Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আরও জটিল হচ্ছে চট্টগ্রাম আ’লীগের কলহ বিবাদ

বিএমএ নির্বাচন দিয়াজের মৃত্যু

| প্রকাশের সময় : ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : বিএমএ নির্বাচন আর ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর মৃত্যুকে ঘিরে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের গৃহবিবাদ আরও জটিল হয়ে উঠছে। কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি না করে দ্রুত বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশনার পরও থামছে না নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য। নেতাদের এসব বক্তব্যে পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে। উত্তেজনা বাড়ছে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ তৃণমূলে। এতে করে আগামী নির্বাচনের আগে কোন্দল নিরসনের কেন্দ্রীয় উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে বিরোধের একদিকে রয়েছেন মহানগর সভাপতি সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। অন্যদিকে আছেন সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। বিরোধের জেরে মহানগর থেকে শুরু করে থানা-ওয়ার্ড এমনকি ইউনিট পর্যায়ে বিভক্ত আওয়ামী লীগ। বিভক্ত ছাত্রলীগ-যুবলীগ সংঘাত-সংঘর্ষে জড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত। আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে ঘটছে খুনের ঘটনা। বিভক্তি প্রকট আকার ধারণ করেছে সহযোগী ও পেশাজীবী সংগঠনগুলোতেও।
গত ২২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বিএমএ নির্বাচনকে ঘিরে ওই দুই নেতার অনুসারীদের মধ্যে কলহ কোন্দল চরমে উঠে। বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত চিকিৎসকরা এবারের বিএমএ নির্বাচন বর্জন করে। চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের দুটি প্যানেলে ভোটযুদ্ধে মুখোমুখি হয়। নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও আ ন ম মিনহাজুর রহমান পরিষদের সমর্থক ছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। চিকিৎসকদের সংগঠনের এই নির্বাচনে বিজয়ী মুজিবুল হক খান ও ফয়সাল ইকবাল চৌধুরী পরিষদের সমর্থন পেয়েছিল আ জ ম নাছির উদ্দীনের। নির্বাচনে মুজিবুল হক খান ও ফয়সাল ইকবাল চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন পূর্ণ প্যানেল জয়লাভ করে।
নির্বাচনের প্রচারে দুই গ্রুপ পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়ে মাঠ গরম করে তোলে। ফলাফল ঘোষণার পর শুরু হয় নতুন বিতর্ক। মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রাম বিএমএ নির্বাচনে যারা বিজয়ী হয়েছেন তারা বিএনপি-জামায়াতের সাথে গোপন আঁতাত করেছেন বলে অভিযোগ করেন। চিকিৎসকদের ওই প্যানেলকে ‘লুটেরা’ প্যানেল উল্লেখ করে করে তিনি বলেন, তাদের জেতাতে বদলি ও পদাবনতির হুমকি দেয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ করেছেন। মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, বিএমএ নির্বাচনে চিকিৎসকদের লুটেরা প্যানেলকে জেতানোর জন্য চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ন্যক্কারজনক ভূমিকা পালন করেছেন। ভোটারদের বদলি ও পদাবনতির হুমকি দিয়ে তিনি ওই প্যানেলকে ভোট দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেছেন। চিকিৎসা সেক্টরের শৃঙ্খলা ও দুর্বৃত্তায়ন মুক্ত করার স্বার্থে তার অপসারণ দাবি করেন তিনি।
মহিউদ্দিন চৌধুরী আরও বলেন, তারা বিএনপি-জামায়াতের সাথে আঁতাত করে ভোটে জিতেছে। দলের স্বার্থ না দেখে স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থ দেখেছে। জামায়াতি চিকিৎসকদের তারা বদলিসহ নানা লোভ দেখিয়েছে। আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করে স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে নিয়ে যারা এ কাজ করেছে তাদের আমি চিনি। আমি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন নিয়ে এগিয়ে যাব। তাদের প্রতিরোধ করব। মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার দুর্বৃত্তসুলভ চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তাই হচ্ছে। এখানে একজন চিকিৎসক নেতার নেতৃত্বে একটি ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। চিকিৎসক কর্মচারীদের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে। এরা সেবা প্রার্থীদের জিম্মি করে সরকারি দলের লেবাসে সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ করছে।
মহিউদ্দিন চৌধুরীর এসব অভিযোগের বিষয়ে আ জ ম নাছির উদ্দীন প্রকাশ্যে কোন প্রতিক্রিয়া দেননি। তবে তার অনুসারী বিএমএ নেতারা তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। নির্বাচনোত্তর নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর বক্তব্যে তারা বিস্মিত ও ব্যথিত বলে জানান। স্বাচিপের জেলা সদস্যসচিব ডা. মোহাম্মদ শরীফের পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, বিএমএ নির্বাচনে স্বাচিপের মূলধারার এবং চট্টগ্রামের সিংহভাগ চিকিৎসকদের সমর্থন নিয়ে ডা. মুজিব-ডা. ফয়সল পরিষদের নেতারা যেভাবে বিগত ১ মাস চট্টগ্রামের সর্বস্তরের চিকিৎসকদের নিকট ভোট প্রার্থনা করেছেন, একইভাবে ডা. নাসির-ডা. মিনহাজ পরিষদও সব চিকিৎসকের কাছে ভোট প্রার্থনা করেন যা থেকে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত চিকিৎসক ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বাদ যায়নি। কিন্তু নির্বাচনে বিপুল ভোটে পরাজিত হয়ে তারা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নানারকম প্রলাপ বকছে যা আঙুর খেতে না পেয়ে ধূর্ত শেয়ালের আঙুরের বদনাম করার পুরোনো গল্পটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়।
মহিউদ্দিন চৌধুরীকে ইঙ্গিত করে বলা হয় তাদের সাথে সুর মিলিয়ে মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়েছেন চট্টগ্রামের একজন জ্যেষ্ঠ আওয়ামী লীগ নেতা যা আমাদের শুধুই বিস্মিত করেনি, ব্যথিতও করেছে। তিনি আপামর চিকিৎসকদের ভোটে নির্বাচিত ডা. মুজিব-ডা. ফয়সল প্যানেলকে ‘লুটেরা প্যানেল’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘হাসপাতালের ওষুধপত্র ও রোগীদের খাদ্য তারা লুট করছে।’ এই বক্তব্যের নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। আমরা আহ্বান জানাই, সত্যিকারের লুটেরাদের চিনুন, যারা জেনারেল হাসপাতালে লুট করেছে, যারা রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে লুট করেছে, যারা চমেক হাসপাতালে কার্ডিওলজি ওয়ার্ডে রোগীদের জিম্মি করে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করেছে, তারা বর্তমানে আপনার চারপাশেই আছে এবং আপনাকে বিভ্রান্ত করছে। বিবৃতিতে বলা হয়, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাকে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি না করে মুরুব্বি হিসেবে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রাখার যে আহ্বান জানিয়েছেন তার পরদিনই এ ধরনের বাস্তবতা বিবর্জিত ও মিথ্যা অপপ্রচারে লিপ্ত হওয়া তার মতো বর্ষীয়ান নেতার পক্ষে বেমানান ও নিন্দনীয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর রহস্যজনক মৃত্যু নিয়েও ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপ মুখোমুখি। বিশ্ববিদ্যালয়ে টেন্ডারবাজির ঘটনাকে কেন্দ্র করে দিয়াজকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তার অনুসারীরা। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সভাপতিসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছেন দিয়াজের মা। বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পকে ঘিরে টেন্ডারবাজিতে মুখোমুখি ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ ব্যক্তি থেকে শুরু করে কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধেও টেন্ডারবাজির সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠে।
এ প্রেক্ষাপটে গত রোববার মহিউদ্দিন চৌধুরীর চশমা হিলের বাসায় মহিউদ্দিন চৌধুরী ও আ জ ম নাছির উদ্দীনের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন ওবায়দুল কাদের। ওই বৈঠকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি প্রফেসর ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীকে কঠোর ভাষায় ভর্ৎসনা করেন ওবায়দুল কাদের। আওয়ামী লীগ নেতাদের নিজেদের মধ্যে দ্রুত বিরোধ নিরসনেরও নির্দেশনা দিয়ে যান তিনি।
রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের কলহ-বিরোধ নিরসনের অংশ হিসেবে চট্টগ্রামের নেতাদের সাথে এ বৈঠক করেছেন তিনি। এ বৈঠকের কয়েক ঘণ্টা না যেতেই মহানগর আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে বিরোধ নিরসনের বদলে তিক্ততা আরও বাড়বে বলে মনে করছেন দলের নেতাকর্মীরা। মহিউদ্দিন-নাছিরের নানা ইস্যুতে চলমান দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব আগামী নির্বাচনকে ঘিরে আরও ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে বলেও চট্টগ্রামের রাজনৈতিক মহলে আলোচনা আছে।
জাতীয় কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর গত ১২ নভেম্বর প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম আসেন ওবায়দুল কাদের। ওইদিন সার্কিট হাউসে তাকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপ মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে। একইদিন বিকেলে লালদীঘি ময়দানে গণসংবর্ধনায় মারামারিতে লিপ্ত হয় উত্তর জেলার দুই গ্রুপ। দলীয় সূত্র জানায়, ওই দু’টি ঘটনারও এখনও কোন সুরাহা হয়নি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আ’লীগ

১৪ আগস্ট, ২০১৮

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ