দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটিয়ে ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সর্বময় কর্তৃত্বভার গ্রহণ করেন এবং “গর্ভনর জেনারেল” উপাধি ধারণ করেন। মুর্শিদাবাদের নবাব বৃত্তিভোগী হয়ে সম্পূর্ণ ক্ষমতাচ্যুত হন। নবাবের ভাতা প্রথমে ছিল ৫৩ লক্ষ টাকা, পরে পরিমাণ কমে ৩২ লক্ষ এবং আরও পরে ১৬ লক্ষ টাকা হয়। নবাবের বৃত্তির পরিমাণ হ্রাস পাওয়ার সাথেসাথে তাঁর অধীনস্ত কর্মচারী, আশ্রিতজন ও অনুগ্রহভাজনের সংখ্যাও হ্রাস পায়। বিচার বিভাগে কিছুকাল মুসলমানদের প্রাধান্য ছিল বটে কিন্তু ক্রমে সেখানেও ইংরেজদের হাত পড়ে এবং উচ্চপদগুলো তারা গ্রাস করে। ১৭৯৩ সালে জমিদারির সংখ্যা ছিল ৩১৭ টি। ইংরেজ লেখক স্টিনকারের মতে, ১৮৫৮ সালে “সদর জমিদারীর সংখ্যা ৪৫৫০ টি। ইছামতি থেকে গঙ্গা পর্যন্ত এই সদর জমিদারীগুলি বিস্তৃত ছিল। এ গুলোর মালিক ছিলেন যথাক্রমে হিন্দু ৩৮৫৫টি (৮৫%), মুসলমান ৬৪৩টি (১৪%) এবং ইরোপীয়ন ৫২টি (১%)। মুসলমানদের জমিদারীগুলো বৃদ্ধি ছিল না। উপরন্তু এগুলো উত্তরাধিকারী আইনের ফলে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ফলে এককালের জমিদার কয়েক পুরুষের ব্যবধানে ভূমি-কৃষকে পরিণত হয়। মুসলমান আমলে লাখেরাজ বা নিষ্কর রায়তিস্বত্বের অধিকারী এক শ্রেণির ভূমি মালিক ছিলেন। সমাজের উচ্চ বংশীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, আধ্যাত্মিক নেতা ও জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি এসব লাখেরাজ সম্পত্তি ভোগ করতেন। ১৮১৮ সালে “নিষ্কর ভূমি বাজেয়াপ্ত আইনে” এসব সম্পত্তির অধিকাংশ মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যায়। ফলে বহু সম্ভ্রান্ত পরিবার দরিদ্র অথবা ধ্বংস হয়ে যায়।
উনিশ শতকের মুসলমানদের শেষ অবলম্বন ছিল রাজভাষা ফারসী। আদালতে ফারসী ভাষা চালু থাকায় বিচার বিভাগে অনেকে চাকুরীতে নিযুক্ত হতেন। কলিকাতা মাদ্রাসায় ফারসীতে মুসলমান আইন শিক্ষার ব্যবস্থা হয়। প্রথম দিকে সরকার মাদ্রাসার সার্টিফিকেট ব্যতিরেকে চাকুরীতে বহাল না করার নির্দেশ দিয়ে বিচার বিভাগের এই চাকুরীগুলোতে মুসলমানদের একচেটিয়া দখল বলবৎ রেখেছিলেন। লর্ড বেন্টিক ফারসী রহিত করে ইংরেজিকে রাজভাষা করেন। এ সময় ফারসী ভাষা রহিত করা হয় বটে, কিন্তু ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়নি। ১৮৬৪ সাল পর্যন্ত মুন্সেফগিরি ও উকিলগিরি পরীক্ষা উর্দু অথবা ইংরেজিতে দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। ফলে ইংরেজি শিক্ষার তাগিদ কমই ছিল। ইংরেজি ভাষা ও আধুনিক শিক্ষার অভাবে চাকুরীর ক্ষেত্রে অন্য সম্প্রদায়ের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেনি তারা; কোন কোন ক্ষেত্রে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আমলাদের ষড়যন্ত্রের ফলে চাকুরীলাভে বঞ্চিত হয়। এক্ষেত্রে খন্দকার ফজলে রাব্বির মন্তব্য উল্লেখ্য যোগ্য। তিনি বললেন ইংরেজি ভাষার বিরুদ্ধে পোষিত মুসলমানদের কুসংস্কার এবং সরকার চাকুরীর নতুন বিধি ব্যবস্থায় পূর্বের পদমর্যাদা থেকে অপসরণের ফলে মুসলমানরা দারিদ্র্য ও বিস্মৃতির গহ্বরে নিমজ্জিত হয়েছে। মুসলমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি-বাংলা শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। পরবর্তীকালে কলিকাতা মাদ্রাসায় ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থা হলেও মুসলমান ছাত্ররা ঐ ভাষা শিক্ষার জন্য আগ্রহ দেখায় নি। ফলে বিচার বিভাগে তাদের চাকুরীর ভিত ভেঙ্গে পড়ে। ১৮৪৪ সালে লর্ড হার্ডিঞ্জ নিয়ম করেন যে, যাদের ইংরেজি ডিগ্রি আছে, তারাই সরকারি চাকুরীতে অগ্রাধিকার পাবে। ইংরেজি জ্ঞান ছাড়া চাকুরীতে নিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় হিন্দুগন ইংরেজি শিক্ষায় অনেকদূর অগ্রসর হয়েছিল। অতএব অফিস-আদালতে তাদের চাকুরী হলো এবং মুসলমানরা পিছিয়ে পড়লেন। মুসলমানদের এমন দুঃসময়ে সবার আগে এগিয়ে আসেন নবাব আব্দুল লতিফ। বাংলার ছোটলাট স্যার জে.পি. গ্রান্টের নির্দেশক্রমে নবাব আব্দুল লতিফ ১৮৬১ সালে হুগলি মাদ্রাসা সম্পর্কে তদন্ত করেন এবং ঐ বছর ডিসেম্বর মাসে একটি সুচিন্তিত রিপোর্ট প্রদান করেন। ১৮৬৩ সালে আব্দুল লতিফ কোলকাতায় মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি স্থাপন করেন। ভারতের বড়লাট এলগীন তাকে উৎসাহিত করেন। আব্দুল লতিফের লক্ষ্য ছিল দুটি যথা- এক, মুসলমানদের প্রতি বিট্রিশ শাসক গোষ্ঠির সন্দেহ ও বিরূপ মনোভাব দূর করা। দুই, ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের দ্বারা ক্ষুদ্র, বঞ্চিত, পশ্চাদপদ মুসলমানদের সরকারের প্রতি অনুগত করে তোলা। তিনি ১৮৫৩ সালে ১০০ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করে একটি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার আহ্বান করেন। প্রবন্ধের বিষয় ছিল “ভারতের বর্তমান অবস্থায় মুসলমান ছাত্রের জন্য ইংরেজি মাধ্যমে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান শিক্ষার উপকারিতা এবং সে শিক্ষার গ্রহণযোগ্যতা”। ইংরেজি শিক্ষার পক্ষে-বিপক্ষে অনেক প্রবন্ধ এসেছিল। বোম্বাই এর জনৈক আরবি-ফারসি শিক্ষক সৈয়দ আব্দুল ফাত্তাহ ইংরেজি শিক্ষার পক্ষে প্রবন্ধ লিখে পুরস্কার পান। সোসাইটির মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতের মুসলমানদের মধ্যে ইংরেজি ভাষার ও পাশ্চাত্য বিজ্ঞান শিক্ষার বিস্তার করা। নবাব আব্দুর লতিফের পরে সৈয়দ আমীর আলীর আবির্ভাব হয়। ১৮৭৭ সালে তিনি সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান এসোসিয়েশন গঠন করেন। (চলবে)
লেখক: প্রভাষক, সরকারি ই¯াহানী ডিগ্রি কলেজ, কেরাণীগঞ্জ, ঢাকা
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।