Inqilab Logo

শনিবার, ০৮ জুন ২০২৪, ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০১ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ব্যাংকের সিকিউরিটি বাড়ানোর পরামর্শ

প্রকাশের সময় : ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

অর্থনৈতিক রিপোর্টার : সাধারণ গ্রাহকের অর্থের সুরক্ষায় ব্যাংকগুলোকে আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সম্প্রতি এটিএম জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা খোয়ানো কয়েকজন গ্রাহক। গতকাল জালিয়াতির শিকার ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের (ইবিএল) গ্রাহকদের চেক হস্তান্তর অনুষ্ঠানে তারা এ পরামর্শ দেন। বাংলাদেশ ব্যাংকে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে ইবিএলের ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচজন গ্রাহকের হাতে চেক তুলে দেন ডেপুটি গভর্নর নাজনীন সুলতানা। ক্ষতিগ্রস্ত বাকী ১৯ জনের টাকা তাদের ব্যাংক হিসাবে জমা করে দেয়া হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নাজনীন সুলতানা বলেছেন, এতোদিন ব্যাংকগুলোর ফিজিক্যাল সিকিউরিটি ভেঙে টাকা চুরি বা ডাকাতি হয়েছে, এরপর লজিক্যাল সিকিউরিটিও ভাঙতে পারে। এজন্য ব্যাংকগুলোকে আরো সতর্ক হতে হবে। নাজনীন সুলতানা বলেন, এটিএম বুথে নিরাপত্তা সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনাগুলো যথাসময়ে পরিপালন করতে হবে। এই জন্য বর্ধিত কোনো সময় দেয়া হবে না। একই সঙ্গে জালিয়াতি রোধে গ্রাহকদের সচেতনতা বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়। তিনি বলেন, ইবিএল তাৎক্ষণিকভাবে ভিডিও ফুটেজ দেখলে হয়তবা ক্ষতি কম হতো বা চোরদের ধরা যেতো। তবে ভবিষ্যতে এব্যাপারে আরো সচেতন হতে হবে। এর থেকেও বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারতো। বর্তমানে ডিজিটালাইজড-এর অনেক সুবিধার পাশাপাশি কিছু সমস্যা থাকবেই। এ জন্য আমাদের ডিজিটাল সেবা থেকে দূরে সরে গেলে হবে না। আমাদের বেশি বেশি সচেতন গ্রাহক প্রয়োজন। আজকে ইবিএলের পদক্ষেপের কারণে গ্রাহকের মধ্যে আস্থা ফিরবে।
অনুষ্ঠানে ইবিএলের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান ও, রশীদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভংকর সাহা এবং পেমেন্ট সিস্টেম ডিপার্টমেন্টের মহাব্যবস্থাপক ইস্কান্দার মিয়া বক্তব্য রাখেন।
গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার গ্রাহকের অজ্ঞাতসারে অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলাসহ নানা ধরনের ‘ভূতুড়ে ট্রানজেকশনের’ ঘটনা ঘটার পর জালিয়াতির বিষয়টি বেরিয়ে আসে। জালিয়াত চক্র ইবিএল গ্রাহকদের কয়েক লাখ টাকা চুরি করেছে বলে অভিযোগ উঠে। একই কায়দায় ইবিএলসহ মোট চারটি ব্যাংকের ৩৬ জন গ্রাহকের হিসাব থেকে তুলে নেয়া হয় ২০ লাখ ৫৯ হাজার টাকা, যার মধ্যে ইবিএলেরই ২৪ জন গ্রাহকের ১৭ লাখ ৫৩ হাজার টাকা।
এটিএম বুথে স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে গ্রাহকের কার্ডের তথ্য চুরি করে এই জালিয়াতিতে এক বিদেশি নাগরিকের জড়িত থাকার তথ্য মেলার পর একই রকম চেহারার পাঁচ বিদেশির ওপর নজরদারি শুরু করে পুলিশ। যে পাঁচজন গ্রাহককে চেক দেয়া হয়েছে তাদের একজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সাংবাদিক মাহবুবা আক্তার ডিনা, যার ৮০ হাজার টাকা খোয়া যায় এটিএম জালিয়াতিতে।
অনুষ্ঠানে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ডিনা বলেন, দিনটি ছিল শুক্রবার। সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখি  মোবাইলে ইবিএলের এসএমএস। পড়ে দেখলাম আমার অ্যাকাউন্ট থেকে দুইবারে ৮০ হাজার টাকা তোলা হয়েছে। অবাক হলাম, আমি টাকা তুলিনি, কার্ড বাসায় রয়েছে, তাহলে টাকা তুলবে  কে?
সিস্টেম ভুল করে কোনো এসএমএস পাঠিয়েছে কি-না ভেবেছিলাম। কিন্তু অনেকগুলো টাকা হওয়ায় আবারও ভালো করে এসএমএস দেখলাম। এরপর ব্যাংকের কাস্টমার কেয়ারে ফোন করে অভিযোগ করলাম এবং আমার অ্যাকাউন্ট ব্লক করালাম। এ ধরনের জালিয়াতি রোধে তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংককে আরও সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, আমি সব ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বলব, আমরা সাধারণ আমানতকারী, আপনাদের কাছে আমরা অর্থ রাখি। এই ধরনের জালিয়াতি প্রতিরোধে আরও সতর্ক হওয়া দরকার। ক্ষতিগ্রস্ত অন্যরাও একই কথা বলেন। সাম্প্রতিক জালিয়াতির ঘটনা ঠেকাতে ব্যাংকগুলোর কিছু দুর্বলতা ছিল, এমনটা স্বীকার করার পাশাপাশি গ্রাহকদেরও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান ডেপুটি গভর্নর নাজনীন সুলতানা। তিনি বলেন, উন্নত বিশ্বেও জালিয়াতি হয়ে থাকে। সেই তুলনায় বাংলাদেশে জালিয়াতি কম।
তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের ব্যাংকিং খাতকে পেপারলেস করতে চায়। ইতিমধ্যে অনেক ডিজিটাইজেশন হয়েছে। বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে, আমাদেরও যেতে হবে। এ ধরনের ঘটনার জন্য প্রযুক্তি থেকে পিছিয়ে থাকলে চলবে না। তিনি সব ব্যাংককে এসএমএস অ্যালার্ট চালু এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে চলার আহ্বান জানান।
ইবিএলের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান ও, রশীদ এ ঘটনার জন্য গ্রাহকদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। একই সঙ্গে আমরা চেষ্টা করব ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে।
অনুষ্ঠানে শাহ সিফুজ্জামান এক লাখ ৬০ হাজার টাকা, কামরুজ্জামান ১০ হাজার টাকা, আবু মুসা তারেক ৫ হাজার টাকা ও দিপন চন্দ্র দে সাত হাজার টাকার চেক পেয়েছেন। এক সপ্তাহের মধ্যে বাকী তিনটি ব্যাংকও তাদের গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেবে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভংকর সাহা।
লেনদেনে একক সীমা নির্ধারণের উদ্যোগ বাংলাদেশ ব্যাংকের
এটিএম জালিয়াতির মাধ্যমে কয়েকটি ব্যাংকের গ্রাহকদের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার পর নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিভিন্ন পদক্ষেপের পাশাপাশি লেনদেন ব্যবস্থায় একক সীমা নির্ধারণের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি প্রতি লেনদেনের পর গ্রাহকের মোবাইলে এসএমএসে তা জানিয়ে দিতে ব্যবস্থা গ্রহণেরও উদ্যোগ রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বুধবার দেশে কার্যরত সব ব্যাংকের কার্ড ডিভিশনের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে এসব উদ্যোগের প্রস্তাব তুলে ব্যাংকগুলোর মতামত জানতে চান। ব্যাংকগুলোর মতামতের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
বর্তমানে একেক ব্যাংকের এটিএমে একেক রকম লেনদেনের সুযোগ রয়েছে। কোন ব্যাংক একবারে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা তোলা এবং সারাদিনে এক লাখ টাকা তোলার সুযোগ দিয়েছে। আবার কোনো ব্যাংক থেকে এক দিনে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা তোলার সুযোগ রয়ছে। কোনো কোনো ব্যাংকের এটিএম দিয়ে একবারে ২০ হাজার টাকার বেশি তোলারও সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভংকর সাহা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক চাচ্ছে সকল ব্যাংকের ক্ষেত্রে একবারে টাকা তোলা ও সারাদিনে সর্বোচ্চ কত টাকা তোলা যাবে তা একই হবে। তবে সেটা অবশ্যই গ্রাহক স্বার্থ বিবেচনা করে করা হবে। কারণ টাকা কম তোলার ব্যবস্থা হলে ঝুঁকি কম- এটা যেমন সত্য, তেমন গ্রাহকদের সেবাও কমবে। একই সঙ্গে আমরা ব্যাংকগুলোর মতামত চেয়েছি। তাদের মতামতের পরে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এছাড়া এটিএম জালিয়াতি রোধে সব এটিএম বুথে এন্টি স্কিমিং ডিভাইস বসানো, এটিএম বুথে কোনো যন্ত্র বসালে সার্ভিস যাতে জ্যাম হয়ে যায় এরকম ডিভাইস বসানো, ব্যাংকগুলোর মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ বাড়ানো, কর্মকর্তাদের সচেতনতা বাড়ানো, বুথের নিরাপত্তা প্রহরীদের আরও সতর্ক করা, সিসি ক্যামেরা মনিটরিং বাড়ানো, বুথে স্বচ্ছ কাঁচ ব্যবহার করা, কোন মহিলা গ্রাহক হিজাব পরে বুথে টাকা তুলতে আসলে বুথের দরজা খোলা রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
গত কয়েকদিনে এটিএম জালিয়াতির মাধ্যমে দেশের চারটি ব্যাংকের ৩৬ জন গ্রাহকের ২০ লাখ ৫৯ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে জানান শুভংকর।
ওই চারটি ব্যাংক হলো- সিটি ব্যাংক, ইউসিবিএল, ইবিএল ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক।
এই চারটি ব্যাংকের কয়েকটি বুথে ‘স্কিমিং ডিভাইস’ বসিয়ে কার্ডের তথ্য চুরি করে এই জালিয়াতি করা হয় বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে উঠে আসে। এভাবে প্রায় ১২ হাজার কার্ডের তথ্য চুরি হতে পারে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগ। ওই ১২ হাজার কার্ডের লেনদেন বন্ধ রেখে গ্রাহকদের নতুন কার্ড দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ব্যাংকগুলোকে।
এই জালিয়াতির ঘটনা কারা ঘটিয়েছে বা কোনো ব্যাংকের কর্মীরা জড়িত কি না জানতে চাইলে শুভংকর সাহা বলেন, আমরা ভিডিও ফুটেজে ছবি দেখেছি। নাম পরিচয় পাইনি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তদন্ত করছে। আমাদের সহযোগিতা চাইলে করব। এখনও পর্যন্ত কাউকে সনাক্ত করা গেছে কি না সে তথ্য আমাদের কাছে নেই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ব্যাংকের সিকিউরিটি বাড়ানোর পরামর্শ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ