Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নীরবে শিল্প বিপ্লব

| প্রকাশের সময় : ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মহসিন রাজু , বগুড়া থেকে : ৯০-এর রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর থেকে আড়াই দশকে মঙ্গা ও কৃষিজ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত উত্তরাঞ্চলে নীরবে শিল্প বিপ্লবই শুধু নয়, রীতিমত শিল্প বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। এ অভিমত এখন এই অঞ্চলের শিক্ষিত ও তুলনামূলক ভাবে তরুণ ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা,  ব্যবসায়ী, ব্যাংকার ও রাজনীতিবিদসহ সবার। বিশিষ্ট চেম্বার নেতৃবৃন্দ, নতুন শিল্পোদ্যোক্তা এবং বিশিষ্ট ব্যাংকারদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, কৃষি, চিকিৎসা, শিক্ষা সেক্টর ছাড়া শুধু শিল্প ও পর্যটন ক্ষেত্রেই আর্থিক বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক আগেই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
বগুড়ার প্রবীণ রাজনীতিবিদ সাবেক শিল্পোদ্যোক্তা, বগুড়া চেম্বারে কয়েক দফায় সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী বর্তমানে এফবিসিসিআইয়ের পরিচালকের দায়িত্বে নিয়োজিত আলহাজ্ব মমতাজ উদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেছেন, আড়াই তিন দশক আগেও উত্তরাঞ্চল সফরকালে বিদেশী ও অন্য এলাকার মানুষ মহাসড়কের দু’পাশে বেকার মানুষের জটলা কিংবা সবুজ শস্যক্ষেত দেখতে পেত। কিন্তু এখন সেই দৃশ্যপট বদলে গিয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে সিরাজগঞ্জ মোড় হয়ে মহাসড়কটি যখনই রংপুরমুীখ হয়েছে- তখন থেকেই রাস্তার দু’পাশে চোখে পড়ে বড় বড় শিল্পের অবকাঠামো চিহ্ন।
ইনকিলাবকে তিনি আরও বলেন, মাঝের রাজনৈতিক সহিংসতায় সড়ক-মহাসড়কে চলাচল ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় মারাত্মক বিঘœ সৃষ্টি হওয়ায় এই অঞ্চলের শিল্প-উৎপাদন, পণ্য পরিবহনে বিঘœ সৃষ্টি হওয়ায় নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিল্প-বাণিজ্য সেক্টর। কিন্তু সরকারের নির্দেশনায় প্রশাসন কঠোরভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করায় বর্তমানে শিল্প ও বাণিজ্য সেক্টর আবারও কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে। তিনি আশা করেন, শিল্পের বর্তমান এই বিকাশ ও বিনিয়োগের ধারা অব্যাহত থাকলে এই অঞ্চলেই লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হবে, রাজধানীমুখী জনস্রোতে ভাটা পড়বে। নিম্নমানের কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে উদ্যমী তরুণ-যুবকদের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা কমে আসবে । অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পাকিস্তান আমলেই শিল্প নগরীর তকমা পাওয়া বগুড়ায় ৭০ দশকে শিল্পের সরকারিকরণ ৮০’র দশকে বিরাষ্ট্রীয়করণ দুটো বিপরীতমুখী প্রক্রিয়াগত কারণেই বগুড়ার শিল্প সেক্টর প্রায় মরে যায়। বন্ধ ও বিক্রি হয়ে যায় বগুড়া কটনমিল, জামিল গ্রুপসহ অনেক বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান। এই সময়ে বগুড়া তথা উত্তরাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও ব্যবসাকেন্দ্রগুলো চলে যায় চোরাচালানীদের দখলে। এই অঞ্চলের অর্থনীতি পুরোটাই হয়ে পড়ে চোরাই ভারতীয় পণ্য নির্ভর বলে জানান হাল আমলের তরুণ ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাগণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্রে জানা যায়, ’৯০ দশকের পট-পরিবর্তনের পরে মুক্তবাজার অর্থনীতির আওতায় বগুড়া, ঈশ্বরদী, সৈয়দপুর, সান্তাহার, প্রভৃতি এলাকাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় গড়ে ওঠে আমদনীকারক চক্র। খুব দ্রুতই ভারত থেকে চালসহ সব নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী ভারত থেকে আমদানী চলতে থাকে। হিলি, সোনামুখি, বুড়িমারি বন্দর দিয়ে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কিছু আমদানীকারক রাতারাতি অঢেল বিত্তের মালিক বনে যায়। ’৯০ থেকে ২০০৬ সালের দুটি রাজনৈতিক দলের ধারাবাহিক শাসনের পর ২০০৭-০৮ সালের শাসন প্রান্তিকে কিছু সংস্কার পদক্ষেপের ফলে জয়পুরহাট, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও বগুড়াকে নিয়ে গঠিত কৃষি অঞ্চলে চাল, আলু, গম ও পিঁয়াজসহ অন্যান্য কৃষি পণ্যের বাম্পার ফলন হতে থাকে। ওই সময় থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকৃতির অকৃপণ আনুকূল্যে মাছসহ প্রধান প্রধান সব কৃষি পণ্যই বগুড়া অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত এলাকাটি এখন পুরোপুরি স্বয়ং সম্পূর্ণ বলে জানিয়েছেন বগুড়া কৃষি বিভাগীয় উপ-পরিচালক প্রতুল চন্দ্র।
বগুড়ার আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংকের সিনিয়র ম্যানেজার রাশেদুল ইসলাম নিজের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, বগুড়ায় সরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি এখন প্রায় সবক’টি বেসরকারি ব্যাংকেরই শাখা খোলা হয়েছে। নিশ্চয়ই এগুলো হাত গুটিয়ে বসে নেই। তারা ট্রেডিং-এর পাশাপাশি সব ধরনের শিল্প সেক্টরেই বিনিয়োগ করছে শত শত কোটি টাকা। অনুরূপ বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি পাওয়া গেল বিভাগীয় শহর রংপুরে একই ব্যাংকের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালনকারী কামরুল ইসলাম মাসুদের কন্ঠে।
বগুড়া চেম্বারের সভাপতি মাসুদার রহমান মিলন জানান, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প বিকাশের প্রধান শর্ত। গত কিছুদিন ধরে স্থিতিশীলতা বজায় থাকায় অর্থনীতির চাকা পজিটিভলি ঘুরছে বলে মন্তব্য করেণ তিনি। ব্যবসায়ী হিসেবে বগুড়া অঞ্চলে পরপর ২ বার সর্বোচ্চ ও শ্রেষ্ঠ করদাতার সম্মানে ভূষিত আলহাজ্ব লিয়াকত আলী এ প্রসঙ্গে ইনকিলাবকে বলেন, গতানুগতিকতার বাইরে বিভিন্ন শ্রমঘন শিল্পে বিনিয়োগের কথা এখন ভাবা উচিৎ। বিশেষত, এই এলাকার প্রাচীনত্ব প্রতœতাত্ত্বিক গুরুত্বের বিষয় মাথায় রেখে পর্যটন শিল্পের বিকাশে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য স্থানীয় বিনিয়োগ কারীদের সুযোগ করে দেওয়া উচিৎ বলেও মন্তব্য করেণ তিনি। পাশাপাশি ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের চলমান ‘ফোর লেন’ প্রকল্পের কাজ যত দ্রুত শেষ হবে এই এলাকায় উৎপাদিত শিল্প ও কৃষিপণ্য পরিবহনের কাজ তত সহায়ক হবে বলে জানান তিনি।
শিল্প-বাণিজ্যের তথা অর্থনীতির সব সেক্টরেই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের ফলে উত্তরাঞ্চলে দেশী-বিদেশী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নির্বিঘœ যাতায়াত ও আবাসনকে ঘিরেও উত্তরে তেঁতুলিয়া থেকে দক্ষিণে সিরাজ মোড় তথা বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাড় এলাকায় মহাসড়কের দু’ধারে এখন গড়ে উঠেছে দু’শতাধিক হাইওয়ে রেস্তোঁরা, হোটেল-মোটেল। বগুড়াতেই এখন থ্রী-ফোর- ফাইভ স্টার মানের হোটেলের সংখ্যা একাধিক। কোনো কোনোটিতে থাকছে সার্বক্ষণিক হেরিকপ্টার সার্ভিসের ব্যবস্থা। বগুড়া-রংপুর মহাসড়কে চালু হওয়া নতুন চালু হওয়া ফাইভ স্টার মানের হোটেল ‘মম ইনের’ ব্যবস্থপনা কর্তৃপক্ষ ইনকিলাবকে বলেন, তাদের এই প্রজেক্ট পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে এখানেই কয়েক শ’ শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থান হবে, যারা প্রাপ্য বেতন-ভাতায় উন্নত ভাবে জীবন-যাপনে সক্ষম হবে।
সপ্তাহ কাল সময় ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের বগুড়া আঞ্চলিক শাখা, বগুড়া, নওগাঁ, রংপুর ও গাইবান্ধা চেম্বার থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পোল্ট্রি, কৃষি-মৎস্য-ডেইরী, শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতের বাইরে হোটেল- মোটেল, বেকারী, অটোরাইস-ফ্লাওয়ার মিল, জুট-ব্যাগ, রাইস ব্রান-মাস্টার্ড ওয়েল, পোল্ট্রি-ডেইরী-ফিসমিল এবং মেটাল ইনিঞ্জনিয়ারিং সেক্টরে ইতোমধ্যেই বিনিয়োগের টাকার অংক হাজার কোটি ছাড়িয়ে গেছে। বগুড়ায় প্রতিষ্ঠিত বেশ কয়েকটি পেপার মিলের উৎপাদিত উন্নত মানের নিউজপ্রিন্ট কাগজেই এখন স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা ছাপা হচ্ছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারী ধরনের প্রকৌশল কারখানায় উৎপাদিত লৌহজাত পণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে সার্কভুক্ত দেশগুলোতেও রফতানী হচ্ছে। মোট কথা নীরবেই এই এলাকায় শুধু শিল্পের বিকাশই নয়, বরং বিস্ফোরণ ঘটে গেছে- যেখানে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরী হয়েছে। কর্ম সংস্থানের এই ক্ষেত্র ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন, বগুড়ার তরুণ রাজনীতিক,ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা আনোয়ার হোসেন রানা এলএলবি।



 

Show all comments
  • Mohammed Shah Alam Khan ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১:৩৫ এএম says : 0
    বগুড়ার মহসিন রাজুর লিখাটা পড়ে খুবই ভাল লেগেছে তাই মহসিন রাজু সাহেবকে অনেক ধন্যবাদ। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত এদিকে কেহ খেয়াল দেয়নি। এমনকি ১৯৯১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত এদিকে উল্লেখ্যযোগ্য কোন ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু এরপর উত্তর বঙ্গে শিল্পের নীরব বিপ্লব ঘটে যায়। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশ একদিন বিশ্বের উন্নত দেশ হিসাবে চিহ্নিত হবে এটা নিশ্চিত।
    Total Reply(0) Reply
  • Mukesh Biswas ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:৪০ পিএম says : 0
    It's a very good news for Bangladesh.
    Total Reply(0) Reply
  • সাগর ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:৪১ পিএম says : 0
    এতে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র ক্রমশ সম্প্রসারিত হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • মহিউদ্দিন আহমেদ ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:৪২ পিএম says : 0
    বাজনৈতিক স্থীতিশীল থাকলে এটা আরো প্রসারিত হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • জাহিদ হাসান ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:৪৩ পিএম says : 1
    শিল্পের বর্তমান এই বিকাশ ও বিনিয়োগের ধারা অব্যাহত থাকলে এই অঞ্চলেই লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হবে, রাজধানীমুখী জনস্রোতে ভাটা পড়বে।
    Total Reply(0) Reply
  • মামুন খান ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:৪৬ পিএম says : 0
    চোরাচালানী বন্ধ করতে পারলে এ অঞ্চলের আরো উন্নতি ঘটবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Jannatul Ferdaous ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:৪৭ পিএম says : 0
    onek din pore akta valo khabor sunlam. khub valo laglo
    Total Reply(0) Reply
  • ঝুমুর ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:৪৯ পিএম says : 0
    আশা করি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে এ অঞ্চলে কর্মসংস্থান আরো বাড়বে।
    Total Reply(0) Reply
  • Asma Akter ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:৪৯ পিএম says : 0
    Go ahead Bangladesh............................
    Total Reply(0) Reply
  • জুঁই ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:৫১ পিএম says : 0
    ভারতীয় পণ্যের রাহুগ্রাস থেকে পুরো দেশকে বাঁচাতে হবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ