Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রশ্ন: মাদ্রাসার বর্তমান সিলেবাসের উপযোগিতা প্রসঙ্গে চিন্তা করা কি উচিত নয়?

| প্রকাশের সময় : ১৯ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

উত্তর: শুনা যাচ্ছে মাদ্রাসার কেন্দ্রীয় (পাবলিক) পরীক্ষা মাত্র আরবী ১০০ নম্বরের ১টি বিষয়ের পরীক্ষা হবে। তাছাড়া আরবী অন্য বিষয়গুলোর পরীক্ষা হবে না, শিক্ষকরা মুল্যায়ন নম্বর দিবে, বাকি সাধারণ বিষয়গুলোর পরীক্ষা হবে। পাঠ্য বই সমুহের বিভিন্ন গল্প, কবিতা, মুর্তির ছবি নিয়ে ওলামা মাশায়েখ ও পীর সাহেবগণ প্রতিবাদ করছেন, উনারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন। আমি তাই সে বিষয়ে কিছু লিখবো না। মাদ্রাসা শিক্ষার মুল উদ্দেশ্য ও অতীতে এ শিক্ষার অবস্থা সম্পর্কে কিছু লিখবো। আমি আমার গ্রামের পাশের মন্তলী রহমানিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেছি, একই মাঠের এক পাশে মাদ্রাসাটি এবং অপর পাশে ছিল মন্তলী স্কুল এন্ড কলেজ। বর্তমানে স্কুলটি সামান্য সরিয়ে দুটি প্রতিষ্ঠানের মাঠ আলাদা করা হয়েছে। উভয় প্রতিষ্ঠানের কোনটিতে ছাত্র সংখ্যা কম নেই। যদি প্রশ্ন করা হয় পাশাপাশি স্কুল মাদ্রাসা হওয়ার পর ও মানুষ তার সন্তানকে মাদ্রাসায় কেন ভর্তি করাচ্ছে? উত্তর আসবে ভালো আলেম হওয়ার জন্য। আলেম বানানোর ইচ্ছা না থাকলে অবশ্যই স্কুলে ভর্তি করাতো। দুনিয়াবি চাহিদা অনুযায়ী আধুনিক শিক্ষার সাথে পরিচিত হতে যতটুকু না হলে নয় এর বেশি সাধারণ শিক্ষার বোঝা মাদ্রাসায় না চাপিয়ে ভালো আলেম হওয়ার উপযোগী সিলেবাস প্রণয়ন আবশ্যক। সাত অন্ধ হাতি দেখতে গিয়ে যে অঙ্গ যিনি ধরেছেন তিনি হাতিকে সেরূপই মনে করেছেন এবং হাতির আকৃতি নিয়ে পরস্পর ঝগড়ায় লিপ্ত হয়েছেন, কারণ সে নিজে ধরে অনুভব করেছে, তাই অন্য জনের কথা মানতে সে রাজি নয়। যদি তাদের চোখ থাকতো সম্পূর্ণ হাতি দেখতো তবে ঝগড়া হতো না, ঠিক তেমনি ভালো আলেম না হলে ইসলামের আংশিক জ্ঞান লাভ করে যিনি যতটুকু বুঝবেন ততটুকুকে চূড়ান্ত মনে করে পরস্পর ঝগড়ায় লিপ্ত হবেন, যা ইসলাম ও মুসলিম জাতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। একজন চিকিৎসকের চিকিৎসা বিদ্যায় পারদর্শী হতে হয়, একই সাথে চিকিৎসকের ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা শিক্ষা করার প্রয়োজন নেই। তাকে কেহ প্রশ্ন করে না তুমি চিকিৎসা বিদ্যা জান প্রকৌশল বিদ্যা জাননা কেন? সেভাবে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ভালো আলেম হওয়ার শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন, তাকে সাধারণ শিক্ষায় পারদর্শী করতে সিলেবাসের বোঝা চাপিয়ে দিতে হবে কেন? মোগল আমলে বা তারও আগে আলেমদের রাষ্ট্রীয় ভাবে পৃষ্টপোষকতা করা হতো, আলেমরা শিক্ষা বিস্তারে কাজ করতো, তাদের বেতন মন্ত্রীর সমান ছিল। ইংরেজ আসার আগে এলাকার ভুমি লাখারাজ ও ওয়াকফ হিসেবে সরকার মাদ্রাসার হাতে দিয়েছিল, যা থেকে মাদ্রাসার ব্যয় যেমন নির্বাহ হতো জনগণের চাহিদার আলোকে এলাকার উন্নয়ন কাজে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ অর্থ বরাদ্দ দিত। তখন শুধু বাংলায় আশি হাজার মাদ্রাসা ছিল। ইংরেজরা আলেম ও মুসলমানদের এ মর্যাদা দেখে এবং সম্পদ কুক্ষিগত করার মানসে এ সকল সম্পত্তি মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ থেকে নিয়ে যায়, ফলে অর্থাভাবে মাদ্রাসাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। অনেক বছর পর মুসলিম নেতৃবৃন্দ চিন্তা করলেন মাদ্রাসা ও আলেম না থাকলে এক সময় ইসলাম ও মুসলিম বলতে কিছু থাকবে না। তাই তারা ইংরেজ সরকারের নিকট কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে আলোচনা করে। ইংরেজ সরকার সেখানে ইংরেজ বিরোধী কিছু হয় কিনা এ আশংকায় অধ্যক্ষ হবে ইংরেজ এ শর্তে দাবি মেনে নেয়। সরকারি রোষানলে পড়ে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ক্ষতিগ্রস্ত হবে চিন্তা করে মুসলিম নেতৃবৃন্দ ইংরেজ সরকারের শর্ত মেনে নেয়। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার কোন অর্থ বরাদ্দ দেয়নি নেতৃবৃন্দ নিজেদের অর্থে ১৭৮০ সালে কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে। তবে সিলেবাস ও পাঠ্য সংক্রান্ত বিষয়ে অধ্যক্ষের হস্তক্ষেপের সুযোগ ছিল না, এ দায়িত্ব যিনি পালন করতেন তার পদবী ছিল হেড মাওলানা। কলিকাতা আলীয়ার প্রথম হেড মাওলানা ছিলেন মোল্লা মজদ্দ্দুীন। আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর সেখান থেকে অসংখ্য যোগ্য আলেম তৈরি হয় যাতে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষার ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়।এর প্রায় একশত বছর পর ১৮৬৬ সালে ইংরেজ আমলে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে পরিচালনার জন্য স্থাপিত হয় কাওমী মাদ্রাসার মুল ভিত্তি দেওবন্দ মাদ্রাসা। তখন আলীয়া এবং কাওমী মাদ্রাসার সিলেবাস একই রকম ছিল। কোরআন, হাদিস, ফিকহ ইত্যাদি ভালো আলেম হওয়ার মতো সিলেবাস ছিল, সাধারণ বিষয় ছিল না। আলীয়া থেকে পাশ করে কাওমী মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতো, কাওমী মাদ্রাসা থেকে পাশ করে আলীয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করে বেতন ভাতা নিতো। ১৯৮০ সালে সরকার জনবল কাঠামো ও শিক্ষাগত সনদ নির্ধারণ করে দিলে কাওমী সনদ দিয়ে আলীয়ায় চাকরির সুযোগ শেষ হয়। মুলত তখন থেকে কাওমী শিক্ষিতরা আলীয়ার সমালোচনা শুরু করে। এবার আবার পিছনের আরেকটি দিক তুলে ধরি। ১৯১৫ সালে আলীয়াতে সাধারণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে নিউস্কীম, এবং সাধারণ বিষয় ছাড়া ওল্ডস্কীম এ দু' ধারায় বিভক্ত করা হয়। শর্ষিনা আলীয়া, সিলেট আলীয়া, ঢাকা আলীয়ার একাংশ নিউস্কীম সিলেবাস গ্রহনে অস্বীকৃতি জানায়, তারা ওল্ডস্কীমে থেকে যায়। এক পর্যায়ে ১৯৫৭ সালে সরকারি এক ঘোষণায় সকল নিউস্কীম মাদ্রাসা স্কুল কলেজে পরিণত হয়। লাকসাম নবাব ফয়জুন্নেসা তার বিশাল সম্পত্তি মাদ্রাসার নামেই ওয়াকফ করে, কিন্তু তা এখন নবাব ফয়জুন্নেসা সরকারি কলেজে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রামে মোহসিনিয়া মাদ্রাসা এখন মোহসিন কলেজে পরিণত হয়েছে। এ ভাবে তিনটি ছাড়া সকল মাদ্রাসা কলেজে পরিণত হয়েছে। এ ভাবে মিশরে ও নানা যুক্তি ও প্রলোভনে মাদ্রাসায় সাধারণ বিষয় পাঠ্যভুক্ত করতে করতে ইসলামী শিক্ষা বিলুপ্ত করা হয়েছে। আজকের আলীয়া মাদ্রাসার সিলেবাস দেখে মনে হচ্ছে এ গুলো ও সে পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ আগে স্কুলে ১০০ নম্বরের আরবী ১০০ নম্বরের ইসলাম শিক্ষা পরীক্ষা দিতে হতো। আরব অনেক দেশে একজন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া ছাত্রকে ও তার বিষয় ভিত্তিক পরীক্ষার সাথে সাথে কোরআন হাদিসের একটি নির্দিষ্ট সিলেবাসের পরীক্ষা দিতে হয়। বর্তমানে মাদ্রাসায় যে সিলেবাস ৯০% মুসলমানের দেশে এ সিলেবাস স্কুল কলেজের জন্য প্রয়োজন। মাদ্রাসায় গত কিছুদিন আগে ও বাংলা ইংরেজি ১০০ নম্বর করে ছিল। ১০০ নম্বর পড়েই তারা ২০০ নম্বর পড়ুয়া স্কুল কলেজ ছাত্রদের সাথে প্রতিযোগিতা করে বিশ্ব বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারতো। পরবর্তীতে বিশ্ব বিদ্যালয় শর্তারোপ করে ২০০ নম্বর করে বাংলা ইংরেজি না থাকলে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারবে না। ফলে ২০০ নম্বর করে ৪০০ নম্বরের বাংলা ইংরেজি দিতে গিয়ে মাদ্রাসার মুল আরবী বিষয় সঙ্কুচিত করা হয়। মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিশ্ব বিদ্যালয় সমুহের চ্যান্সেলর। উনার কাছে আবেদন মাদ্রাসা ছাত্রদের পুর্বের ন্যায় ১০০ নম্বর করে বাংলা ইংরেজি রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ রাখা হোক। মাদ্রাসার সিলেবাসে সাধারণ বিষয়ের বোঝা কমিয়ে যোগ্য আলেম তৈরির পথ সুগম করা হোক। মাদ্রাসার সিলেবাস প্রণয়নের দায়িত্ব শুধুমাত্র মাদ্রাসা শিক্ষিতদের হাতে দেয়া হোক। সে সাথে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মাদ্রাসা সিলেবাস থেকে ও প্রশ্ন রাখার ব্যবস্থা রাখা হোক।

উত্তর দিচ্ছেন: অধ্যক্ষ মো: ইয়াসিন মজুমদার, ফুলগাঁও ফাযিল ডিগ্রি মাদ্রাসা, লাকসাম, কুমিল্লা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ