দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
আমাদের চারপাশে দৈনন্দিন কত অন্যায়-অপরাধ সংঘটিত হয়। ব্যক্তি,পরিবার,সমাজ এবং রাষ্ট্র সর্বত্রই নানা অপরাধের স্বাক্ষী আমরা। অনেকেই এসব অপরাধের কেবল নিরব দর্শক হয়। তা নির্মুলে কোনো ভূমিকা রাখে না বা রাখার চেষ্টা করে না। ইসলাম এমন নিরব ভূমিকা সমর্থন করে না; বরং নিজ সাধ্য ও সামর্থ্যের আলোকে এসব অন্যায়-অপরাধের প্রতিবাদ করা এবং তা নির্মুলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা ঈমানের অপরিহার্য দাবী। একজন মুসলিমের এটা ঈমানী দায়িত্ব। এমনকি অনান্য জাতিগোষ্ঠীর তুলনায় মুসলিম সম্প্রদায় শ্রেষ্ঠতম হওয়ার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যানের জন্যেই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। (আলে ইমরান- ১১০)
হাদিস শরীফে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধ্যানুযায়ী অন্যায়ের প্রতিবাদ করার আদেশ করেছেন এবং প্রতিবাদের ধরন অনুযায়ী ঈমানের স্তর ঘোষণা করেছেন। রাসূলে পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আবু সাঈদ (রাযিঃ) বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) - কে বলতে শুনেছি, তোমাদের কেউ যদি অন্যায় কাজ দেখে, তাহলে সে যেন হাত দ্বারা এর সংশোধন করে দেয়। যদি এর ক্ষমতা না থাকে, তাহলে মুখের দ্বারা, যদি তাও সম্ভব না হয়, তাহলে অন্তর দ্বারা (উক্ত কাজকে ঘৃণা করবে আর নিমুলের ফিকির ও দোয়া করবে), আর এটাই ঈমানের নিম্নতম স্তর। (মুসলিম-৮৩)
অনেকে মনে করে, আমি যেহেতু অপরাধ করছি না, আমার সমস্যা নেই, আমি তো আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি, এই ভেবে সে অন্যায় -অপরাধ দেখেও পাশ কেটে যায়, নিজের লাভ-ক্ষতির দিক বিবেচনা করে কিছু বলে না। এমন স্বার্থান্বেষী চিন্তা প্রকৃত অর্থে নিজের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কেননা কোনো সমাজে অপরাধীকে বাঁধা না দিলে বা প্রতিবাদ করা না হলে আল্লাহর আযাব সকলকেই গ্রাস করে নেয়। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে নিরব ভূমিকা পালনকারীও আল্লাহর সেই আযাব থেকে রেহাই পায় না। পক্ষান্তরে অপরাধ নির্মুল না হলেও শুধু সাধ্যমত প্রতিবাদ জানানো মানুষগুলো আল্লাহর আযাব থেকে বেঁচে যায়। বনী ইসরায়েলের এক কওমকে আল্লাহ তায়ালা নির্দিষ্ট দিনে নদী থেকে মাছ ধরতে নিষেধাজ্ঞা দেন। তাদের সমাজে একদল তখন এ নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মাছ ধরে। পক্ষান্তরে সমাজের বাকী মানুষগুলো থেকে কতক তাদের এ অন্যায় থেকে বাঁধা দিয়েছেন আর কেউ নিরব ভূমিকা পালন করেছে। পরিশেষে আল্লাহ তায়ালা অপরাধী এবং নিরব ভূমিকা পালনকারীদের আযাব দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছেন।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ঘটনাটির ব্যাপারে ইরশাদ করেন, ‘অতঃপর যখন তারা সেসব বিষয় ভুলে গেল, যা তাদেরকে বোঝানো হয়েছিল, তখন আমি সেসব লোককে মুক্তি দান করলাম যারা মন্দ কাজ থেকে বারণ করত। আর পাকড়াও করলাম, গোনাহগারদেরকে নিকৃষ্ট আযাবের মাধ্যমে তাদের না-ফরমানীর দরুন। (সূরা আ‘রাফ-৬৫)
তাই সামগ্রিক আযাব থেকে বাঁচতে হলে শুধু নিজে অন্যায়-অপরাধ থেকে বেঁচে থাকা যথেষ্ট নয়; বরং এর পাশাপাশি সাধ্যমতে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা সামগ্রিক আযাব থেকে সতর্ক করে ইরশাদ করেন, ‘আর তোমরা এমন ফাসাদ থেকে বেঁচে থাক যা বিশেষতঃ শুধু তাদের উপর পতিত হবে না যারা তোমাদের মধ্যে জালেম এবং জেনে রেখ যে, আল্লাহর আযাব অত্যন্ত কঠোর। (সূরা আনফাল-২৫)
এ আয়াত দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায়, একজন মুসলিমের দায়িত্ব কেবল নিজেকে শরীয়তের অনুসারী বানানোর দ্বারাই শেষ হয়ে যায় না। সমাজে যদি কোন মন্দ কাজের বিস্তার ঘটতে দেখে, তবে সাধ্যমত তা রোধ করাও তার দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে যদি অবহেলা করে এবং সেই মন্দ কাজের দরুণ কোনও বিপর্যয় দেখা দেয়, তবে মন্দ কাজে যারা সরাসরি জড়িত ছিল কেবল তারাই সেই বিপর্যয়ের শিকার হবে না; বরং যারা নিজেরা সরাসরি মন্দ কাজ করেনি, কিন্তু অন্যদেরকে তা করতে বাধাও দেয়নি, তাদেরকেও বিপর্যয়ের শিকার হতে হবে। হাদিস শরীফে বিষয়টিকে খুব সুন্দর একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে বুঝানো হয়েছে। নু‘মান ইবনু বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে মহান আল্লাহর নির্ধারিত সীমার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং যে সীমা লঙ্ঘন করে, তাদের দৃষ্টান্ত সেই যাত্রীদলের মতো, যারা কুরআ’র মাধ্যমে এক নৌযানে নিজেদের স্থান নির্ধারণ করে নিল। তাদেও কেউ স্থান পেল উপর তলায় আর কেউ নীচ তলায় (পানির ব্যবস্থা ছিল উপর তলায়) কাজেই নীচের তলার লোকেরা পানি সংগ্রহ কালে উপর তলার লোকদের ডিঙ্গিয়ে যেত। তখন নীচ তলার লোকেরা বলল, উপর তলার লোকেদের কষ্ট না দিয়ে আমরা যদি নিজেদের অংশে একটি ছিদ্র করে নেই (তবে ভালো হয়) এমতাবস্থায় তারা যদি এদেরকে আপন মর্জির উপর ছেড়ে দেয় তাহলে সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে। আর যদি তারা এদের হাত ধরে রাখে (বিরত রাখে) তবে তারা এবং সকলেই রক্ষা পাবে। (বুখারী-২৪৯৩)
অতএব, আল্লাহর আযাব এবং সমাজে ঘটমান অন্যায়-অপরাধের দরুন আসা বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের সবাইকে সাধ্যমতো সমাজের সর্বস্তরের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে এবং সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে যেকোন অপরাধ নিমুলে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আল্লাহ তাওফীক দিন!
মুহাদ্দিস-জামিয়া ইমদাদিয়া আরাবিয়া শেখেরচর,নরসিংদী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।