দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
নিখিল বিশ্বের স্রষ্টা ও প্রতিপালক মহান আল্লাহর অবাধ্যতা ও নাফরমানি কোন অবস্থায়ই মানুষের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। যে ব্যক্তি যতবেশি মহান আল্লাহর বাধ্যগত হবে তার জীবন ততবেশি সুখ, শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যময় হওয়ার আশা করা যায়। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার যতবেশি অবাধ্য হবে ইহ ও পরকালে তার জীবন ততবেশি সঙ্কটাপন্ন হবার আশঙ্কা রয়েছে। কোন গোলাম যদি তার মনিবের অবাধ্যতা করে, তাহলে এটা তার জন্য সমূহ অকল্যাণ বয়ে আনে। তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে যায়। ঠিক তেমনিভাবে কোন মানুষ যদি বিশ্বস্রষ্টা ও রাজাধিরাজ পরাক্রমশালী আল্লাহর নাফরমানি করে, তাহলে এটাও তার জন্য ধ্বংস ও বিনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আমরা এমন সাতটি ধ্বংসাত্মক বিষয়ের আলোচনা করছি যেগুলো সম্পাদন করলে সম্পাদন কারীর জন্য ইহ ও পরকালের বিনাশ নিশ্চিত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।
শিরক করা: মহান আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে প্রভুত্বের আসনে সমাসীন করার নাম শিরক। নভোম-ল ও ভূম-লের সৃষ্টিতে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে অন্য কেউ শরিক রয়েছে বলে ধারণা করা, আল্লাহ তাআলার মতো কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে ইবাদতের যোগ্য মনে করা, মহান আল্লাহর মতো কাউকে ভয় করা এবং আল্লাহ তাআলার মতো অন্য কারো কাছে প্রার্থনা করা শিরক বলে গণ্য। মহান আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা এক ধ্বংসাত্মক অপরাধ। এই অপরাধে অপরাধী ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা কখনো ক্ষমা করবেন না। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে এসেছে, নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে লোক তাঁর সাথে শরিক করে। তিনি ক্ষমা করেন এর নি¤œ পর্যায়ের পাপ, যার জন্য তিনি ইচ্ছা করেন। আর যে লোক অংশীদার সাব্যস্ত করল আল্লাহর সাথে, সে যেন অপবাদ আরোপ করল।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৪৮) সুরা লুকমানের তেরোতম আয়াতে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে শরিক করাকে সবচেয়ে বড় জুলুম বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।অনুরূপভাবে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদিসেও মহান আল্লাহর সঙ্গে শিরক করাকে সবচেয়ে বড় অপরাধ বলে অভিহিত করা হয়েছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা. বলেন, আমি মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞাসা করলাম, কোন্ অপরাধ আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বড়? তিনি বললেন, আল্লাহর জন্য অংশীদার দাঁড় করান; অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। আমি বললাম, এতো সত্যিই বড় অপরাধ। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪৪৭৭)
জাদু করা: ইহ ও পরকালের বিবেচনায় ক্ষতিকর নয় এমন জাদু শিক্ষা করা ও শিক্ষা দেওয়া জায়েজ। কিছু জাদু এমন রয়েছে যেগুলো ইহ ও পরকালের বিবেচনায় ক্ষতিকর, এমন জাদু নিজে শিক্ষা করা কিংবা অপরকে শিক্ষা দেওয়া জায়েজ নেই। যেমন— কুফর ও শিরকি কথাযুক্ত জাদু। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটায় এমন জাদু। অহেতুকভাবে অন্যের ক্ষতি সাধন করে এমন জাদু। কিছু কিছু জাদু মানুষকে কাফের পর্যন্ত বানিয়ে দেয়। তাই কারো ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে জাদু করা, জাদু শিক্ষা করা কিংবা শিক্ষা দেওয়া হতে বিরত থাকা নিতান্ত অপরিহার্য। মহান আল্লাহ বলেন, ‘শয়তানরা মানুষকে জাদুবিদ্যা এবং বাবেল শহরে হারুত ও মারুত দুই ফেরেশতার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছিল তা শিক্ষা দিত। তারা উভয়ই এ কথা না বলে কাউকে শিক্ষা দিত না যে, আমরা পরীক্ষার জন্য; কাজেই তুমি কাফের হয়ো না। অতঃপর তারা তাদের কাছ থেকে এমন জাদু শিখত, যা দ্বারা স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। তারা আল্লাহর আদেশ ছাড়া তা দ্বারা কারও অনিষ্ট করতে পারত না। যা তাদের ক্ষতি করে এবং উপকার না করে, তারা তাই শিখে। তারা ভালরূপে জানে যে, যে কেউ জাদু অবলম্বন করে, তার জন্য পরকালে কোন অংশ নেই। যার বিনিময়ে তারা আত্মবিক্রয় করেছে, তা খুবই মন্দ যদি তারা জানত।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১০২)
অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা: মানুষ যেসব বস্তুকে ভালোবাসে তার মধ্যে সর্বাগ্রে অবস্থান করে তার প্রাণ। প্রতিটি ব্যক্তি তার প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। এই পৃথিবীতে কারো অধিকার নেই অন্যায় ভাবে অন্য কোন ব্যক্তির প্রাণ হরণ করার। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে একজন মানুষের অন্যায় হত্যাকে সকল মানুষকে হত্যা করার নামান্তর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদি কোন ব্যক্তি কোন মুসলমানকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে, তাহলে আল্লাহ তাআলা তার প্রতি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। তাকে অভিসম্পাত করেন এবং তার জন্য ভয়ংকর শাস্তির ব্যবস্থা করেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি স্বেচ্ছাক্রমে মুসলমানকে হত্যা করে, তার শাস্তি জাহান্নাম, তাতেই সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তার জন্যে ভীষণ শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৯৩)
সুদ খাওয়া: সুদের দাতা, গ্রহীতা, লেখক ও সাক্ষী হওয়া এমন এক মারাত্মক অন্যায় ও ধ্বংসাত্মক অপরাধ যার উপর স্বয়ং মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিসম্পাত করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ তাআলা ও তার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ থেকে সুদখোরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অতএব, যারা সুদের আদান-প্রদান করবে তাদেরকে কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যে সমস্ত বকেয়া আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাক। অতঃপর যদি তোমরা পরিত্যাগ না কর, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে যাও। কিন্তু যদি তোমরা তওবা কর, তবে তোমরা নিজের মূলধন পেয়ে যাবে। তোমরা কারও প্রতি অত্যাচার করো না এবং কেউ তোমাদের প্রতি অত্যাচার করবে না। (সুরা বাকারা, আয়াত : ৭৮-৭৯) (চলবে)
এতিমের মাল আত্মসাৎ করা: অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান রেখে যখন কোন পিতা মৃত্যুবরণ করে তখন সেই সন্তান অনেকাংশে অভিভাবকহীন ও অসহায় হয়ে যায়। পিতার অকৃত্রিম স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়। অনাথ এই শিশুর দুরবস্থায় তার আত্মীয়স্বজন ও পরিবার-পরিজনসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্ব হলো তাকে সাহায্য ও সহযোগিতা করা। তাকে লালন পালন করা ও সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সহায়তা করা। যথাযথভাবে তার সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ করা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অনাথ শিশুর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে সমাজের কিছু দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি তার সম্পদ আত্মসাৎ করে। তাকে উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত করে। এমনটি করা অত্যন্ত অমানবিক ও চরম অন্যায় কাজ। এতিমের মাল কুক্ষিগত করা পেটে আগুন ভরার নামান্তর। মহান আল্লাহ বলেন, যারা এতিমদের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে খায়, তারা নিজেদের পেটে আগুনই ভর্তি করেছে এবং সত্বরই তারা অগ্নিতে প্রবেশ করবে।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১০)
যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন
যদি কখনো কাফেরদের সঙ্গে মুসলমানদের ধর্ম যুদ্ধ হয়, তাহলে প্রতিটি মুসলমান সৈনিকের দায়িত্ব হল প্রাণপণে লড়াই করা। আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রক্তের শেষ বিন্দু থাকা পর্যন্ত কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। যুদ্ধ চলা অবস্থায় কৌশল হিসাবে কাফেরদেরকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য কিংবা নিজেদের সৈনিকদের কাছে আশ্রয় লাভ করার নিমিত্তে সাময়িকভাবে পিছু হটলে এর অবকাশ রয়েছে। কিন্তু কাফেরদের ভয়ে ভীত হয়ে কোন মুসলমান সৈনিক যদি যুদ্ধের ময়দান হতে পলায়ন করে, তাহলে আল্লাহর গজব তার জন্য অবধারিত হয়ে যায়। এমন ব্যক্তির ঠিকানা জাহান্নামে হওয়ার কঠোর হুঁশিয়ার বাণী মহাগ্রন্থ আল কুরআনে উচ্চারণ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা যখন কাফেরদের সাথে মুখোমুখী হবে, তখন পশ্চাদপসরণ করবে না। আর যে লোক সেদিন তাদের থেকে পশ্চাদপসরণ করবে, অবশ্য যে লড়াইয়ের কৌশল পরিবর্তনকল্পে কিংবা যে নিজ সৈন্যদের নিকট আশ্রয় নিতে আসে সে ব্যতীত অন্যরা আল্লাহর গজব সাথে নিয়ে প্রত্যাবর্তন করবে। আর তার ঠিকানা হল জাহান্নাম। বস্তুতঃ সেটা হল নিকৃষ্ট অবস্থান।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ১৫-১৬)
সতী নারীদের অপবাদ দেওয়া
সমাজে বহু মুসলিম নারী এমন রয়েছে যারা স্বভাবগতভাবেই সতী-সাধ্বী। তারা অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও বেলেল্লাপনার ধার ধারে না। অশালীনতা, চরিত্রহীনতা এবং যিনা-ব্যভিচারের ধারে কাছেও তারা যায় না। এমন চরিত্রবান নারীদের চরিত্র নিয়ে কটুক্তি করা এবং তাদের বিরুদ্ধে যিনা-ব্যভিচারের অপবাদ দেওয়া নিতান্ত অন্যায় ও চরম অপরাধ। যেসব লোক নিরীহ ঈমানদার সতী-সাধ্বী মুসলিম নারীদের উপর অপবাদ আরোপ করবে তারা ইহ ও পরকালে ধিকৃত হবার সঙ্গে সঙ্গে মহান আল্লাহ শাস্তির সম্মুখীন হবে। পবিত্র কুরআন শরিফে বর্ণিত হয়েছে, ‘যারা সতী-সাধ্বী, নিরীহ ঈমানদার নারীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করে, তারা ইহকালে ও পরকালে ধিকৃত এবং তাদের জন্যে রয়েছে গুরুতর শাস্তি।’ (সুরা নুর, আয়াত : ২৩)
উপরে যে সাতটি পাপের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো নিতান্ত অন্যায় ও চরম অপরাধ। বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এগুলোকে ধ্বংসাত্মক বলে আখ্যায়িত করে এগুলো হতে বিরত থাকার নির্দেশ প্রদান করেছেন। ‘হজরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সাতটি ধ্বংসকারী বিষয় থেকে তোমরা বিরত থাকবে। সাহাবিগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! সেগুলো কী? তিনি বললেন, (১) আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা (২) জাদু করা (৩) আল্লাহ তাআলা যাকে হত্যা করা হারাম করেছেন, শরিয়ত সম্মত কারণ ব্যতিরেকে তাকে হত্যা করা (৪) সুদ খাওয়া (৫) এতিমের মাল গ্রাস করা (৬) রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়া এবং (৭) সরল স্বভাবা সতী-সাধ্বী বিশ্বাসী নারীদের অপবাদ দেয়া।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৭৬৬) মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে এসব ধ্বংসাত্মক বিষয় হতে বিরত থাকার তৌফিক দান করুন।
লেখক :
শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা-১২১১
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।