন। যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়ে বিদেশী নাগরিকটি এ দেশে আসেন সেই কোম্পানি একটি ফরোয়ার্ডিং লেটার দিয়ে প্রথম অস্থায়ী ভিসা প্রার্থনা করে ওই বিদেশীর জন্য। এ ভিসার মেয়াদ ৩ মাস। পরে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ওই কোম্পানি কর্মকালীন দীর্ঘমেয়াদি ভিসার আবেদন জানায়। তখনই উপরোক্ত কাগজপত্রের প্রয়োজন হয়। সে ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো হয়তো ৫ জন বিদেশীর জন্য ভিসার আবেদন জানায়। তখন ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকার  বিনিময়ে ৫ জনের আবেদনের বিপরীতে ৫০ জনের ভিসা ইস্যু করে পাসপোর্টেও জালিয়াতচক্র। সে ক্ষেত্রে চক্রের সদস্যরা কোম্পানীর একটি ফরোয়ার্ডিং লেটার, এসবি, এনএসআই ছাড়পত্রের সিরিয়াল, স্মারক ও তারিখ ফ্লুইড দিয়ে মুছে ৫০টি কপি করেন। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে সৃষ্ট কাগজপত্রের উপর ভিত্তি করে বিদেশী নাগরিকদের নামে ভুয়া ভিসায় স্বাক্ষর করা হয়। এক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের লালিত বিশ্বস্ত দালালচক্র কোম্পানীর কাছ থেকে ভিসার কন্ট্রাক্ট নিয়ে থাকে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, দালালদের মধ্যে কামাল, হাসান ও আরিফ কাজ করে ‘এনএসএফ করপোরেশন’র পক্ষ হয়ে। তারা ‘এনডিপিসি’ নামক প্রতিষ্ঠানের প্যাডে নিজেরাই সই-স্বাক্ষর করে ভিসার জন্য আবেদন করে। সূত্র জানায়, চাকরি ও ব্যবসার কাগজপত্র নিয়ে বৈধভাবে বাংলাদেশে আসার পর ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর বৈধতা না থাকায় অনেক বিদেশী এই সিন্ডিকেটের আশ্রয় নিচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিশ্বের ১২টি দেশের অন্তত দুই সহস্রাধিক নাগরিকের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। এর মধ্যে নাইজেরিয়া, ঘানা, কঙ্গো, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিপাইন, আলজেরিয়া, সুদান, তানজানিয়া, উগান্ডা, শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনের নাগরিকের সংখ্যাই বেশি। এরা দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এদের অনেকেরই ভিসার মেয়াদ শেষ। বৈধ ব্যবসা বা ওয়ার্ক পারমিট না থাকায় কেউ কেউ জাল কাগজপত্রে ভিসা নিয়ে রেখেছে। আবার অনেকে সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে আসছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে। কিন্তু ওই সব বিদেশী কোথায় যায়, কী করে, কোন এলাকায় বসবাস করে সেসব প্রয়োজনীয় তথ্য রাখতে পারছে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। সূত্র জানায়, অবৈধভাবে বসবাসরত বিদেশীদের বড় একটি অংশ বাংলাদেশে ভয়ংকর ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আবার কেউ কেউ অভিজাত এলাকায় অফিস খুলে বিভিন্ন দেশের ভিসা ও নাগরিকত্ব করিয়ে দেওয়ার কথা বলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়, গত বছরের জুলাই মাসে হযরত শাহজালাল (রা.) বিমানবন্দর থেকে প্রায় ২০ কেজি হেরোইনসহ গ্রেপ্তার করা হয় ভারতের তামিলনাড়–র বাসিন্দা এলাম উরুগুকে। একই সময় রাজধানীর উত্তরা থেকে এক কেজি হেরোইনসহ ধরা পড়ে তানজানিয়ার নাগরিক মো. রাশেদ, কঙ্গোর নাগরিক জেমস ও মঙ্গোলিয়ার নাগরিক চিচি। পুলিশ জানায়, তারা ভিসা ছাড়াই বাংলাদেশে অবস্থান করে মাদক ব্যবসা চালিয়ে আসছিল। এরপর ডিসেম্বরে ডলার জালিয়াতির অভিযোগে কেরানীগঞ্জের ডাকপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে কঙ্গোর দুই নাগরিক কামাঙ্গাবো নিবা জোসেফ ও ফাইলে ফলবো মিন্ডোলিয়াকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে গুলশানের একটি বাসা থেকে ৬০ লাখ টাকা মূল্যের বিভিন্ন দেশের জাল ডলার উদ্ধার করা হয়। গত বুধবার গুলশান এলাকা থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাৎকারী চক্রের সদস্য নাইজেরিয়ার নাগরিক ইজুচিউ ফ্রাংকিন, অবি হেছি, ইক ফ্লিস্ককে গ্রেফতার করে র‌্যাব। ঢাকায় অবস্থান করলেও এক বছর আগেই ওই তিনজনের  ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে বলে র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে। জানতে চাইলে ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের উপ-কমিশনার মারুফ হোসের সরদার বলেন, অবৈধভাবে অবস্থানরত বিদেশীদের নজরদারির জন্য পুলিশের বিশেষ শাখা কাজ করে। তিনি বলেন, সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনার পর এ বিষয়ে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর তৎপরতা আরও বাড়ানো হয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাল কাগজে বিদেশীদের ভিসা

২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ