পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
মোঃ ফজলুর রহমান, হবিগঞ্জ থেকে : হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রামে নিহত ৪ শিশুর পরিবারের কান্না কোনো কিছুতেই থামছে না। এই নৃশংস ঘটনায় ওই গ্রামের মানুষসহ পুরো উপজেলার মানুষও শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছেন। সুন্দ্রাটিকি গ্রামজুড়ে বিরাজ করছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। ৪ শিশু হত্যার ঘটনায় গতকাল আরো ৩ সন্দেহভাজনকে আটক করা হয়েছে। এরা হচ্ছে সুন্দ্রাটিকি গ্রামের আব্দুল আলী বাগালের অপর ছেলে রুবেল মিয়া, একই গ্রামের আরজু মিয়া ও বশির মিয়া। এ নিয়ে মোট গ্রেফতারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ জনে। এর আগে গত বুধবার রাতে আব্দুল আলী বাগাল (৬২) ও তার ছেলে জুয়েলকে (২৫) গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃত আব্দুল আলী বাগার ও তার ছেলে জুয়েলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে।
সরেজমিনে ঘটনাস্থলসহ পুরো উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, জনগণ ক্ষোভ ও ঘৃণা জানাচ্ছেন হত্যাকারীদের প্রতি। গ্রামবাসীসহ স্বজন-পরিজনদের মন্তব্য Ñ ৪ অবুঝ শিশুর লাশ উদ্ধারের পর পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা দু’দিন ধরে লক্ষণীয়। কিন্তু নিখোঁজের ঘটনার পরপরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হলে ৪ শিশুকে লাশ হতে হতো না। বিশেষ করে বাহুবল পুলিশের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে নিহতের পরিবারসহ এলাকাবাসীর নিকট। কারণ নিখেঁাঁজের পর শিশুর বাবা বাহুবল থানায় গেলে ওসি সাহেব জিডি গ্রহণ না করে তাদের বলেন, ‘আল্লাহ আল্লাহ করেন আর তসবি পড়েন। খুঁজতে থাকেন মেলা-বান্নীতে।’ লাশ পাওয়ার আগের দিন বাহুবল থানার ওসি তাদের খবর দিয়ে থানায় নিয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণ করেন। আর লাশ পাওয়ার পর থেকে বাহুবল থানার ওসি প্রায় সার্বক্ষণিক অবস্থান করছেন সুন্দ্রাটিকি গ্রামে। এভাবে আগে তৎপর হলে শিশুদের প্রাণ কেড়ে নিতে পারত না পাষ-রা। সন্তানহারা হতো না তাদের মা-বাবা। শোকে মাতম আর কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে নিহত শিশুদের বাবা-মা, দাদা-দাদি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাদের চিকিৎসার জন্য গতকাল বিকেলে ডাকা হয়েছে চিকিৎসক।
সরজমিনে বৃহস্পতিবার সুন্দ্রাটিকি গ্রামে নিহতদের বাড়িতে গিয়ে শোনা যায় কান্নার রোল। নিহত শিশুদের মা-বাবার কান্নার আওয়াজে বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। নিহত মাদরাসা ছাত্র ইসমাইলের মা মিনারা বেগম বারবার অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন। স্বজনরা মাথায় পানি ঢেলে সান্ত¦Íনা দিচ্ছেন। এদিকে নিহত শিশু জাকারিয়া আহমেদ শুভ (৮) তার চাচাতো ভাই মনির মিয়া (৭) ও তাজেল মিয়ার (১০) বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় একই দৃশ্য। তাদের মা-বাবার কান্না কিছুতেই যেন থামছে না।
শিশুদের দাদি মরম চান (৭০) নাতিদের স্কুলের বই বুকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। বারবার বলছেন, কী দোষ ছিল আমার নাতিদের? কোন অপরাধে হত্যা করা হলো ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুগুলোকে। নিহত ৪ শিশুকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। বুধবার বিকেলে ৪ শিশুর ময়নাতদন্ত শেষে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. দেবাশীষ দাশ এ তথ্য জানান। তিনি জানান, শিশুদের গায়ে একাধিক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তবে এগুলো কোনো ধরনের অস্ত্রের আঘাত নয়। এ আঘাতকে আমরা ভোঁতা আঘাত বা লিলা পোলা হিসেবে আখ্যায়িত করি।
গত বুধবার সকালে বাহুবলে নিখোঁজ হওয়ার ৪ শিশুর লাশ ৬ দিন পর পার্শ্ববর্তী বালুমহাল থেকে মাটিচাপা অবস্থায় উদ্ধার করেছে পুলিশ। তবে নিহতদের স্বজন ও আত্মীয়-স্বজনদের দাবি এটি পরিকল্পিত হত্যাকা-। তাদের পরিবারের বংশ ধ্বংস করতেই শিশুদের হত্যা করা হয়েছে। নিহতরা হলো বাহুবল উপজেলার ভাদেশ্বর ইউনিয়নের সুন্দ্রাটিকি গ্রামের মোঃ ওয়াহিদ মিয়ার ছেলে জাকারিয়া আহমেদ শুভ (৮), তার চাচাতো ভাই আব্দুল আজিজের ছেলে তাজেল মিয়া (১০) ও আবদাল মিয়ার ছেলে মনির মিয়া (৭) এবং তাদের প্রতিবেশী আব্দুল কাদিরের ছেলে ইসমাঈল হোসেন (১০)।
শুক্রবার বিকালে খেলার করার সময় নিহত ৪ শিশু নিখোঁজ হয়। এর পর বাহুবল থানা পুলিশকে প্রাথমিকভাবে জানানো হলেও তারা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। পরদিন শনিবার নিহত শুভর বাবা ওয়াহিদ মিয়া বাদী হয়ে বাহুবল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। এরপর থেকে পুলিশের একাধিক টিম মাঠে নামে। পরে সোমবার হবিগঞ্জ পুলিশ সুপার জয়দেব কুমার ভদ্র শিশুদের সন্ধানের জন্য ২০ হাজার টাকার পুরস্কার ঘোষণা করেন। তাতেও কোনো ধরনের কাজ না হওয়ায় মঙ্গলবার রাতে এক শিশুর বাবা অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে বাহুবল থানায় একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেন। বুধবার সকালে স্থানীয় লোকজন সুন্দ্রাটিকি গ্রামের উত্তরপাড় এলাকায় বালু মহালে মাটির ওপর তাদের হাত-পা দেখতে পেয়ে পুলিশকে খবর দেয়। খবর পেয়ে বাহুবল থানা, পুলিশ, ডিবি পুলিশ র্যাবসহ ও সিআইডির একাধিক টিম ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। দুপুরে ঘটনাস্থলে ছুটে যান সিলেটের ডিআইজি মিজানুর রহমান, পুলিশ সুপার জয়দেব কুমার ভদ্র, জেলা প্রশাসক সাবিনা আলম ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ওইদিন দুপুরের দিকে পুলিশ স্থানীয় শ্রমিকদের সহযোগিতায় মাটির নিচ থেকে শিশুদের লাশ উদ্ধার করে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করেন।
পরিকল্পিত হত্যাকা- : নিহতের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনরা দাবি করেন পূর্বশত্রুতার জেরে তাদের শিশুদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। নিহত মনিরের বাবা আব্দাল মিয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, পার্শ্ববর্তী এলাকার মাতব্বর আব্দুল আলী ও বাচ্চু মিয়া তাদের ৪ শিশুকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। অবিলম্বে তাদের গ্রেফতার করে ফাঁসির মাধ্যমে বিচার দেখতে চান তিনি।
নিহত মনিরের মা বানেছা বেগম জানান, তাদের বংশকে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পিতভাবে প্রতিপক্ষের লোকজন ওই ৪ শিশুকে হত্যা করেছে। ঘটনার সাথে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করার জন্য তিনি প্রশাসনের কাছে দাবি জানান।
নিহত শুভর বাবা ওয়াহিদ মিয়ার অভিযোগ, নিখোঁজ হওয়ার পর বাহুবল থানা পুলিশকে খবর দেয়া হলেও তারা কোনো কর্ণপাত করেনি। উল্টো তাদেরকে মিলাদ ও দোয়া-দরুদ পড়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন পুলিশ দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে পাষ-রা ওই ৪ শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করতে পারত না।
শুভর চাচা ফরিদ মিয়া জানান, পার্শ্ববর্তী এলাকার মাতব্বর আব্দুল আলীর সাথে সম্প্রতি একটি বড়ই গাছ নিয়ে সংঘর্ষ হয়। এর জের হিসেবেই তাদের সন্তানদের হত্যা করা হয়েছে। তিনি গ্রেফতারকৃত আব্দুল আলী, জুয়েল ও জড়িত বাকিদের দ্রুত গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
স্থানীয় কয়েকজন শ্রমিকের সহযোগিতায় পুলিশ গত বুধবার প্রায় এক ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে মাটির নিচ থেকে একে একে ৪ শিশুর লাশ উদ্ধার করে। এ সময় পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে কয়েক ব্যক্তির জুতা ও একটি চাবি উদ্ধার করে। পুলিশের ধারণা উদ্ধারকৃত জুতা ও চাবির মাধ্যমে তারা হয়তো ঘটনার সাথে জড়িত চক্রকে খুঁজে বের করতে পারবে।
ভয় ও আতঙ্ক : ঘটনার পর থেকেই এলাকাবাসী ভয়ে ও আতঙ্কে রয়েছে। সকল বাড়িতে নীরবতা ও শোকের মাতম চলছে। নিহতদের সান্ত¦না দেয়ার জন্য ভাষা নেই গ্রামবাসীর। সবার মাঝেই এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-ের পর ভয়, আতঙ্ক ও ক্ষোভ বিরাজ করছে।
এলাকাবাসীর বক্তব্য : চাঞ্চল্যকর ৪ শিশু হত্যাকা-ের ঘটনায় এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত। তাদের দাবি যারাই ঘটনার সাথে জড়িত তাদের সকলকে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
দাফন সম্পন্ন : নিহত ৪ শিশুর ময়নাতদন্ত শেষে পুলিশ বুধবার সন্ধ্যায় লাশগুলো তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে। এরপর রাত সাড়ে ৯টার দিকে গ্রামে একসাথে ৪ শিশুর জানাজা শেষে কবরস্থানে দাফন করা হয়। জানাজাতে স্থানীয় লোকজনের পাশাপাশি আশপাশের গ্রামের কয়েক হাজার মুসল্লি অংশগ্রহণ করেন।
আজ যাচ্ছেন প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি
সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি অ্যাডভোকেট আমাতুর কিবরিয়া কেয়া চৌধুরীর আহ্বানে আজ শুক্রবার সকালে বাহুবল উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রামে পরিদর্শনে আসবেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি। হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক সাবিনা আলম জানান, প্রতিমন্ত্রী হবিগঞ্জে আসবেন বলে তাকে টেলিফোনে জানিয়েছেন।
হবিগঞ্জে ক্ষোভ ও মানববন্ধন
সুন্দ্রাটিকির ঘটনায় হবিগঞ্জে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে কমিউনিস্ট পার্টিসহ বিভিন্ন সংগঠন। বৃহস্পতিবার দুপুরে হবিগঞ্জ আদালত প্রাঙ্গণে মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি হবিগঞ্জ জেলা শাখা। এ সময় বক্তব্য রাখেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা পীযূষ চক্রবর্তী, হাবিবুর রহমান, বাসদ নেতা নুরুল হুদা শিবলি, অ্যাডভোকেট জুনায়েদ মিয়া ও মাহমুদা খাঁ। বৃহস্পতিবার দুপুরে সরকারি বৃন্দাবন কলেজসংলগ্ন সড়কে তারুণ্য সোসাইটি কর্তৃক মানববন্ধন পালন করা হয়।
তারুণ্য সোসাইটির উপদেষ্টা শাহ রাজিব আহমেদ রিংগনের সভাপতিত্বে ও সংস্কৃতিকর্মী শেখ ওসমান গনি রুমীর সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন বৃন্দাবন সরকারি কলেজের অধ্যাপক আব্দুল হাকিম, অধ্যাপক আবদুল হামিদ, অধ্যাপক জামাল আহমেদ, ওয়ার্ড কাউন্সিলর জুনায়েদ আহমেদ, শাহ জাকারিয়া মোঃ শাহিন, বৃন্দাবন সরকারী কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক রুবেল আহমেদ চৌধুরী, কলেজ ছাত্রলীগের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজ আহমেদ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের জেলা সংগঠক শফিকুল ইসলাম, ছাত্র সমন্বয় পরিষদের সভাপতি সুলতান মাহমুদ, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির জাকারিয়া রুবেল, জেলা ছাত্রলীগ নেতা মামুন আহমেদ, সারোয়ার আহমেদ, কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের আহ্বায়ক স্মরিন নওশীন দিনা প্রমুখ। বক্তারা ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সকল আসামিকে গ্রেফতারের আল্টিমেটাম দেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।