দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
অনেক সময় আমরা বিভিন্ন ধরনের স্বপ্ন লালন করি। কিন্তু সেসব স্বপ্ন কখনো কখনো বাস্তবায়িত হয়; আবার কখনো কখনো বাস্তবায়িত হয় না। স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলে আমরা আনন্দিত হই; আর বাস্তবায়িত না হলে ব্যথিত হই। নিজের কোনো ত্রুটির কারণে স্বপ্ন বাস্তবায়িত না হলে আফসোস ও পরিতাপ করি যে, সেই কাজটি কেন করলাম না? যদি করতাম, তাহলে আমার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতো। আমার আকাক্সক্ষা পূরণ হত। এই পৃথিবী এমন এক স্থান যেখানে কখনো কখনো আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়িত না হলে এর প্রতিবিধান করা যায়। কোমর বেঁধে পুনরায় কাজে নেমে গেলে কাক্সিক্ষত স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। কিন্তু পরকাল এমন এক জায়গা যেখানে অন্যায়-অপরাধ করে গেলে আফসোস ও পরিতাপের অন্ত থাকবে না। সেখানে আফসোস ও পরিতাপ করলে কোন লাভ হবে না। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আমরা এমন সাত শ্রেণির লোকের ব্যাপারে আলোকপাত করছি যারা পরকালে আফসোস ও পরিতাপ করবে। কিন্তু তাদের আফসোস ও পরিতাপ কোন কাজে আসবে না।
আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য বর্জনকারী: পৃথিবীতে কিছু লোক রয়েছে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে। পক্ষান্তরে আরও কিছু লোক রয়েছে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে না। তারা নিজের কামনা বাসনা মতো জীবন যাপন করে। যাচ্ছেতাই পন্থায় জিন্দেগি পরিচালিত করে। তারা তাদের নেতা নেত্রীদের কথা মেনে চলে। শরিয়ত পরিপন্থী কাজেও নেতা-নেত্রীদের কথা মানতে পিছপা হয় না। পরকালে এমন লোকদের স্থান হবে জাহান্নাম। জাহান্নামে তাদেরকে ওলট-পালট করে শাস্তি প্রদান করা হবে। সেদিন তারা আফসোস ও পরিতাপ করবে, যদি আমরা নেতা-নেত্রীদের কথা না মেনে আল্লাহ ও তার রাসুলের কথা মতো জীবনযাপন করতাম, ইসলাম ধর্ম মেনে চলতাম, তাহলে আজ আমাদেরকে চিরন্তন দুর্ভোগের শিকার হতে হতো না। কিন্তু সেদিনকার আফসোস তাদের জন্য কোন কল্যাণ বয়ে আনবে না। আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য বর্জনকারী লোকদের পরিতাপ সম্পর্কে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যেদিন অগ্নিতে তাদের মুখম-ল ওলট পালট করা হবে; সেদিন তারা বলবে, হায়। আমরা যদি আল্লাহর আনুগত্য করতাম ও রাসুলের আনুগত্য করতাম। তারা আরও বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা আমাদের নেতা ও বড়দের কথা মেনেছিলাম, অতঃপর তারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল।’ (সুরা আহজাব, আয়াত : ৬৬-৬৭)
অপরাধী মানবসকল: পার্থিব জীবনে কিছু মানুষ নেক কাজ করে। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, কুরবানি ও ইতেকাফসহ বহুবিধ সৎকর্ম সম্পাদন করে। অপরদিকে কিছু লোক এমন রয়েছে যারা শুধু পাপ আর পাপ কাজে জড়িত থাকে। দিবানিশি অন্যায়-অনাচার করে বেড়ায়। অন্যায়-অপরাধ যাদের নেশা ও পেশা হয়ে দাঁড়ায়। এসব লোক পরকালের কথা ভাবে না। মৃত্যুর পরজীবনের কথা চিন্তা করে না। যেসব লোক পরকালের কথা ভেবে সৎকাজ আঞ্জাম দেয়, তাদের কোন আফসোস ও পরিতাপ থাকবে না। পক্ষান্তরে যারা পরকালের কথা না ভেবে অন্যায়-অপরাধ করে বেড়ায় তাদের আফসোস ও পরিতাপের কোন সীমা থাকবে না। এসব মানুষ যখন নেককার লোকদেরকে জান্নাতে সুখ ও শান্তিময় জীবন যাপন করতে দেখবে এবং নিজেদেরকে জাহান্নামের অধিবাসী হিসাবে দেখতে পাবে তখন আফসোস ও পরিতাপ করে বলবে, হায়! আমরাও যদি এ জীবনের জন্য সৎকর্ম সম্পাদন করতাম, তাহলে আজ আমাদের এই দুর্দশার শিকার হতে হতো না। পবিত্র কুরআন শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং সেদিন জাহান্নামকে আনা হবে, সেদিন মানুষ স্মরণ করবে, কিন্তু এই স্মরণ তার কী কাজে আসবে? সে বলবে, হায়, এ জীবনের জন্যে আমি যদি কিছু অগ্রে প্রেরণ করতাম!’ (সুরা ফাজর, আয়াত : ২৩-২৪)
জালেম লোক: জুলুম করার বিভিন্ন ধরন ও পদ্ধতি রয়েছে। সবচেয়ে বড় জুলুম হলো আল্লাহ তাআলার সঙ্গে শিরক করা। আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কোন উপাস্য সাব্যস্ত করা। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনীত দ্বীনের আবশ্যকীয় বিধিবিধানকে মিথ্যারোপ করা। অতএব, যারা আল্লাহ তাআলার সঙ্গে শিরক করে এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনীত বিধিবিধানকে মিথ্যারোপ করে তারা জালেম। অনুরূপভাবে কোন মানুষ বা প্রাণীকে অন্যায়ভাবে অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়নকারী ব্যক্তিও জলেম বলে গণ্য। যেসব লোক মহান আল্লাহর সঙ্গে শরিক করবে, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক আনীত বিধিবিধানকে অমান্য করবে ও আল্লাহ তাআলার সঙ্গে উপাস্য স্থির করবে তারা জালেম। পরকালে এসব জালেম আফসোস, পরিতাপ, দুঃখ, কষ্ট ও বিষণœতার সঙ্গে আঙ্গুল দংশন করতে করতে বলবে, হায়! যদি আমি রাসুলের সঙ্গে পথ চলতাম। যদি ইহকালে তার সঙ্গ দিতাম, তাহলে কতই না সৌভাগ্যবান হতাম! এ ব্যাপারে কুরআন শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ‘জালেম সেদিন আপন হস্তদ্বয় দংশন করতে করতে বলবে, হায় আফসোস! আমি যদি রাসুলের সাথে পথ অবলম্বন করতাম।’ (সুরা ফুরকান, আয়াত : ২৭)
মন্দ সঙ্গী গ্রহণকারী: মানুষের মধ্যে কিছু রয়েছে ভালো মানুষ এবং কিছু রয়েছে খারাপ মানুষ। ভালো মানুষের সাহচর্য অবলম্বন করলে ভালো পথে নিয়ে যায়। আর খারাপ মানুষের সাহচর্য অবলম্বন করলে খারাপ পথ দেখায়। অনুরূপভাবে কিছু খারাপ জিন রয়েছে যারা মানুষের মনে কুমন্ত্রণা দেয়। অন্যায় পথে পরিচালিত করে। সঙ্গে সঙ্গে শয়তান মানুষকে অন্যায় পথে পরিচালিত করার জন্য দিবারাত্র চেষ্টায় রত রয়েছে। খারাপ মানুষ, দুষ্ট জিন ও শয়তানকে যারা সঙ্গী রূপে গ্রহণ করে তাদের কথা ও মন্ত্রণা অনুযায়ী জীবন যাপন করে তারা অসৎ পথে পরিচালিত হয়। কথায় আছে সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। মন্দ সঙ্গী গ্রহণকারীরা পরকালে আফসোস ও পরিতাপ করে বলবে, যদি আমি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম! যদি অমুকের সঙ্গে দিবারাত্র না চলতাম, তাহলে অমুক খারাপ কাজ করতাম না। তার সঙ্গে বন্ধুত্ব না থাকলে এমন মন্দ কাজ আমার দ্বারা সংঘটিত হতো না। অসৎ মানুষ, দুষ্ট জিন ও শয়তানকে বন্ধুরূপে গ্রহণ কারীরা আফসোস ও পরিতাপ করবে মর্মে কুরআন শরিফে এসেছে, ‘হায় আমার দুর্ভাগ্য, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম।’ (সুরা ফুরকান, আয়াত : ২৭-২৮)
(চলবে)
দুর্বল ঈমানদার: আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। যেসব যুদ্ধে মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম অংশগ্রহণ করেছেন সেগুলোর প্রায় প্রতিটিতেই মুসলমানদের বিজয় অর্জিত হয়েছে এবং মুসলমানরা গনিমত লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু মুসলমান নামধারী কিছু কিছু মানুষ এমন ছিল যাদের মধ্যে ঈমানের প্রকৃত প্রাণশক্তি বিদ্যমান ছিল না। মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে তারা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে নি। এরপর যুদ্ধে জয়লাভ করার পর যখন গনিমত অর্জিত হয়েছে তখন তারা আফসোস ও পরিতাপ করে বলেছে, আমরা যদি বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সহচরবৃন্দের সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতাম, তাহলে গনিমত লাভ করে সফল হতে পারতাম। এ মর্মে আল কুরআনে এসেছে, ‘পক্ষান্তরে তোমাদের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন অনুগ্রহ আসলে তারা এমন ভাবে বলতে শুরু করবে যেন তোমাদের মধ্যে এবং তাদের মধ্যে কোন মিত্রতাই ছিল না। (বলবে) হায়, আমি যদি তাদের সাথে থাকতাম, তাহলে আমি ও যে সফলতা লাভ করতাম।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৭৩)
কাফের সম্প্রদায়: আজকের পৃথিবীতে কাফের সম্প্রদায় যাচ্ছেতাই করে বেড়াচ্ছে। বেহায়াপনা, বেলেল্লাপনা, অশ্লীলতা, যৌনতা, নগ্নতা ও অন্যায়-অপরাধের এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে কাফেরদের পদচারণা নেই। তারা মনের কামনা বাসনা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করছে। নির্লজ্জ যৌনজীবন উপভোগ করছে। পৃথিবীর বুকে তারা নিজেদের অপরাধের ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পারছে না। মৃত্যুর পর যখন তাদের দেহে পুনরায় প্রাণ সঞ্চারিত হবে ও পুনরুত্থান ঘটবে তখন তাদের ঘুম ভাঙবে। তারা জীবনে যত অন্যায়, অনাচার ও অবিচার করেছে তার সবকিছু স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করবে। নিজেদের আমলের ডায়েরি প্রত্যক্ষ করে তারা পরকালীন জীবনের অন্তহীন নরক যন্ত্রণার ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে আফসোস ও পরিতাপ করতে থাকবে। তারা বলবে, হায়! আমি যদি জন্মগ্রহণ না করতাম! আমি যদি পুনর্বার উত্থিত না হতাম! আমি যদি মাটি হয়ে যেতাম! মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি তোমাদেরকে আসন্ন শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করলাম, যেদিন মানুষ প্রত্যেক্ষ করবে যা সে সামনে প্রেরণ করেছে এবং কাফের বলবে, হায়, আফসোস-আমি যদি মাটি হয়ে যেতাম।’ সুরা নাবা, আয়াত : ৪০)
বাম হাতে আমলনামা প্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ: পরকালে মানুষকে দুই দলে বিভক্ত করা হবে। এদের এক দলের ডান হাতে আমলনামা প্রদান করা হবে এবং অপর দলকে বাম হাতে আমলনামা দেওয়া হবে। যাদের ডানহাতে আমলনামা প্রদান করা হবে তারা হবে সৎকর্মশীল, নেককার, ঈমানদার ও আল্লাহওয়ালা মানুষ। তাদের আমলনামায় জান্নাতের সুসংবাদ লিপিবদ্ধ থাকবে। চিরন্তন সুখ-শান্তির শুভসংবাদ লিপিবদ্ধ করে সৎকর্মশীলদের ডান হাতে তাদের কর্মের ডায়েরি তুলে দেওয়া হবে। অপরদিকে অপরাধী ও অনাচারী ব্যক্তিবর্গের বাম হাতে আমলনামা প্রদান করা হবে। সেই আমলনামায় তাদেরকে চিরন্তন নরক যন্ত্রণার দুঃসংবাদ দেওয়া হবে। তাদের আমলনামায় কোন ধরনের সুসংবাদ থাকবে না। কেবল দুঃখ ও কষ্ট ভোগের বিবরণ থাকবে। সেদিন বাম হাতে আমলনামা প্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ আফসোস করে বলবে, যদি আমাকে আমলনামা দেওয়া না হতো! মৃত্যুর পর যদি কোন ধরনের হিসাব নিকাশ না হতো, তাহলে কতই না ভালো হতো। এ সম্পর্কে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে এসেছে, ‘যার আমলনামা তার বাম হাতে দেয়া হবে, সে বলবে, হায় আমায় যদি আমার আমলনামা না দেয়া হতো। আমি যদি না জানতাম আমার হিসাব! হায়, আমার মৃত্যুই যদি শেষ হত।’ (সুরা হাক্কাহ, আয়াত : ২৫-২৭)
আলোচ্য নিবন্ধের মাধ্যমে আমরা সেসব লোকের ব্যাপারে জানতে পেরেছি যারা পরকালে আফসোস ও পরিতাপ করবে। কিন্তু তাদের আফসোস ও পরিতাপ কোন কাজে আসবে না। তাই আসুন! আমরা এমনভাবে জীবন অতিবাহিত করি যেন পরকালে পরিতাপকারীদের অন্তর্ভুক্ত না হই। মহান আল্লাহ আমাদেরকে নেককার বান্দাদের দলভুক্ত হওয়ার তৌফিক দান করুন। জান্নাতের অধিবাসী হিসেবে কবুল করুন। আমিন।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা-১২১১
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।