পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টালিন সরকার : ক্ষমা করো তাজেল, শুভ, মনির, ইসমাঈল। পৃথিবীকে বোঝার আগেই ভয়ঙ্কর হিং¯্র নির্মমতার বলী হতে হলো। দেশ তোমাদের স্বপ্ন দেখা দূরে থাক, নিরাপত্তা পর্যন্ত দিতে পারেনি। কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তামাম বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছেন এই বলে যে, ‘এসেছে নতুন শিশু,... ছেড়ে দিতে হবে স্থান/জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ... পিঠে/চলে... /...তবু আজ যতক্ষণ দেহে... /প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল/এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি/নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ তোমাদের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে কবি জঞ্জাল সরানোর অঙ্গীকার করলেও রাজনৈতিক কপটতা-হিং¯্রতা, মানবিক মূল্যবোধের অভাব, সামাজিক মূল্যবোধে ধস, নৈতিক অবক্ষয়ে এখনো সম্ভব হয়নি। সিলেটের রাজনের গগনবিদারী কান্না, খুলনার পিপাসার্ত রাকিবের পানি পানের আকুতি, বরগুনার আমতলীর রবিউলের ছটফটানি, মাগুরায় পৃথিবীতে আসার আগেই মায়ের পেটে থাকা গুলিবিদ্ধ সুরাইয়ার নীরব যন্ত্রণা, চাঁদপুরের সুমাইয়ার ওপর বর্বর নির্যাতন, রাজশাহীর পবার জাহিদ ও ইমনের আহাজারি কান পাতলে বাতাসে এখনো শোনা যায়। তোমাদের বাঁচতে না দিয়ে হন্তারকরা নিষ্ঠুরভাবে খুন করল! পৃথিবীকে বুঝে ওঠার আগেই তোমাদের এই পরিণতির জন্য দায়ী কারা? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনের শাসনের অনুপস্থিতি ও সমাজে নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে এমন হচ্ছে। সে দায় কার? রাষ্ট্রের, রাজনীতিকদের, সুশীল সমাজের নাকি ইসলামবিদ্বেষী পাপাচারে লিপ্ত তথাকথিত আকাশসংস্কৃতির?
বন্ধই হচ্ছে না শিশু হত্যা-নির্যাতন। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো প্রান্ত থেকে আসছে শিশু খুনের মর্মন্তুদ সংবাদ। কোথাও নির্যাতন কোথাও খুন। ঘর আলো করে আসা সন্তানদের নিয়ে মা-বাবার রঙিন স্বপ্ন হচ্ছে তছনছ। শিশুদের জন্য আমাদের দেশ কি সত্যিই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে? নিষ্পাপ শিশুরাই যেন হয়ে গেছে টার্গেট। রাজনৈতিক হানাহানি, পারিবারিক-সামাজিক বিরোধ, জমিজমা নিয়ে দ্বন্দ্ব, মুক্তিপণ আদায় Ñ সবকিছুতেই টার্গেট হচ্ছে শিশুরা। জন্মের পর পাওয়া-না পাওয়ার দ্বন্দ্ব এবং সম্পর্কের জটিল সমীকরণ বোঝার আগে শিশুদের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে ঘাতকরা। শিশুর ওপর বর্বরোচিত নির্যাতন এবং একের পর এক শিশু খুন হলেও যেন কারও ঘুম ভাঙছে না। দায়িত্বশীলদের বিবেকে ‘ঘা’ লাগছে না। শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, গত ১৩ মাসে সারাদেশে ৩২১ শিশুকে হত্যা করা হয়। চলতি বছরের জানুয়ারির ২৯ দিনে হত্যা করা হয়েছে ২৯ জনকে। এ ছাড়া ২০১৫ সালে ২৯২ শিশুকে অপহরণ করা হয়। তাদের মধ্যে ১৬৭ শিশুকে জীবিত উদ্ধার করা গেলেও মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ৪০ জনকে। অন্যদের খোঁজ মেলেনি। শিশুহত্যার এসব ঘটনাকে মূল্যবোধের বিপর্যয় হিসেবে দেখছেন বিশিষ্টজনেরা। তাদের মতে, এ ধরনের নিষ্ঠুরতা বিচারহীনতার সংস্কৃতি, অপরাধীদের বিকৃত মনোভাব এবং বর্তমান সমাজে শিশুদের অসহায় অবস্থার চিত্রই তুলে ধরছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারম্যান এমরানুল হক চৌধুরী বলেন, এ ঘটনা সমাজে শিশুদের অসহায় অবস্থার সার্বিক চিত্র। সুশাসনের অভাব ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়াও এমন অপরাধ সংঘটন হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, শিশু নির্যাতন-হত্যা আগ্রাসী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। আকাশসংস্কৃতির কুপ্রভাব অনেকের মধ্যে নেতিবাচকভাবে পড়ছে। কেউ আবার স্বল্প সময়ে অনেক টাকা-পয়সার মালিক হতে চায়। সামাজিক কাঠামোর মধ্যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি ঢুকে পড়ায় শিশু হত্যা করেও অনেকে পার পেয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপিকা মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী বলেন, শিশুহত্যার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা দেশে দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়া আতঙ্কজনক। প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বেপরোয়া মানুষের মধ্যে পাশবিক প্রবৃত্তি উৎকট হচ্ছে। শিশুদের মধ্যে কোনো ক্ষতিকর মানসিকতা নেই। কিছু মানুষ নিজের হীনস্বার্থে শিশুদের হত্যা করছে।
শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, সারাদেশে প্রায় প্রতিদিন গড়ে ঝরে পড়ছে একটি কোমলমতি অবুঝ শিশুর প্রাণ। এর বাইরেও অনেক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। শিশুহত্যা ঠেকাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। কেরানীগঞ্জের আলোচিত শিশু আব্দুল্লাহ হত্যাকা-ের ঘটনায় জড়িত মোতাহার র্যাবের কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। এলাকার মানুষ হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে তীব্র আন্দোলন করায় গত বছরের আলোচিত দুই ঘটনা সিলেটের শিশু রাজন হত্যা ও খুলনায় শিশু রাকিব হত্যায় দ্রুত বিচার শেষে আদালত খুনিদের ফাঁসির আদেশ দিয়েছে। এটা দৃষ্টান্ত। এমন দৃষ্টান্ত স্থাপনেও কমছে না শিশুদের ওপর নির্মমতা। কয়েকজন সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে এ প্রসঙ্গে আলোচনা করলে তারা জানান, সমাজে অস্থিরতা বিরাজমান। এ অবস্থায় শিশু হত্যাকা- বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো শিশুদের সহজেই টার্গেট করা যায়। নানারকম প্রলোভন দেখিয়ে শিশুদের অপহরণ করা সহজ। আর শিশুরা নিজ পরিবারের অন্যতম প্রধান মূল্যবান ধন। বাবার আদর আর মায়ের বুকের ধন। তাদের মাধ্যমে সহজেই পরিবারকে কাবু করা যায়। এ কারণে পরিবার বা বাবা-মায়ের প্রতি প্রতিশোধ নিতে বা অপহরণ করে টাকা আদায়ের নিমিত্তে শিশুদের টার্গেট করা হচ্ছে। এছাড়া মেয়েশিশুরা শিকার হচ্ছে ধর্ষণের। ধর্ষণের পর ধর্ষকের পরিচয় ফাঁস হওয়ার আশঙ্কা থাকায় অনেক ক্ষেত্রে হত্যা করা হয়। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গণতন্ত্রহীনতা এবং রাজনৈতিক সহিংসতার বিষবাষ্প সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়ায় সমাজে এখন চরম নৈরাজ্যকর অবস্থা চলছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জনতার চাপে সিলেট ও খুলনার আলোচিত দুটি ঘটনার দ্রুত বিচার সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ঘটনার তদন্ত ও বিচার বছরের পর বছর ঝুলে আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কারণে খুনিরা পার পেয়ে যায়। পার পায় অর্থের বিনিময়েও। আবার গরিব পরিবারকে অর্থ দিয়ে খুনিরা আপস করারও চেষ্টা করে অনেক ক্ষেত্রে। এটা বন্ধ করতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপের পাশাপাশি সমাজের সব স্তরের মানুষকে দায়িত্বশীল হতে হবে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয়ভাবে শিশু অধিকার নিশ্চিত করা উচিত।
রাজনৈতিক অস্থিরতায় আইন তার নিজস্ব গতিতে না চলায় অপরাধীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। নারায়ণগঞ্জের ত্বকি হত্যা তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। তাছাড়া রাজনৈতিক ভেদাভেদের কারণে পারিবারিক, সামাজিক ও ব্যক্তিপর্যায়ের নৈতিকতার অবস্থা এমনই নিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মানুষ এখন কোনো ধরনের অপরাধ, পাপাচার, নৈতিকতাবিবর্জিত কাজ করতে সংকোচ করছে না। এছাড়া শিশুহত্যা শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্ব না দেয়া ও নৈতিকতার শিক্ষার প্রতি অবজ্ঞার পাশাপাশি বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের ডিজিটাল যুগের কুফল হতে পারে। আবার পারিবারিক বন্ধন দিন দিন শিথিল হয়ে আসায় অভিভাবক, শিক্ষক, আত্মীয়-স্বজন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ায় শিশুরা ঠিকভাবে নৈতিক শিক্ষা পাচ্ছে না। আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ। পরিবার, সমাজ সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও নৈতিকহীনতার রাহুগ্রাস এমন পর্যায়ে গেছে যে মানুষ পশুর চেয়েও হিংস্র ও নির্মম আচরণ করছে। অথচ এখন পর্যন্ত শিশু অধিকার রক্ষার বাধ্যবাধকতার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে শিশুর অধিকার নিশ্চিতকরণসহ শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ও দমনে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্থা গড়ে ওঠেনি। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে শুধু শিশু একাডেমি আছে। সেখানে শুধু শিশুদের শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বিকাশে কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করে থাকে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সমাজসেবা অধিদপ্তর এতিম শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে কাজ করে থাকে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শিশুদের স্বাস্থ্যবিষয়ক কার্যক্রম করে। শিশুর বিরুদ্ধে যে কোনো অপরাধ বা সহিংসতার ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ বিভাগ ও বিচার বিভাগ অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিশুদের শিক্ষার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে। শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা হলেও কখনো এ মন্ত্রণালয়ের কার্যপরিধি ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। এমনকি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন কার্যকর সক্ষম শিশুবিষয়ক অধিদপ্তরের মতো কোনো প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়নি। এতে বোঝা যায়, শিশুদের প্রতি রাষ্ট্রীয়ভাবে কত অবহেলা হচ্ছে। সম্প্রতি শিশুদের প্রতি চরম নিষ্ঠুরতা, খুন ও সহিংস ঘটনা জাতির বিবেকের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে। তবে এটা ঠিক শিশুর প্রতি নিষ্ঠুর ও পৈশাচিক মনোভাবসম্পন্ন মানব-পশু এই সমাজে একদিনে সৃষ্টি হয়নি। পরিণত বয়সে আজকের শিশু নির্যাতনকারী হন্তারকরা একদিন শিশু ছিল। আর শিশু মানেই তো নিষ্পাপ মানব। তারা তখন সে শিক্ষা পায়নি। সমাজ, পরিবার তথা রাষ্ট্র সঠিকভাবে তাদের দায়িত্বসম্পন্ন মানবিক গুণাবলী সম্বলিত মানুষে পরিণত করতে পারেনি। যার জন্য তাদের মনে বীভৎসতা জন্ম নিচ্ছে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘আমি চেয়ে আছি তোদের পানে রে ওরে ও শিশুর দল/নতুন সূর্য আসিছে কোথায় বিদারিয়া নভোতল।’ জাতীয় কবির এই পঙ্ক্তির মতোই শিশুদের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্র কার্যকর কর্মপন্থা গ্রহণ করবে সেটাই প্রত্যাশা। দেয়ালে যেভাবে পিঠ ঠেকে গেছে হয়তো আগামীতে শিশুদের অধিকার রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দায়িত্বশীলরা বাধ্য হবেন। তখন তাজেল, শুভ, মনির, ইসমাঈলের মতো শিশুদের বেঘোরে প্রাণ হারাতে হবে না। রাজশাহীর জাহিদ হাসান ও ইমন আলীর মতো শিশুদের বীভৎস নির্যাতন সহ্য করতে হবে না। কাজেই গত ১৩ মাসে অকালে ঝরে যাওয়া শিশুদের কাছে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।