Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নামায ও মোবাইল : কিছু জরুরি মাসআলা

মুফতী পিয়ার মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

এখন প্রায় প্রতিটি মসজিদের একই চিত্র যে, জামাতে নামায চলা অবস্থায় নামাযীর মোবাইলে রিং বেজে উঠে। নামায অবস্থায় মোবাইল বেজে উঠলে যার মোবাইল শুধু যে তার নামাযেরই বিঘœ ঘটায় এমন নয়; বরং আশপাশের মুসল্লীদেরও খুশুখুযু বিঘিœত হয়। নামায অবস্থায় মসজিদে যেহেতু পিন পতন নিরবতা বিরাজ করে, তাই মোবাইল বেজে উঠার সাথে সাথেই সকলের ধ্যান-খেয়াল চলে যায় মোবাইলের রিংটোনের দিকে। অথচ নামায অন্য সকল ইবাদত থেকে ভিন্ন ধরণের একটি ইবাদত। এ ইবাদতটি হল সরাসরি আল্লাহ তাআলার দরবারে হাজিরা দিয়ে তাঁর মহান স্বত্ত্বার সামনে দন্ডায়মান হয়ে তাঁর সাথে কথোপকথনের এক অপূর্ব মুহূর্ত। এ কারণেই নামায অবস্থায় একাগ্রতা ও খুশুখুযুর প্রতি যেভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, অন্য কোনো ইবাদতের বেলায় তেমনটি করা হয়নি। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘ঐ সকল মুমিন সফলকাম, যারা নিজেদের নামাযে বিনয়-নম্র। [সূরা মুমিনুন ১-২] তাই একজন নামাযীর উচিত মসজিদে প্রবেশের আগেই মোবাইল একেবারে বন্ধ না করলেও অন্তত রিংটোন বন্ধ করে দেওয়া। এ অবস্থায় মোবাইলে ভাইব্রেশন দিয়ে রাখা ঠিক নয়। কারণ, ভাইব্রেশন দিয়ে রাখলেও কল আসলে নামাযীর মনোনিবেশ নষ্ট করে। এতে অন্যের নামাযের ক্ষতি না হলেও নিজের নামাযের খুশুখুযু নষ্ট হয় অবশ্যই। তাছাড়া মোবাইলটি তখন পার্শ্ববর্তী মুসল্লীর শরীরে স্পর্শ করলে তারও নামাযের একাগ্রতা নষ্ট হবে। তাই ভাইব্রেশন দিয়ে রাখাও ঠিক নয়, বরং হয়ত সাইলেন্ট করে রাখবে, কিংবা একেবারে বন্ধ করে দিবে। কোনো কারণে যদি নামাযের আগে মোবাইলের রিং বন্ধ করা না হয় আর নামায পড়াবস্থায় রিং বেজে উঠে তখন করণীয় ও লক্ষণীয় বিষয়সমূহ হলো নি¤œরূপ :
১.দুই হাত ব্যবহার না করে নামাযের আপন অবস্থাতে থেকেই এক হাতের সাহায্যে মোবাইল পকেটে রেখেই কোনো বাটন চেপে রিং বন্ধ করে দিবে। আর পকেট থেকে বের করার প্রয়োজন হলেও এক হাত দ্বারাই করবে। মোবাইল বের করে পকেটের কাছে রেখেই না দেখে দ্রুত বন্ধ করে পকেটে রেখে দিবে। জেনে রাখা প্রয়োজন যে, নামাযে প্রয়োজনে এক হাত কোনো কাজে ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে। যেমন, টুপি ওঠানোর জন্য, জামার হাতা নামানোর জন্য, সিজদার স্থানের কংকর সরানোর জন্য, শরীরের কোনো স্থান বিশেষ প্রয়োজনে চুলকানোর জন্য ইত্যাদি। [ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১/৫৬৪, শরহুল মুনিয়াহ ৪৪৩, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১০৫, খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/১২৯, রদ্দুল মুহতার ১/৬২৪, শরহে নববী ১/২০৫]
২.এক হাত দ্বারা বন্ধ করতে গিয়ে মোবাইল পকেট থেকে বের করে দেখে দেখে বন্ধ করা যাবে না। কারণ, এমনটি করলে যদিও দুই হাত ব্যবহার হচ্ছে না, কিন্তু মোবাইল দেখে দেখে বন্ধ করা অবস্থায় এ ব্যক্তিকে কেউ দেখলে সে নামাযে আছে বলে মনে করবে না। আর নামায অবস্থায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে নামায ভেঙে যায়। তাই নামায অবস্থায় মোবাইল দেখে দেখে বন্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। [রদ্দুল মুহতার ১/২৬৪-২৬৫, আলবাহরুর রায়েক ২/১১-১২]
৩.নামাযে মোবাইল বন্ধের জন্য একসাথে দুই হাত ব্যবহার করা যাবে না। যদি এক সাথে দুই হাত ব্যবহার করে তবে নামায নষ্ট হয়ে যাবে। [রদ্দুল মুহতার ১/২৬৪-২৬৫, আলবাহরুর রায়েক ২/১১-১২]
৪.সিজদাবস্থায় রিং বেজে উঠলে কেউ কেউ সিজদা থেকে প্রায় বসে গিয়ে মোবাইল বের করে বন্ধ করে থাকে। অথচ তখনো ইমাম-মুসল্লী সকলেই সিজদাতেই থাকে। নামাযের এ অবস্থা থেকে মোবাইল বন্ধের জন্য বসে যাওয়াতে নামায ভেঙ্গে যাবে। যদিও মোবাইল বন্ধ করাতে তিন তাসবীহ পরিমাণ সময় ব্যয় না হয়। কারণ, যেখানে দুই হাতের ব্যবহারকেই নামায ভঙ্গের কারণ বলা হয়েছে, সেখানে পুরো শরীরকে নামাযের অবস্থা থেকে সরিয়ে নিয়ে আসা নিঃসন্দেহে নামায ভঙ্গের কারণ হবে। এ ছাড়া এ অবস্থায় কোনো আগন্তুক তাকে দেখলে সে নামাযে নেই বলেই মনে করবে। এটিও আমলে কাসীরের অন্তর্ভুক্ত। যা নামায নষ্টকারী।
৫.তিনবার বিশুদ্ধভাবে ‘সুবহানা রাবিবয়াল আযীম’ বা ‘সুবহানা রাবিবয়াল আ’লা’ বলা যায়- এ পরিমাণ সময়ের ভিতর উপরন্তু দুইবার পর্যন্ত এক হাতের সাহায্যে উপরোক্ত ১ নং এ উল্লেখিত নিয়মে রিং বন্ধ করা যাবে। এ সময়ের ভিতর দুইবারের বেশি বন্ধ করা যাবে না। যদি করে তবে নামায নষ্ট হয়ে যাবে। হাঁ, একবার বা দুই বার বন্ধ করার পর তিন তাসবীহ পরিমাণ বিলম্বে আবার রিং বেজে উঠলে তখন বন্ধ করা যাবে। মোটকথা তিন তাসবীহ বলা যায় এ সময়ের ভিতর তিনবার রিং বন্ধের জন্য এক হাতও ব্যবহার করা যাবে না। এতে নামায নষ্ট হয়ে যাবে। [-খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/১২৯, রদ্দুল মুহতার ১/৬২৫, আহসানুল ফাতাওয়া ৩/৪১৮-৪১৯]
৬.মোবাইল প্যান্টের পকেটে থাকলে তা বের করে বন্ধ করার জন্য দুই হাত ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। তদ্রূপ ফোল্ডিং সেট হলেও রিং বা ফোন বন্ধ করতে কখনো কখনো দুই হাত ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়। অথচ দুই হাত ব্যবহার করলে নামায ভেঙ্গে যায়। তাই এক্ষেত্রে কি নিজের নামায নষ্ট করে হলেও রিং বন্ধ করবে? নাকি করবে না। মূলত নামাযে খুশুখুযুর গুরুত্ব অনেক বেশি। এতই বেশি যে, কোনো নামাযীর মল-মূত্রের বেগ হওয়ার দরুণ খুশুখুযু বিঘিœত হলে তার জন্য নামায ছেড়ে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ফিকহের কিতাবাদিতে এ ক্ষেত্রে নামায ছেড়ে দেওয়াকে উত্তম বলা হয়েছে। কেউ কেউ ওয়াজিবও বলেছেন। [তাহতাবী আলাল মারাকী-১৯৮, হিন্দিয়া ১/১০৭, আল বাহরুল রায়েক ১/২৮৭, রদ্দুল মুহতার ১/৬৫৪] তাহলে নামায অবস্থায় মোবাইল বেজে উঠলে যার মোবাইল শুধু তার নামাযেরই বিঘœ ঘটায় না বরং আশপাশের মুসল্লীদেরও খুশুখুযু বিঘিœত হয়। সুতরাং এক্ষেত্রে নামায নষ্ট না করে বন্ধ করা সম্ভব না হলে নামায ছেড়ে দিয়ে হলেও মোবাইল বন্ধ করা জায়েয তো বটেই; বরং এমনটি করাই কর্তব্য। আর রিংটোন যদি গান বা মিউজিকের হয়, তবে এর খারাবিতো আরো অধিক। সুতরাং এ ধরণের পরিস্থিতিতে নামাযে থেকে উপরোক্ত নিয়ম অনুযায়ী একহাত দিয়ে বন্ধ করা সম্ভব হলে তাই করবে। আর তা সম্ভব না হলে নিজের নামায ছেড়ে দিয়ে হলেও রিং বন্ধ করে দিবে। অতঃপর মাসবুকের ন্যায় আবার নতুন করে জামাতে শরীক হবে। [রদ্দুল মুহতার ১/৬৫৫]

লেখক: সিনিয়র মুহাদ্দিস,জামিয়া আরাবিয়া মাখযানুল উলূম, তালতলা, মোমেনশাহী।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ