Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাঙালিদের গাছ কাটছে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা

পাহাড়ে অশান্তির আগুন - ৩

| প্রকাশের সময় : ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ফারুক হোসাইন, পার্বত্য অঞ্চল থেকে ফিরে : ইসলাম ধর্মগ্রহণ করে রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাটের মিজানুর রহমানকে বিয়ে করেন মিনু ত্রিপুরা (এখন আয়েশা সিদ্দিকা বেগম)।
ইসলাম ধর্মগ্রহণ এবং বাঙালি ছেলেকে বিয়ে করার ফলে বিভিন্ন সময়ই তাকে হুমকী দিতে থাকে পাহাড়ি সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর স্থানীয় নেতারা। কথা না শোনায় গত ৮ নভেম্বর মিনু ত্রিপুরাকে (আয়েশা সিদ্দিকা) অপহরণ করে নিয়ে যায় ইউপিডিএফের সন্ত্রাসীরা। ইসলাম ধর্ম ত্যাগ ও বাঙালি ছেলেকে ছেড়ে দেয়ার শর্তে এবং যৌথবাহিনীর চিরুনী অভিযানে ২৪ ঘণ্টা পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু কথা না রাখায় ১১ নভেম্বর রাতের অন্ধকারে আয়েশার শ্বশুরের ৮২ হাজার আনারস গাছ কেটে রেখে যায় উপজাতি দুর্বৃত্তরা। পার্বত্য সমঅধিকার আন্দোলনের নানিয়ারচর উপজেলার নেতার মোঃ কবির হোসেন জানান, নানিয়ারচর উপজেলার ৩নং বুড়িঘাট মধ্যমপুলি পাড়ায় উথুইং মং মারমা ও অংসুই প্রু মারমার নেতৃত্বে একদল উপজাতি মধ্যরাতে জামাল সিকদার ও মধুমিয়ার আনারস বাগানে হানা দেয়। এসময় তারা দুই একর বাগানের সব ছোট-বড় আনারস কেটে ফেলে। ওই বাগানে ৮২ হাজার আনারস গাছ ছিল বলে তিনি জানান। এমনকি অব্যাহতভাবে তাদেরকে (আয়েশা ও মিজানুর রহমান) হত্যারও হুমকী দিচ্ছে সন্ত্রাসীরা। গত শনিবার রাতেই একই এলাকার পশ্চিম হাতিমারায় মঈনুল হোসেনের ৩০ হাজার আনারসের চারা তুলে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। নিজের জমি ওই এলাকার কারবারিকে (উপজাতি) এক ফসলের জন্য চাষ করতে দিয়ে আবার ফিরিয়ে নেয়ায় মঈনুল হোসেনের বাগান নষ্ট করা হয়েছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন। শুধু আয়েশা সিদ্দিকা-মিজানুর রহমান বা মঈনুল হোসেনই নয়, প্রতিনিয়তই পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি সন্ত্রাসের অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন কোন কোন বাঙালি পরিবার। বাঙালি ছেলের সাথে কোন উপজাতি মেয়ের সম্পর্ক, বিয়ে হলে কিংবা ঘনিষ্ঠতা হলেই হুমকীর পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয় তাদের। বাঙালিদের অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেয়া, ভয়-ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে পাহাড় ছাড়া করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই সন্ত্রাসী এমনটি করছে বলে জানিয়েছে ভুক্তভোগীরা। গোয়েন্দা সূত্রে তথ্যেও বলা হয়েছে, বারবার বাঙালিদের ফসল-গাছ কেটে ফেললে, ফসল চাষে বাধা দিলে কোন না কোন সময় বাঙালিরা পাহাড় ছাড়া হবে এমনটাই চিন্তা করে উপজাতি সন্ত্রাসীরা।
২০১৪ সালের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত এই দুই বছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় চার লাখ ৯৪ হাজারেরও বেশি গাছ কেটে ফেলেছে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা। যার সবগুলোই বাঙালিদের। এর কোনটির পেছনে রয়েছে বাঙালি-উপজাতি ছেলে-মেয়ের প্রেম বা বিয়ে, কোনটিতে চাঁদা না দেয়া। গত ১৪ নভেম্বর খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার ময়ূরখিলে ৮৪টি মশলা গাছ ও ৪টি আম গাছ কেটে ফেলে উপজাতি সন্ত্রাসীরা। ১৪ নভেম্বর খাগড়াছড়ির রামগড়ে যৌথ খামারে আড়াই হাজার পেঁপে গাছ, ৬শ’ কলা, ৩০টি লিচু ও ২০টি লেবু গাছ কেটে ফেলে, ২৮ আগস্ট বান্দরবানের আলীকদমে গাজী রাবার বাগানের ৬৯৩টি রাবার গাছ কাটা হয়, ২৭ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ির সিন্দুকছড়িতে কর্ণেল বাগানে ২শ’টি ফলের গাছ, ২৫ জানুয়ারি বান্দরবানের আলীকদমে এক হাজার ৯৬৭টি রাবার গাছ ও ৭টি আম গাছ কাটা হয়। আগের বছর ১৩ আগস্ট খাগড়াছড়ির লহ্মীছড়ির রেপাতলীতে ২০ হাজার রাবার গাছ ও ৫০টি কলা গাছ ও ১১ জানুয়ারি রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার জামতলীতে ৩৫ হাজার আনারস গাছ কেটে ফেলে দুর্বৃত্তরা। ২০১৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর একই উপজেলার বগাছড়িতে ৩ লাখ ফলন্ত আনারসের গাছ ও ২১ হাজার সেগুন গাছ কেটে ফেলা হয়। নির্ধারিত চাঁদা না দেওয়ায় গতবছর বান্দরবানের লামা উপজেলায় একটি রাবার বাগানের গোডাউন পুড়িয়ে দেয় জেএসএস-সন্ত লারমা গ্রুপের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। এরপরও চাঁদা না দিলে পুরো বাগান পুড়িয়ে দেয়ার হুমকী দেয়া হয়। গত আগস্টে রাঙামাটির বিলাইছড়িতে আয়না চাকমা নামে এক উপজাতি মেয়ে বাঙালি ছেলের দোকানে এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে গেলে তাকে তুলে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করে পিসিপি নেতা সুনীতিময় চাকমাসহ অন্যরা। অন্যদিকে বাঙালি ছেলের দোকান বন্ধ করে দিয়ে পার্বত্য এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয় সন্ত্রাসীরা। পুলিশ ধর্ষণের চেষ্টাকারীদের গ্রেফতার করলে তাদের মুক্তির দাবিতে দুই মাস ধরে বিলাইছড়ি বাজার বন্ধ করে রাখে, বিশেষ করে বাঙালিদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কোনভাবেই খুলতে দেয়নি উপজাতি সন্ত্রাসীরা।
শুধু গাছ কেটে বা দোকান বন্ধ ক্ষান্ত থাকছে না তারা। বাঙালি পাড়া বা সেনা-বিজিবি ক্যাম্প থেকে একটু দূরে বাঙালিদের জমি থাকলে সেখানে চাষাবাদও করতে দেয়া হয়না। চাষাবাদ করতে গেলে বাধা, ফসল পুড়িয়ে দেয়া এমনকি বাড়ি-ঘরও পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটছে। খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলার চেংড়াছড়ি গুচ্ছগ্রামে দেখা যায় এমন সন্ত্রাসের শিকার ৪শ’ পরিবার। যারা তাদের নামে সরকারের দেয়া ফসলি ও বসতি জমি হারিয়ে একটি গুচ্ছগ্রামে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। থাকার জায়গার অভাবে গরু, ছাগল এবং মানুষ বসবাস করছে একই ঘরে। স্থানীয়রা জানায়, ১৯৮১ সালে ৫৬টি পরিবারকে ওই এলাকার বিভিন্ন স্থানে বসবাসের জন্য খাস জমি বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু পাহাড়ি উপজাতিদের অব্যাহত বিরোধিতা ও আক্রমনের কারণে ১৯৮৮ সালে তারা সেই জমি ছেড়ে দিয়ে একত্রিত হয়ে গুচ্ছগ্রামে বসবাস করছেন। সে সময় ৫৬টি পরিবারকে ২৫ শতাংশ বসতি জমি এবং পৌনে চার একর চাষযোগ্য জমি দিয়ে পুনর্বাসিত করা হয়। ৩০ বছর পর সেই ৫৬ পরিবার এখন ৪০০ পরিবারে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ২৫ শতাংশ জমির মধ্যে এক শতাংশও বাড়েনি। অন্যদিকে চাষযোগ্য যে পৌনে চার একর জমি তাদের দেয়া হয়েছিল তা পাহাড়ে হওয়ার কারণে উপজাতিদের বাধা ও অপহরণের ভয়ে সেগুলোতে চাষ তো দূরের কথা পা পর্যন্ত ফেলতে পারেনা বাঙালিরা। কেউ বাধা ডিঙিয়ে চাষ করার কথা চিন্তা করলেই রাতের অন্ধকারে তাকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়।
গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা মুকুল হোসেন বলেন, ৩০ বছর আগে যে বসতি জমি দিয়েছিল এখন সেই জমিতের আমাদের পরিবারদের আর জায়গা হয়না। মানুষ বেড়েছে পরিবার বেড়েছে, কিন্তু জমিতো বাড়েনি। অন্যদিকে চাষের জন্য পাহাড়ে যে জমি দিয়েছে সেই জমিতে তো আমরা যেতেই পারি না। পুলিশের কাছে অভিযোগ এবং কোর্টের কাছে সুরাহা চাইলে বলা হচ্ছে নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করো।
৭০ বছর বয়সী মোঃ আব্দুল লতিফ বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের যে চাষের জমি দিয়েছিল সেখানে তো ভয়ে যেতে পারছি না। আর যে জমিতে প্রথমে বাড়ি করেছিলাম সেখানে শান্তিবাহিনীর অত্যাচারে ছেড়ে আসতে হয়। আবুল হাসেন বলেন, কুলারাম পাড়া, লেম্বু ছড়িতে প্রথমে তাদের বসবাস ছিল। যখন শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসের কারণে নিরাপত্তা দেয়া যাচ্ছিল না তখন ’৮৮ সালে এই গুচ্ছগ্রামে নিয়ে আসা হয়। তিনি বলেন, ’৮২ সালে বসবাস শুরু করার পর শান্তিবাহিনী অত্যাচার শুরু করে। রাতের বেলা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়, কাউকে কাউকে হত্যা করা হয়। ফায়ার করে ভীতি তৈরি করা হয়। গুচ্ছ গ্রামের প্রধান ও ১১ নম্বর সেক্টরের ২ এম এফ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল ইসলাম বলেন, ৫-৬টা গ্রাম থেকে সবাইকে এখানে নিয়ে আসা হয়। নিজের জমি থাকা সত্ত্বেও কোন চাষ-বাস করতে না পারায় পুরোপুরি রেশনের উপরই ভরসা করতে হয়। ৩০ বছর পরও আমরা নিজেদের জায়গায় যেতে পারছি না। তিনি বলেন, এখানে বাঙালিরা ভয়াবহ বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। গণতন্ত্র নাই, পদে পদে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। নিকৃষ্ট, খুনী, রাজাকারের জাতি স্বৈরতন্ত্রের মাধ্যমে পার্বত্য এলাকায় সন্ত্রাস চালাচ্ছে। আবার সরকারও নতজানু হয়ে তাদের সহযোগিতা করছে। আমাদের নিজেদের দেশে আমরা নাগরিক না, নতুন করে নাগরিক হতে হচ্ছে। বাঙালিদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতে বাধার পাশাপাশি পার্বত্য এলাকার উন্নয়নেও সব সময় বাধা দিয়ে আসছে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়েই হাদাছড়ি ও দেওয়ান পাড়ায় দুটি ব্রীজের টেন্ডার, অর্থ বরাদ্দ ও কাজ দেয়া হলেও ব্রীজ দুটির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। নির্মাণের সাথে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো জানায়, সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো চাঁদা না দিলে কাজ করতে দেয়া হবে না বলে জানায়। একটি, দুটি নয়, তিনটি সংগঠনই পৃথকভাবে চাঁদা দাবি করে। এমনকি ব্রীজের কাজ পরিদর্শন করার জন্য খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক যেতে চাইলে তাকে যেতে দেয়া হয়নি। পথে বাধা এবং প্রাণ নাশের হুমকী দিয়ে ফিরিয়ে দেয়া হয়।
রাঙামাটি জেলার এসপি সাঈদ তারিকুল হাসান বলেন, এভাবে বাগান ধ্বংস করে দৃষ্কৃতকারীরা এলাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করতে চায়। তবে আমরা সতর্ক আছি কোনভাবেই যেনো এধরনের ঘটনা না ঘটে এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে বিচারের আওতায় আনার চেষ্টা হচ্ছে।
সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার বলেন, বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলো সবসময় পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করে। বাগান কেটে, দোকান পুড়িয়েসহ নানাভাবে ইস্যু তৈরির মাধ্যমে পরিবেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা করছে তারা।



 

Show all comments
  • ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ২:২৭ পিএম says : 0
    পার্বত্য অঞ্চলে উপজাতি সন্ত্রাসীরা বাঙ্গালীদেরকে সীমাহীন অত্যাচার ও ব্যাপক ক্ষতি করতেছে যেকোন সময় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হতে পারে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পাহাড়ি সন্ত্রাসীর
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ