ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
এবি সিদ্দিক : আবার শুরু হয়েছে সংলাপ। এবার সংলাপ হচ্ছে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে। গত ১৮ ডিসেম্বর ’১৬ তারিখে মহামান্য প্রেসিডেন্ট সাথে সংলাপ বা আলোচনা করেছেন বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির প্রতিনিধি দল। ঐ দিনেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘তালগাছটা আমার বিএনপির এই মনোভাব ছাড়তে হবে’। এর আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, প্রেসিডেন্ট যা ভাল মনে করবেন তাই করবেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যটা খুবই ইতিবাচক। তবে প্রেসিডেন্ট কি করবেন তা সময়েই বলে দেবে। প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা কতটুকু তাতো আমরা জানিই। বিএনপি চায় একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন, যে কমিশনের মেরুদ- আছে, কোন পক্ষপাতমূলক আচরণ করবে না, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি আদৌ সম্ভব? বাংলাদেশের মানুষ কি বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের মতো একজন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রেসিডেন্ট আর বিচারপতি আবদুর রউফের মতো একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার দেখতে পাবে? একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যেমন একটি দায়িত্বশীল নিরপেক্ষ ও মেরুদ-ওয়ালা নির্বাচন কমিশন দরকার, তেমনি ক্ষমতাসীন সরকারেরও দায়িত্ব হচ্ছে একটি অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনে সহায়তা করা। প্রতিবেশী ভারতসহ বিশে^র প্রায় সব দেশেই ক্ষমতাসীন দলের অধীনে জাতীয় ও স্থানীয় (সব নির্বাচন) নির্বাচন হয়। নির্বাচনকালীন সময়ে ক্ষমতাসীন সরকার বা দল থাকে নির্বাচন আড্ডা বাস্তবায়নকারী। সরকার নির্বাচন বিভাগ বা কমিশনকে অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সব ধরনের সহায়তা করে থাকে। আমরা ভারতের কাছ থেকে এ বিষয়ে শিক্ষা নিতে পারি। ভারতের গত জাতীয় নির্বাচনের সময় ক্ষমতাসীন দলের (কংগ্রেসের) নেতা রাহুল গান্ধী একটি ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের সাথে কথা বলছিলেন বলে পুলিশ তাকে অনেকটা ঘাড় ধাক্কার মতই এলাকা ছাড়া করে দেয়। বাংলাদেশে কি এটা সম্ভব? যাক সে কথা। বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন, তবে নামে মাত্র। চলে সরকারি হুকুমে। বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশন বা অন্য কমিশনাদের কথাবার্তায় মনে হয় যে, বাংলাদেশের জনগণ বোকা, কিছুই বুঝে না। এই কমিশন কি খেলা যে দেখাতে পারে তা দেশবাসী ইতোপূর্বে দেখেছে।
বিএনপি এখন রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা বা গৃহবন্দি বলাও চলে। রাজপথে কোন কর্মসূচি নিয়ে নামতে পারে না। আবার অনেক সময় অফিসেও থাকতে পারে না। পুলিশ অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেয়। আবার বালুভর্তি ট্রাক দিয়ে খালেদা জিয়াকে আটকে রাখা হয়। বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন গৃহবন্দি বটে। বিএনপি গৃহবন্দি হলেও মনে করে যে, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে ফলাফলটা বিএনপির পক্ষেই আসবে। অবশ্য এটাই বাস্তব ও সত্য। এটা যেমন বিএনপি বোঝে, তেমনি আওয়ামী লীগও বোঝে। আওয়ামী লীগ বোঝে বলেই তার যা করার করছে, হয়তো বা আগামীতেও করবে। এ বিষয়ে আর সামনে এগুতে চাই না। সংলাপ যেটা শুরু হয়েছে তার ফলাফল কি হবে, এ প্রশ্নের উত্তর সময়েই বলে দেবে। কেন সংলাপ? আর কেনই বা রাজনৈতিক সংকট? দেশের মানুষ পরাধীন পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ পাওয়ার আশায় যুগ যুগ আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। একাত্তরের আগেও অনেক রক্ত ঝরেছে। এরপর মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতার আন্দোলন। মানুষ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে চেয়েছিল সার্বিক মুক্তির জন্যই। আর বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ভাষণেও তাই বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’। এদেশের মানুষ গণতন্ত্রের জন্য রক্ত দিয়েছিল। কিন্তু কোথায় গেলো সেই গণতন্ত্র? গত ৪৫ বছরে এই স্বাধীন দেশের মানুষ কতটুকুই বা গণতন্ত্রের স্বাদ ভোগ করতে পেরেছে? কখনও স্বৈরাশাসন আবার কখনও গণতন্ত্রের লেবাসে একনায়কতন্ত্র চলছে। রাজনৈতিক সংকটের জন্য সংলাপ করতে হবে কেন? রাজনৈতিক সংকট কি দেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহেনতি মানুষ তৈরি করে? রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেন। গোটা বিশ্বে তো বহুদেশ আছে। কটি দেশে রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেন? সংবিধান অনুযায়ী সরকারের মেয়াদ শেষ হবে, আরেকটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে নতুন সরকার দায়িত্ব নেবে। দেশের মানুষকে সরকার মৌলিক অধিকার ভোগ করার সুযোগ করে দেবে। রাষ্ট্রের তথা জনগণের উন্নয়নে সরকার যা যা করার, করবে। জনগণের কথা বলার অধিকার, জান-মাল-ইজ্জত রক্ষার অধিকার, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের অধিকার নিশ্চিত করবে সরকার। বাংলাদেশে কোনো সরকার বৈধ বা অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসেই চিন্তা করে যে, কীভাবে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করা যায়। আর এর জন্য যা যা করার সবই করে। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে কোণঠাসা বা গৃহবন্দি, জুলুম-নির্যাতন, হামলা-মামলা, রাষ্ট্রযন্ত্রকে প্রতিপক্ষ বা বিরোধী দলের বিপক্ষে কাজে লাগানো, প্রশাসন দলীয়করণ অর্থাৎ যা যা করার দরকার বা করা যায় সবই করা হয়। মুখে বলে গণতন্ত্র, ভোট আর ভাতের কথা, বাস্তবে সবই উল্টো। ক্ষমতার লোভ দেশটার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। এই অবস্থার কি পরিবর্তন হবে না? বাংলাদেশ কখনই শক্তপোক্ত গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারেনি। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার স্বল্পকালের মধ্যে বহুল আকাক্সিক্ষত বেসামরিক শাসনটি ক্রমান্বয়ে হয়ে ওঠে কর্তৃত্ববাদী। সংবিধানে একের পর এক সংযোজিত হতে থাকে অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। যেমন জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধানসহ নিবর্তনমূলক আইন সংবিধানে সন্নিবেশিত করা হয় প্রথম সংবিধান প্রাপ্তির স্বল্পকাল পরই। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থা ওলট-পালট করে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়। চারটি বাদে সব সংবাদপত্র বাতিল করা হয়। ক্রমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটি বিদায় নিতে থাকে। এরপর অনাকাক্সিক্ষত এবং দুঃখজনক হত্যাকা-সহ নানা ঘটনার পর এক পর্যায় দেশ সামরিক শাসনের মধ্যে পড়ে যায়। নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। সেই দখল থেকে মুক্ত হতে সময় লাগে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। ১৯৯০-এ বেসামরিক শাসন ফিরে আসার পর জনগণের মধ্যে পুনরায় এমন তীব্র আকাক্সক্ষার জন্ম নিয়েছিল যে, এবারে হয়তো সত্যিকারভাবে গণতন্ত্র শক্তপোক্ত এবং মজবুত ভিত্তি পাবে। জনগণের সে আশা পূরণ হয়নি। রাজনীতিবিদরা দীর্ঘকালের অসাংবিধানিক শাসন থেকে নিশ্চয়ই শিক্ষা পেয়েছেন। তারপরও যেন তাদের বোধদয় হয়নি। কেন হয়নি, তার একটি বিচার-বিশ্লেষণ জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।