Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দেড়শ’ বছরের পুরনো আইনে কোর্ট ফি আদায়

বিচার-ব্যয় মেটাতে সর্বস্বান্ত বিচারপ্রার্থী মামলাপ্রতি সরকারের আয় ৫৫ পয়সা!

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ১৮ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০৫ এএম

একটি মামলা থেকে সরকারের আয় হচ্ছে ৫৫ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা। মামলার বিষয়বস্তুর মূল্যমান যদি কয়েক হাজার কোটি টাকাও হয় তাতে মামলাকারীকে গুণতে হয় বড়জোর ৪০ হাজার টাকা। দেশে বিচারাধীন ৩৮ লাখের মতো বিচারাধীন মামলা থেকে আইনজীবীদের পকেটে যাচ্ছে শত শত কোটি টাকা। কিন্তু এ থেকে রাষ্ট্রের আয় নাম মাত্র। মামলার দায়েরের প্রবণতা, সংখ্যা এবং পরিচালনা ব্যয় বাড়লেও বিচার খাত থেকে আয় বাড়েনি রাষ্ট্রের। উপরন্তু বিচার নিষ্পত্তি ও মামলা ব্যবস্থাপনায় বেড়ে চলেছে সরকারের ব্যয়। দেড়শ’ বছরের পুরনো কোর্ট ফি আইন আইনজীবীদের নানাভাবে উপকৃত করলেও বঞ্চিত করছে বিচারপ্রার্থী ও রাষ্ট্রকে। ২০১০ সালে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ কোর্ট ফি আইন সংশোধন করে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ হারে নির্ধারণ করেন। কিন্তু আইনজীবীদের আপত্তির মুখে এটি আবার ২ শতাংশে নামানো হয়। বর্তমানে কোর্ট ফি অ্যাক্ট-১৮৭০ (সংশোধনী ২০১০) এবং ২০১০ সালের ২১ সেপ্টেম্বরের এসআরও (নং-৩২৬-আইন/২০১০) অনুযায়ী আদায় করা হচ্ছে।

অভিযোগ রয়েছে, মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবী তার ফি’র বাইরে আনুষাঙ্গিক খরচ দেখিয়ে বাড়তি কিছু টাকা আদায় করেন। এর মধ্যে একটি খাত হচ্ছে কোর্ট ফি। বিচারপ্রার্থীর কাছ থেকে কি হারে কোর্ট ফি আদায় করা হবে তা নির্ধারণে ১৮৭০ সালে একটি আইন হয়। আইনের আওতায় ২টি তফসিল হয়। প্রথম তফসিল অনুযায়ী ৩ ধারায় বর্ণিত বিষয় ব্যতীত যে কোনো দেওয়ানি অথবা রেভিনিউ আদালত দাখিলকৃত আরজি, পাল্টা দাবি বা সমন্বয়ের দাবিযুক্ত লিখিত জবাব বা এরূপ আপিলের মেমোরেন্ডাম বা পাল্টা আপত্তি যেখানে বিরোধীয় বিষয়বস্তুর পরিমাণ বা মূল্য ৭৫ টাকা ঊর্ধ্বে নয়Ñ তার জন্য ৫৫ পয়সা কোর্ট ফি প্রযোজ্য। অর্থাৎ, ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী মাত্র ৫৫ পয়সা কোর্ট ফি পরিশোধ করে বিদ্যমান বিচারব্যবস্থায় মামলা করা সম্ভব। দেশের আদালতগুলোতে ৩৪ ধরনের মামলা বিচারাধীন। এসব মামলায় দুইভাবে কোর্ট ফি পরিশোধ করতে হয়। একটি হচ্ছে নির্ধারিত হারে। আরেকটি এডভেলরেম বা মূল্যমান হারে। তবে বিরোধীয় বিষয়ের মূল্যমান ভেদে কোর্ট ফি’র হার ৭৫ পয়সা, ২ টাকা ৪৫ পয়সা, ১ টাকা ৭০ পয়সাও রয়েছে। ক্ষতিপূরণ দাবির মামলার ক্ষেত্রে কোর্ট ফি গুণতে হয় ২% হারে। অর্থাৎ দাবিকৃত অর্থের ২ শতাংশ হারে পরিশোধ করতে হয় কোর্ট ফি।

প্রথম তফসিল অনুযায়ী ২ লাখ টাকার অধিক যত টাকা মূল্যমানের বিষয়বস্তুই হোক না কেন এর বিপরীতে কোর্ট ফি পরিশোধ করতে হয় মাত্র ৪০ হাজার টাকা। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি যদি কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলাও করেন তাকে ৪০ হাজার টাকার বেশি কোর্ট ফি দিতে হয় না।

সূত্রমতে, কোর্ট ফি পরিশোধ করতে হয় মামলার বিষয়বস্তুর মূল্যমানের ওপর। বর্তমানে রিট পিটিশনের ক্ষেত্রে ২২০ টাকা, ৩শ’ ও ৪শ’ টাকা পর্যন্ত কোর্ট ফি দিতে হয়। রিটে এনেক্সারের সংখ্যা বেশি হলে এনেক্সার প্রতি ২০ টাকা করে বেশি দিতে হয়। দেয়াওয়ানি মামলায় কোর্ট ফি দিতে হয় ৫৫ পয়সা থেকে ৪২ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। কোম্পানি নিবন্ধনে কোর্ট ফি শোধ করতে হয় অনুমোদিত পুজির ওপর। কোম্পানি ভেদে ৫ হাজার থেকে ৮০/৯০ লাখ পর্যন্ত কোর্ট ফি দিতে হয়।

সূত্রটি আরও জানায়, বর্তমান বাজার দর, মূল্যস্ফীতিসহ নানা কারণে মামলা পরিচালন ব্যয় অনির্ধারিত হারে বাড়ানো হলেও কোর্ট ফি পরিশোধ করা হচ্ছে দেড়শ’ বছরের পুরনো আইনে নির্ধারিত হারে। সময় ও বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ শাসনের বহু আইন সংস্কার করা হলেও হাত দেয়া হয়নি গুরুত্বপূর্ণ এ আইনটিতে। কোর্ট ফি বাড়ানো হলে বিচারপ্রার্থীর মামলা পরিচালনা ব্যয় বেড়ে যাবেÑ এমন যুক্তিতে বহাল রাখা হয়েছে মান্ধাতা আমলের এ আইন।

আইনজ্ঞদের মতে, ১৮৭০ সালের কোর্ট ফি আইনের দোহাই দিয়ে একচেটিয়া সুবিধা নিচ্ছেন একশ্রেণির আইনজীবী। তারা আইনগত সহায়তার নাম করে বিচারপ্রার্থী এবং রাষ্ট্র উভয়কেই ঠকাচ্ছেন। একদিকে তারা নানা খরচের কথা বলে বিচারপ্রার্থীর কাছ থেকে স্বনির্ধারিত হারে ফি আদায় করছেন। অন্যদিকে কোর্ট ফি পরিশোধ করছেন নামমাত্র। কোর্ট ফি নামমাত্র হওয়ার যুক্তিতে বিচারপ্রার্থী আইনজীবীকে ফি কম দিতে পারছেন না।

আইনজীবীরা জানান, মোকদ্দমার মূল্যমানের ওপর বা দাবির মূল্যমানের ওপর কোর্ট ফি নির্ধারিত হয়। তায়দাদের ওপর ২% এবং উক্ত ২% এর ওপর ১৫% ভ্যাট। এভাবেই কোর্ট ফি নিরূপিত হয়। অর্থাৎ মোট (২% + ২% এর ১৫%= কোর্ট ফি)। মানি স্যুট বা অর্থঋণ মোকদ্দমার ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন কোর্ট ফি হলো ৩শ’ টাকা এবং সর্বোচ্চ কোর্ট ফি হবে ৫০ হাজার টাকা।

দেওয়ানি মোকদ্দমার সর্বনিম্ন কোর্ট ফি ৩শ’ টাকা। সর্বোচ্চ কোর্ট ফি ৪০ হাজার টাকা। সাকসেশন উত্তরাধিকার মোকদ্দমায় ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ফ্রি। পরবর্তী ১,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত ১% এবং পরবর্তী ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ২%। যেমন : কোনো মোকদ্দমার তায়দাদ ধরা হয়, ১৫ লাখ টাকা। এর কোর্ট ফি ১৫ লাখ টাকার ২%=৩০,০০০ টাকা ৩০,০০০ টাকার ১৫%= ৪,৫০০ টাকা। মোট কোর্ট ফি লাগছে ৩০,০০০+৪,৫০০=৩৪,৫০০ টাকা।

আইনজ্ঞরা মনে করেন, কোর্ট ফি’র এই হার আপাত: দৃষ্টিতে দরিদ্রবান্ধব মনে হলেও এর বহুমাত্রিক কুফলও রয়েছে। বিত্তশালীরা মামলা ঠুঁকে দিচ্ছেন কথায় কথায়। সর্বোচ্চ মাত্র ৫০ হাজার টাকার কোর্ট ফি পরিশোধ করে তারা মামলার মধ্য দিয়ে দাবি করছেন শত শত কোটি টাকা। যদিও এ ধরনের মামলার অধিকাংশ বাদীই পরিণতি দেখে যেতে পারেন না। কিন্তু অপ্রয়োজনীয় এসব মামলা আদালতগুলোতে মামলা জট বাড়ার অন্যতম কারণ।

আইনজ্ঞরা জানান, সংবিধানে আইনের আশ্রয় লাভ কিংবা বিচার পাওয়ার অধিকার সব নাগরিককে দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের প্রবণতা এমন হয়ে উঠেছে যে, কোর্টে যখন এলাম, চাচার বিরুদ্ধে একটা মামলা করেই যাই! আবার কেউ কেউ মনে করেন, মামলাই যেন একমাত্র সমাধান। মামলার মাধ্যমে আইনি সমাধান মিলতে পারে। কিন্তু সাধ্যের আওতায় বিচার নিশ্চিত করতে আড়াইশ’ বছরের পুরনো হারে কোর্ট ফি আদায় করাটা যৌক্তিক মনে হয় না। তাই এ আইনটি হালনাগাদ করা প্রয়োজন।

এদিকে ১৮৭০ সালের কোর্ট ফি আইন সংশোধনের কোনো পরিকল্পনা আছে কি-না জানতে চাইলে সাবেক আইন মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, বিচার বিভাগ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধানতম স্তম্ভ। এটি কোনো বাণিজ্যিক কার্যক্রম নয় যে, বিচারপ্রার্থী মানুষের কাছ থেকে রাষ্ট্র আয় করবে। আইন সংশোধন করে কোর্ট ফি বাড়ালে মামলা পরিচালনা ব্যয় বাড়বে। দরিদ্র বিচারপ্রার্থীর ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কোর্ট ফি আদায়
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ