দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
কালের গতিধারায় বহু যুগ পরপর যে সকল মহামনীষী মাটির পৃথিবীতে আগম করে পথহারা মানুষকে মুক্তি ও কল্যাণের সঠিক পথনির্দেশ করে অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলার সঙ্গে তার বান্দাদেরকে জুড়ে দেন, সেই পুণ্যাত্মাদের অন্যতম হচ্ছেন হযরত শাহ জমীরুদ্দীন নানুপুরী (রহ.) পরকাল ভাবনা যাদের পার্থিব জীবনকে সদা পরাজিত করে গেছে যুগে যুগে, তিনি ছিলেন সেই কাফেলার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ছিলেন যুগের কুতুবুল আলম, ওলিয়ে কামেল। বাংলাদেশের আলেম সমাজ ও বুযুর্গ ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বজনমান্য ও সব শ্রেণীর মানুষের অনুসরণীয় ব্যক্তি। তার ভক্ত মুহিব্বিন শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়; ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। পার্থিব দুনিয়ায় শাহ জমিরুদ্দীন নানুপুরী (রহ.) এক স্বার্থক জীবন পরিচালনা করে গেছেন। আত্মশুদ্ধির ব্যাপক খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। তার ভাঙাভাঙা স্বরে গাওয়া আল্লাহর ইশক ও মহাব্বতের ‘দিলকাশ’ উর্দু-ফার্সি শে’র (কবিতা) শ্রোতাদের হৃদয় ছুঁয়ে যেত। অন্তর বিগলিত হতো। চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরত। আল্লাহভোলা মানুষকে আল্লাহর পথ দেখিয়ে গেছেন। ওয়াজ-নসিহত, দাওয়াত-তালিম, শিক্ষা-দিক্ষাসহ দাওয়াতের প্রায় সকল মাধ্যমে তিনি মানুষকে ঈমান ও আমলের বিস্তীর্ণ ময়দানে আহ্বান করেছেন। গড়েছেন বড় বড় দেশবরেণ্য আলেম। দ্বিনের একনিষ্ঠ দায়ী ইলাল্লাহ। রেখে গেছেন জীবন গড়ার আদর্শ। অনুসারীদের করেছেন সুন্নাহর প্রতি উদ্বুদ্ধ। দ্বীনি মাহফিলের উদ্দেশ্যে তিনি সফর করেছেন দেশের নানা প্রান্তে। বিদেশের মাটিতেও পৌঁছে দিয়েছেন দ্বীনের দাওয়াত। তাঁর স্মৃতি ছড়িয়ে আছে লাখো-কোটি মানুষের অন্তরে। তিনি স্বীয় কার্মগুণে অমর হয়ে আছেন, মানুষের ভালোবাসার ময়ূর সিংহাসনে।
জন্ম: চট্টলার বুকে কালের সূর্যোদয় : কালজয়ী এ মহান মনীষী চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত ফটিকছড়ি থানার নানুপুর গ্রামের এক সভ্রান্ত পরিবারে ১৯৩৬ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতার নাম মরহুম আব্দুল গফুর। দাদার নাম নেয়ামত আলী ও পরদাদার নাম হিম্মত আলী। বংশগত মর্যাদায় তিনি অত্যন্ত গৌরবের অধিকারী। তিনি ফটিছড়ির অপরূপ নৈসর্গিক মায়াময় পরিবেশে শৈশবের সোনাঝরা দিনগুলো অতিক্রম করেন। মুক্ত আবহাওয়ায় বেড়ে উঠেন। বাল্যকাল থেকেই তাঁর চিন্তা-চেতনা ছিল সুদূরপ্রসারী।
শিক্ষা জীবনের হাতেখড়ি : একেবারপ্রাথমিক শিক্ষা আরবি বর্ণমাল থেকে শুরু করে পবিত্র কুরআন মাজিদ পড়া তিনি মমতাময়ী মায়ের কাছ থেকেই শিখেছন। স্থানীয় প্রায়মারী স্কুলে পড়তেন। এলাকার অন্যান্য সহপাঠীদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত স্কুলে যেতেন। স্কুল শিক্ষদের প্রতিও ছিল তার ভক্তি-শ্রদ্ধা। স্যারগণ তাকে স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতেন। ওই সময় প্রতিদিন সকালে ফরের পরে মক্তবে আরবি শিখতেন মৌলোভী মরহুম আব্দুস সালাম সাহেবের নিকটে। পিতার ইচ্ছা ছিল তাকে স্কুলে পড়াবে। তার ছোট ভাই জিয়াউল হাসানকে মাদরাসায় পড়াবেন। কিন্তু মহান রবের কারিশমা দুনিয়ায় কার বুঝার সাধ্য আছে! হযরত প্রাইমারীতে ৪র্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েÑ স্কুল জীবনের ইতি টানলেন। আল্লাহ পাকের মানসা তাঁর এ প্রিয় বান্দাকে ‘ইলমে ওহী’র শিক্ষায় শিক্ষিত করে ঐশিজ্ঞানের ধারক যুগশ্রেষ্ঠ ওলিয়ে কামেল হিসেবে মনোনিত করবেন। মুসলিম উম্মাহর পথ-পদর্শক বানাবেন। পিতার স্কুলে পড়ানোর স্বপ্ন পূরণ হলো না। এবার তিনি মাদরাসায় পড়া-লেখার প্রতি মনোনিবেশ করলেন।
নববী পাঠশালায় সফলতার হাতছানি : হযরতের নানার বাড়ি পটিয়া। সেখানে একবার বেড়াতে গিয়ে দেখেন পাশে মুফতি আজিজুল হক সাহেব ওয়াজ করছেন। ওই মজলিসের তিনিও একজন শ্রোতা। খুব মনোযোগ দিয়ে বয়ান শুনলেন। সেদিন মুফতি সাহেব হুজুর নবীজির একটি হাদিস পাঠ করেন। যার অর্থÑ ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে ধর্মীয় জ্ঞান দান করেন।’ এই দ্বীনি আলোচনা তার অন্তরে এমন ভাবে রেখাপাত করেÑ সেই থেকে ‘ইলম দ্বীন’ অন্বেষণের আগ্রহ অন্তরে আরো বেড়ে যায়। এরপর স্কুলে যাওয়া স্থগিত করে দেন। ভর্তি হন এশিয়ার অন্যতম বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায়। জামাতে দহম (দ্বিতীয় শ্রেণী) থেকে শুরু হয় মাদরাসা শিক্ষার প্ররম্ভিকা। ইতিপূর্বে তিনি ‘বেহেশতী জেওয়ার’ ও ‘রাহে নাজাত’ কিতাব তার আম্মাজান ও মৌলোভী মাওলানা আব্দুস সালাম সাহেবের কাছেই পড়ে নিয়েছেন। হাটহাজারী মদরাসায় ভর্তি হওয়ার পর থেকে দাওরা হাদীস তথা শিক্ষা সমাপনী বর্ষের প্রায় ছয় মাস পর্যন্ত, এই সুদীর্ঘ সময়টিতে একটি বাড়িতে তিনি গৃহ শিক্ষক হিসেবে থেকেছেন। এটা তাঁর সুমহান চরিত্রের স্বীকৃতি বহন করে। দাওরা হাদীসের বছর ক্লাসের চাপ বাড়তে থাকায় বছরের বাকি ছয় মাস, ওই বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ হয়ে উঠেনি। মাদরাসায় থেকেছেন। তিনি দরসে নেযামীর পাঠ্যসূচির অন্তরভূক্ত কিতাবগুলো অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে অধ্যয়ন করেছেন। লেখাপড়ার শুরু থেকেই তিনি মনোযোগী ও কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন।
বিজ্ঞজনের বন্দনাবাক্য : হাটহাজারী মাদরাসার বর্তমান মহাপরিচালক হজরত মাওলানা ইয়াহইয়া সাহেব (দামাত বারকাতুহু) নানুপুরী (রহ.)-এর ব্যাপারে বলেন, ‘শাহ জমিরুদ্দীন (রহ.)-এর মাঝে ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা ও কর্তব্য পালনে একনিষ্ঠতা এবং আমল-আখলাকে বুযর্গীর একটা প্রভাব পরিলক্ষিত হত। এ পর্যায়ে আমার নিজের একটা অনুভূতি থেকে বলছি, ‘শাহ জমিরুদ্দীন নানুপুরী (রহ.) যখন হাটহাজারীতে দাওরা হাদিস পড়েন, আমি তখন মিযান জামাতের ছাত্র। হজরত তখন ছিলেন অত্যন্ত সুদর্শন টগবগে এক তাগড়া যুবক। ছাত্র অবস্থাতেই হজরতকে সবসময় দরসে ও কিতাব মুতালায় অত্যন্ত মনোযোগী দেখেছি। তিনি দরসের বাইরে সময় নষ্ট করতেন না। বিকেলের অবসর সময়েও কখনো ক্যাম্পাসের বাইরে দোকানপাটে বা বাজারে যেতেন না। তিনি ছাত্রদের সাথে আড্ডা বা অনর্থক আলাপচারিতায় জড়াতেন না। তিনি খুব কম কথা বলতেন। সবসময় পাবন্দীর সাথে জামাতে নামায আদায় করতেন। চলাফেরায় পরিপূর্ণ সুন্নতের অনুসারী ছিলেন। ছাত্র জীবনেও কোরআন তেলাওয়াত, জিকির, তাহাজ্জুদ ও নফল ইবাদত-বন্দেগির প্রতি বিশেষ মনোযোগী ছিলেন। যার ফলে অন্যান্য ছাত্ররা হজরতকে বিশেষ সম্মান ও সমীহ করত। অধ্যাপক ডি. কে. বড়ুয়া বলেন, ‘আমি হুজুরের একজন পরম ভক্ত। তিনি আমাকে নিজের সন্তানের মত স্নেহ, আদর-সোহাগ করতেন। আমি ছাড়াও পাশ^বর্তীদের খোঁজ খবর নিতেন। বাংলাদেশ তথা প্রথিবীর বিভিন্ন স্থানে হুজুরের হাজার হাজার ভক্তবৃন্দ রয়েছে। তাদের অনেকে হুজুরের ‘পানিপড়া’ নিয়ে কঠিন রোগ থেকে আরোগ্য পেয়েছেন। পাশের্^র বড়ুয়া পাড়ার লোকেরা পর্যন্ত হুজুরের কাছে বিভিন্ন মান্নত নিয়ে আসত।
উল্লেখযোগ্য উস্তাদগণ : মুফতি আহমদুল হক সাহেব-এর কাছে পাঞ্জগঞ্জ ও ইলমুস সিগাহ পড়েছেন। মাওলানা আবদুল আজিজ (রহ.)-এর কাছে নাহবেমীর, হেদায়াতুন নাহু, কাফিয়া ইত্যাদি পড়েছেন। মাওলানা হামেদ সাহেবে (রহ.)-এর নিকট মিরকাত ও আবদুল ওয়াহ্হাব (রহ.)-এর নিকট কুদুরি কিতাব পড়েছেন। তাঁর অন্যান উস্তাদগণ হলেনÑ যুগশ্রেষ্ঠ ফকিহ মুফতি ফয়যুল্লাহ রহ. মাওলানা আবুল হাসান রহ. মাওলানা মুহাম্মদ আলী (রহ.) মাওলানা আবদুল কাইয়ুম (রহ.) ও যুগশ্রেষ্ঠ হাদিস বিশারদ মাওলানা ইউসুফ বানূরী (রহ.)-এর থেকে সহিহ্ বুখারি শরিফ-এর সনদ গ্রহণ করেছেন।
শিক্ষক ও কর্মজীবন : বৃক্ষ থেকে পত্রপল্লব। শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করে প্রথমে চট্টগ্রামের ঐতিয্যবাহী বাথুয়া মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। অত্যন্ত সুনামের সাথে শরহে জামী, সুল্লামুল উলূম, মাইবুজী ও তাফসীরে জালালাইন সহ দরসে নেযামীর গুরুত্বপূর্ণ কিতাব পাঠদান করেন। ১৯৬৫ সালে মরহুম পীরে কামেল মাওলানা শাহ সুলতান আহমদ নানুপুরী (রহ.)-এর আদেশে জামিয়া ইসলামিয়া ওবাইদিয়ায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ওবায়দিয়াতে এসেও কাফিয়া, শরহেজামী, সুল্লাম ও জালালাইন সহ নাসাই শরীফÑএর দরস দেন। হযরতের একেকটা ক্লাস ছিল ইলমে ওয়াহীর প্রবহমান শ্রোতধারা। ঐশী জ্ঞানের আলোতে উদ্ভাসিত হতো ছাত্রদের অন্তর। তাছাড়া খণ্ডকালীন সময় জামিয়ার নাজেমে তা’লিমাত তথা শিক্ষা সচিবের দায়িত্ব পালন করেন।
জামিয়ার দক্ষ পরিচালনা : হজরতের সূচারু চিন্তাধারা ও কর্মদক্ষতা প্রতি লক্ষ্য করে সুলতান আহমদ নানুপুরী (রহ.)-এর জীবদ্দশাতেই জামিয়ার দায়িত্বভার তাঁর উপর অর্পণ করেন। উল্লেখ্য সুলতান আহমদ নানুপুরীর জীবিত থাকা অবস্থায় দীর্ঘ দশ বছর হজরত জমিরউদ্দিন (রহ.) মোহতামিমের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর মৃত্যু অবধি ২৫ বছরের দক্ষ ও গতিশীল পরিচালনায় প্রতিষ্ঠানটি অভূতপূর্ব সফলতা অর্জন করে। পড়লেখার উন্নতি। কয়েকটি নতুন বিভাগ চালু ও দিন দিন ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি ও অবকাঠমোগত উন্নয়ন ঈর্ষণীয় পর্যায়ে পৌঁছে। (চলবে)
লেখক : ভাইস প্রিন্সিপাল, মদিনা মাদরাসা। শ্রীরামপুর বাজার, রায়পুরা, নরসিংদী।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।