বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
আল ফাতাহ মামুন : পুলিশ জনগণের বন্ধু’- কথাটি কাগজে-কলমে কিংবা বক্তৃতার মঞ্চে শোভা পেলেও বাস্তব জীবনে জনগণের বন্ধু পুলিশ নয়। সত্যিকার অর্থেই পুলিশ যদি জনগণের বন্ধু হতো তবে তাদের বিরুদ্ধে চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে গুম-অপহরণের মতো ভয়াবহ অপরাধের অভিযোগ উঠতো না। উঠতো না নারীর শ্লীলতহানীর মতো লজ্জাজনক অভিযোগও। অভিযোগ যেন বিয়োগই হচ্ছে না পুলিশের জীবন থেকে। গত ১৮ নভেম্বর রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেল মোড়ে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা ছিনিয়ে নেয়ার সময় হাতেনাতে ধরা পড়েন ট্রাফিক পুলিশের এক কনস্টেবল। ছিনতাইয়ে জড়িত আরেক কনস্টেবলকে পরে উত্তরা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গত ২৩ নভেম্বর দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়- ‘নানা অপরাধে জড়াচ্ছেন পুলিশের একশ্রেণির সদস্য। চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, শ্লীলতাহানি, জমি ও ফ্ল্যাট দখল, গ্রেফতার বাণিজ্য, ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ গ্রহণসহ সব ধরনের অপরাধে তারা বিচরণ করছেন। কনস্টেবল থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাও এসব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। চাকরিচ্যুত, তিরস্কার, সতর্ক, গুরুদ-, লঘুদ-সহ নানা ব্যবস্থা নেওয়া হলেও পুলিশের অপরাধপ্রবণতা কমছে না। বরং দিন দিন বাড়ছেই। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ থেকে ২০১৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত ছয় বছরে নানা অপরাধে জড়িত থাকায় ৭৬ হাজার ৪২৬ জন পুলিশকে অর্থদ-, তিরস্কার, বদলি, বরখাস্ত, বাধ্যতামূলক অবসর ও চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। শাস্তি পাওয়াদের মধ্যে ৭৬ হাজার ৯৯ জনই কনস্টেবল থেকে উপপরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার। আর পরিদর্শক থেকে তদূর্ধ্ব পর্যায়ের কর্মকর্তা রয়েছেন ৩২৭ জন।’
উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এতেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। এক শ্রেণীর পুলিশের এই অপরাধ প্রবণতা নিয়ে ব্যাপক লেখালেখি, আলোচনা-সমালোচনা সত্ত্বেও অনেক পুলিশ সদস্যকে অপরাধ প্রবণতা থেকে নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকার রাজনৈতিক কর্মসূচী বাস্তবায়নে পুলিশকে ব্যবহারের ফলে পুলিশকে যে ব্যাপক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, এক শ্রেণীর পুলিশ তারই অপব্যবহার করছে। অন্যদিকে পুলিশে দলীয়করণের বিষয়টিকেও দুর্নীতি ও অপরাধপ্রবণতার কারণ হিসেবে মনে করা হয়ে থাকে।
পুলিশ সংশ্লিষ্ট অপরাধসমূহের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র গুম-অপহরণের। বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিয়ে ৭৫ জনকে ধরে আনার অভিযোগের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে, ৩ জনকে পরে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, ১৮ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যদের খোঁজ নেই। ২০১৫ সালে গুম হন ৫৫ জন। পরে তাঁদের ৭ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়, ৫ জন ফিরে আসেন, লাশ উদ্ধার হয় ৮ জনের। ২০১৪ সালে গুম হন ৮৮ জন। তাঁদের ২৩ জনের লাশ উদ্ধার হয়, ১২ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়, গ্রেপ্তার দেখানো হয় ১ জনকে।’
গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা অভিযোগের আঙ্গুল পুুলিশের দিকে তুললেও নিয়মতান্ত্রিক বা দায়সারা বক্তব্য দিচ্ছে পুলিশ। পুলিশের বক্তব্য যেমনই হোক; সরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বক্তব্য যেন গুমকে সমর্থন কিংবা এ ধরনের ঘটনার পক্ষাবলম্বনেরই নামান্তর। গত ৪ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে আয়োজিত এক আলোকচিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন- ‘গুম বলে কোনো শব্দ নেই। গুম বলে আমাদের কোনো কিছু জানা নেই। যাঁরা গুম রয়েছেন বলে অভিযোগ করা হচ্ছে, তাঁরা বিভিন্ন কারণে আত্মগোপনে রয়েছেন। আমরা অতীতে দেখেছি, তাঁদের অনেকেই ফিরে এসেছেন।’ (সূত্র : দৈনিক প্রথম আলো, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৬।)
দুটি কারণে গুম হওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা রাষ্ট্রের অপরিহার্য দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। প্রথমত, পুলিশের বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ মিথ্যা- এ কথা প্রমাণ করার জন্য হলেও গুম হওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে হবে। তারা কোথায় এবং কেন আত্মগোপন ছিলেন, তাদের জন্য কেন পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হলো- এসব বিষয় খোলাসা হবে তাদের খুঁজে পেলেই। তাই পুলিশের স্বার্থেই গুম হওয়াদের খুুঁজে বের করতে হবে। দ্বিতীয়ত, গুম হওয়াদের স্বজনরা বারবার প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হচ্ছেন। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে রাষ্ট্রে কাছে প্রিয় মানুষটির সন্ধান চাচ্ছেন। তাই মানিবক এবং নাগরিক অধিকারের বিবেচনায় গুম হওয়াদের খুঁজে বের করে স্বজদের মাঝে ফিরিয়ে দেয়া রাষ্ট্রের একান্ত দায়িত্ব হয়ে পড়েছে।’
পুলিশের এক হিসাবে জানা গেছে, ২০১৫ সালে প্রায় ৩০ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে ১০ হাজারের ৩৪ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ৭৮ জনের বিরুদ্ধে চাকরিচ্যুতির মতো কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ফৌজদারি অপরাধেও ব্যবস্থা নেয়ার নজির একেবারেই কম। পুলিশ কর্মকর্তা ও ভুক্তভোগীরা বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুলিশ সদর দপ্তর অভিযুক্ত সদস্যদের গুরুদ- না দিয়ে লঘুদ- দেয়। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, ফৌজদারি মামলার অপরাধ করলেও বেশিরভাগ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দিয়েই ইতি টানা হয়। অনেক সময় পরিস্থিতি সামাল দিতে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার বা সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। একপর্যায়ে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এলে সময় নিয়ে কৌশলী তদন্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে রক্ষা করা হয়।
অপরাধ দমন যাদের কর্তব্য সেই পুলিশ সদস্যরাই যখন একের পর এক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন তখন বিষয়টি আর সহজ বা সাধারণভাবে নেওয়া যায় না। এ যেন ‘রক্ষকই ভক্ষক’ বা ‘শর্ষেতেই ভূত’- বাগধারার জীবন্ত উদাহরণ হয়ে দাঁড়িছে। পুলিশ সাধারণ মানুষকে বানোয়াট মামলায় জড়িয়ে থানায় নিয়ে অর্থ আদায় করে, এটা কোনও নতুন অভিযোগ নয়। এমনকি রহস্যজনকভাবে আসামীকে বাদী আর বাদীকে আসামী বানাতেও পুলিশ বেশ পারঙ্গম। পুলিশের অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়া দেশের জন্য অশুভ সংকেত হিসেবেই দেখছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আইনের রক্ষক যখন আইন ভঙ্গ করেন তখন সাধারণ মানুষের আশ্রয়ের কোনো জায়গা থাকে না। প্রয়োজনীয় পুলিশি সেবা নিশ্চিত করতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরই উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য পুলিশের অপরাধপ্রবণতা কমাতে কঠোর আইন প্রণয়ন ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। তাদের মতে, অপরাধে জড়িত পুলিশ সদস্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হয় না বলেই অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বাড়ছে। এসব পুলিশ সদস্যের শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য আইন যুগোপযোগী করা জরুরি। কারণ, পুলিশের সাম্প্রতিক কর্মকা- সরকারের এই গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাটি সম্পর্কে বহু অনাকাক্সিক্ষত প্রশ্ন সৃষ্টি হচ্ছে।
এমনকি বিদেশেও এ নিয়ে নেতিবাচক কথাবার্তা হচ্ছে। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে আমাদের দেশের পুলিশের যে সম্মান ও মর্যাদা রয়েছে সেখানেও টানাপড়েন সৃষ্টি হতে পারে। কাজেই পুলিশের ইমেজ ফিরিয়ে আনতে হলে অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িত পুলিশ সদস্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কঠোর বিধান করতে হবে। চরিত্র গঠন ও নৈতিক প্রশিক্ষণও দিতে হবে পুলিশ বাহিনীকে। অন্যথায় পুলিশ সম্পর্কে যে নেতিবাচক মনোভাব সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে তা কোনভাবেই থামানো যাবে না। খোদ পুলিশ প্রশাসন ও সরকারকেই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে পুলিশের ভাবমর্যাদা রক্ষার জন্য। ইমেজ সংকট কাটিয়ে ওঠে পুলিশ একদিন জনগণের সত্যিকার বন্ধু হবে- এ প্রত্যাশা আমাদের সবার।
য় লেখক : শিক্ষার্থী, ডিপ্লোমা ইন অ্যারাবিক
ল্যাঙ্গুয়েজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।