Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

‘এ দুনিয়া কবির হাটবাজার’

প্রকাশের সময় : ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টালিন সরকার : ফেব্রুয়ারী শুধু ভাষার মাস নয়; কবি-সাহিত্যিকদের উচ্ছ্বাসের মাসও বটে। ২১ ফেব্রুয়ারী উপলক্ষে এ মাসে বাংলা একাডেমীতে পুরো মাসজুড়ে বই মেলায় কবি-সাহিত্যিক, শিল্পরসিকদের মিলনমেলা ঘটে। প্রতিভাবানরা গল্প, কবিতা, উপন্যাস, আত্মজীবনীসহ নানান রকমের বই প্রকাশ করেন। পাঠকরা সে বই পড়ে জ্ঞানার্জন করেন। কথায় আছে ‘যে জাতির ভাষা, সাহিত্য সমৃদ্ধ সে জাতি তত উন্নত’। সারাবছর বই বের হলেও শুধু বই মেলার এক মাসে ৪ থেকে ৫ হাজার গল্প-কবিতার বই বের হয়। বই মেলার চিত্র দেখে মনে হলে ‘এ দুনিয়া বইয়ের হাটবাজার’। স্বীকার করতেই হবে জাতি হিসেবে শিল্প-সাহিত্যে আমরা সমৃদ্ধ। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর যে হারে বই বের হচ্ছে সে হারে কি পাঠক বাড়ছে? গল্প-কবিতার সব লেখাই কি প্রকৃত লেখা হয়ে উঠছে? তথ্য প্রযুক্তির যুগে যখন গুগলে সবকিছু পড়া যায় তখন কি পাঠকদের এসব বই টানতে পারছে? মান সম্পন্ন বই সারা বছর বিক্রী হয়। শিল্প-সাহিত্য নিয়ে প্রচুর গবেষণাও হচ্ছে। কিন্তু ---?
ছোটবেলায় বাথরুমে গুনগুনিয়ে গান করেননি/কবিতা লেখেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাই বলে সবাই কবি বা শিল্পী হবেন এমন কথা নেই। মেধা ও প্রতিভা দু’টি ভিন্ন জিনিস। প্রতিভা আল্লাহ প্রদত্ত। চর্চা করে কবি-সাহিত্যিক হওয়া যায়। কিন্তু খোদার দেয়া প্রতিভা অন্য জিনিস। এটাও ঠিক সাহিত্য চর্চা মানুষের মস্তিষ্ককে কুচিন্তা থেকে বিরত রাখে। কিন্তু বই মেলায় যে এতো এতো বই বের হচ্ছে তার কয়টা মানসম্পন্ন? প্রখ্যাত লেখক প্রবীণ সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদ ১৬ ফেব্রুয়ারী একটি জাতীয় দৈনিকে ‘জঙ্গলের জন্য বৃক্ষ দেখা যায় না’ শীর্ষক এক উপসম্পাদকীয়তে লিখেছেন, যারা লেখালেখি করেন বই মেলায় তাদের ২/৩ টা বই বের না হলে যেন মান সম্মান থাকে না। তাই তারা বই বের করার জন্য অস্থির হন। অথচ দেশের শক্তিমান কবি হেলাল হাফিজ দু’দিন আগে চ্যানেল ২৪-এ এক আলোচনায় বলেছেন, ‘আমার শত শত কবিতা রয়েছে। যেগুলো কোনোদিন আলোর মুখ দেখবে না। কারণ, আমি মনে করি ওগুলো প্রকাশ করার প্রয়োজন নেই’। সৈয়দ মকসুদ তার লেখায় এক কবির কবিতার পংক্তি তুলে ধরেছেন ‘আকাশের ঘাসের নদীতে/ খেলা করে শিশুর স্তন/ নর্দমায় সোনা ঝরে শস্যের মতো,/ কালো বিছানায় সুগন্ধ গোবর/ চামচিকা মহাকাশের গর্তে অক্সিজেন নাড়াচাড়া করে।’ এই কবিতার মর্মার্থ বুঝতে পারেননি গবেষক সৈয়দ মকসুদ। বর্তমানে বাংলাভিশনে একটি ধারাবাহিক চলছে। ওই নাটকের চরিত্রে ডা. এজাজ প্রেসের মালিক। কিন্তু তার কবি হতে ইচ্ছে করে। প্রচ- অর্থ সংকটে থাকা এক কবি তার কবিতার বই প্রেসে ছাপাতে গেলে এজাজ তার কাছে কবি হওয়ার বাসনা প্রকাশ করেন। পা-ুলিপি নিয়ে এ প্রকাশনালয় ও প্রকাশনালয় ঘোরাঘুুরি করা কবি জানতে চান আপনি কবিতা লিখতে পারেন না, কিন্তু কিভাবে কবি হবেন? এজাজের সহজ সরল উত্তর ‘আপনার কবিতার বইয়ের ওপর আমার নাম বসিয়ে দিলেই আমি কবি হয়ে যাব! প্রয়োজনে আপনাকে কিছু---’। কবি হওয়া বা গল্প-উপন্যাস লেখা সত্যিই কি ছেলেখেলা! কবিতা লেখা, সাহিত্য রচনা বা যে কোনো শিল্পকর্ম হচ্ছে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। দেখার বোঝার দৃষ্টিশক্তির কারণেই প্রতিভাবানদের মাথায় এমনিতেই কবিতা আসে; এসে যায়। এমনো হয়, হঠাৎ করে একটা-দু’টা লাইন এসে গেল, পরে চলে এর সম্প্রসারণ। কবি-লেখকরা এভাবেই তাদের বিখ্যাত বিখ্যাত রচনার রহস্যের কথা পাঠকদের জানিয়েছেন। তা না হলে রুটির দোকানের কর্মচারী কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্বখ্যাত কবি হবেন কেন? তার কি উচ্চ ডিগ্রী ছিল? রবীন্দ্র নাথের ক্ষেত্রেও একই কথা। কেউ উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। আবার ২১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করা সুকান্ত ভট্টাচার্যের কথাই ধরুন। এতো অল্প বয়সে তার মাথায় যা এসেছে তিনি যা রচনা করে গেছেন তা গবেষণা করতেও শত শত বছর লেগে যাবে। অতএব, প্রতিভা আল্লাহ প্রদত্তই। আর চর্চার মাধ্যমে কিছুটা অগ্রসর হওয়া গেলেও জোর করে প্রতিভা হয় না।
একুশের বই মেলায় বই প্রকাশের এলাহিকা- দেশে মনে হলো বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানুষের ভোটের অধিকার থাক না থাক, মানবাধিকার নিত্যদিন রাস্তায় গড়াগড়ি দিতে থাক। কিন্তু দেশ হয়ে গেছে কবি-সাহিত্যিক আর লেখকদের মহাসমুদ্র। নিজের অফিসে কবিতার বই প্রকাশের হিড়িকের চিত্র দেখেও তাই মনে হয়। চারপাশে যেদিকে তাকাই এখন কেবল কবি আর লেখক। পাঠক নন সবাই লেখক। লাল কবি, নীল কবি, সতেজ কবি, নিস্তেজ কবি, লম্বা কবি, বেঁটে কবি, প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি, ছ্যাঁকা খাওয়া কবিতে ভরে গেছে দেশ। কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা বেশি প্রবচন যেন সত্যি হয়ে ধরা দিয়েছে এই জগৎ সংসারে। বই মেলায় কয়েকটি স্টলে ঘুরে দেখা গেল বেশ মান সম্পন্ন কিছু কবিতার বই এসেছে। কম হলেও সে বইগুলোর দু’চারটে বিক্রী হচ্ছে। কিন্তু অসংখ্য কবিতার বই উল্টেপাল্টে দেখে মনে হলো এ বইয়ের কবিতার শিল্পমান উদ্ধারের কর্ম্ম সাধারণ পাঠকের নয়। আমাদের মতো স্বল্প মেধার পাঠকদের জন্য উচ্চমার্গের এগুলো রচিত হয়নি। উচ্চমার্গের পাঠকরাই হয়তো এগুলোর সমঝোতার পাঠক! খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বই মেলায় যে বই এসেছে তার অধিকাংশই কবি লেখকরা নিজেদের টাকায় বই ছাপিয়েছেন। যার কারণে বইয়ের মান, বইয়ের ভিতরে কি লেখা রয়েছে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই প্রকাশকদের। অনেক প্রসিদ্ধ প্রকাশনীও কবির টাকায় বই ছাপিয়েছে। বাংলা একাডেমীর বই মেলা উপলক্ষে প্রকাশকদের অবস্থা এমন লেখকের টাকার বই ছাপালে শিল্পমান দেখার প্রকাশক কে? কবি-লেখকরা নিজের বই ছাপিয়ে এনেছেন নিজের টাকায়। তাদের প্রয়োজন কবি-সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিতি এবং সমাজে যশ-খ্যাতি। টাকার কোন অভাব নেই, চাই শুধু ছাপার অক্ষরে নিজের নাম। অনেকেই আবার নিজেরাই গুগুল ঘেঁটে কোনো এক চিত্র নিয়ে নিজেই বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন। মলাট উল্টে এখন সেই বইয়ের ভেতর ছাইপাশ যাই থাক কোন সমস্যা নেই। বিক্রি হোক না হোক সমস্যা নেই। বই বের হয়েছে সেটাই যথেষ্ট। বাংলা একাডেমীর ঐতিহ্যের বই মেলা যেন হয়ে গেছে কবিদের হাটবাজার। সৃজনশীল প্রকাশনী সংস্থাগুলো হয়ে গেছে কবি-লেখক তৈরির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফ্যাক্টরী। বই মেলায় প্রতিদিন নিত্য নতুন কবি; গল্প-কবিতার বই আসছে বানের পানির মতো। কিনুক না কিনুক বিক্রী হোক না হোক; মানুষ বই উল্টেপাল্টে দেখছে দরদাম করছে সব মিলিয়ে বই মেলা এখন যেন জমজমাট সাহিত্য সওদার তীর্থস্থান।
শিল্পমান সম্পন্ন লেখা সব কবি-লেখকের রচনায় পাওয়া যাবে এমন নয়। হুমায়ূন আহমদের লেখার শিল্পমান নিয়ে যতই বিতর্ক হোক তিনি বাংলাদেশে পাঠক সৃষ্টি করে গেছেন। এক সময় শরৎচন্দ্র, রোমেনা আফাজ বা সেবা প্রকাশনীর আনোয়ার হোসেনের বই বিক্রী হতো মুড়িমুড়কির মতো। দীর্ঘ বিরতির পর হুমায়ুন দেশের তরুণ-তরুণীদের বইমুখী করেন। এ সময়ের মরহুম আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আহমদ ছফা, আহমদ শরীফ, রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, বাপ্পী শাহরিয়ার এবং হাসান আজিজুল হক, মঞ্জু সরকার, বদরুদ্দিন উমর, ফরহাদ মজহারের লেখার মতো মান সম্পন্ন লেখা সবার কাছে প্রত্যাশাও করে না। কিন্তু গল্প-কবিতা যাই হোক সেটাতো হতে হবে বর্তমান সময়ের মানুষের জীবনাচার, চাওয়া পাওয়া, প্রত্যাশা-প্রাপ্তি এবং বাস্তবতার আলোকেই। কিন্তু কতজন লেখকের লেখায় তা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে? বরং অবাস্তব, আজগুবি, অশ্লীল, বিকৃত রুচির লেখার যেন ছড়াছড়ি। যারা কবি বা লেখক হিসেবে নিজেদের জাহির করতে বই লিখছেন, গাঁটের টাকা খরচ করে প্রকাশ করছেন তাদের কথা বাদ। হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশের রচনার সঙ্গে পরীক্ষার খাতায় লেখা গরুর রচনার তেমন পার্থক্য করা কঠিন। কিন্তু যারা কবি-লেখক হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত তাদের কতজনের সৃষ্টি পাঠযোগ্য? কতজনের লেখা শিল্প সম্পন্ন? কতজনের লেখা অর্থবোধক? বই মেলায় প্রায় অর্ধশত বই হাতাহাতি করেছি। এর মধ্যে অর্ধেক কবিতার বই। ওই সব কবিতার মর্মার্থ, অর্থ বোঝা কঠিন। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত এক কবির বই হাতে পেয়ে মনে হলো এই আমাদের সাহিত্য! এ কবিতার অর্থ বোঝা সাধ্য কার! প্রতিষ্ঠিত ওই কবির ৩৭টি কবিতা নিয়ে একটি বই প্রকাশ হয়েছে। বইয়ের প্রথম কবিতা হুবহু এমন ‘গুরুশিক্ষাঃ কবিতার ম্যানুফেক্সারিং ক্লাব’ ‘আমি তোমারে কাব্য শিখামু আর/ ক-তে কলাবিদ্যা/ খÑতে খুনসুটি/ গ-তে গিরস্থলি/ ঘ-তে ঘাইবিদ্যা/ ঊ-তে উম/ যাতনার প্রত্যেক লাখ ফোঁটা তখন হয়ে যাবে এককটি জালালি কবিতা’। ‘বিয়ের বিয়া- সমান সমান্তরাল’ নামের কবিতা এমন ‘মহিলা ঃ ভাইরে যা দেখছেন টাইটফিট, তবে ভেতরে ঝুলে গেছে/ একটু খোঁজ নিন। পুরুষ ঃ আফা কিযে কন না! বহুদিন ঘেঁষানন্দে দেখেছি/ মাটি ফুড়ে বেড়ি আসা/ এক মর্মর মূর্তি, মহিলা ঃ তবে কন্যার এক আরেকটু/ ঝাঁকিয়ে দিন, পুরুষ ঃ চলে এই অধমও বিপতœীক’। ‘রেড সিগন্যাল থামো সংক্রান্ত’ আরেক কবিতা এমন ‘কি করো কি করো অইহানে ভাইয়ের লগে/ ভার্য্যবিহীন? ভাইসব আমি কিন্তু বেকার কয়ে দেব/ লুত-এর কাছে/ ঊর্ধ্বলোকে উঠে উপুড় হয়ে পড়ে যাবা সব ভূতল গহন!’ সর্বশেষ কবিতা গল্পের মতো লেখা হুবহু তুলে ধরা হলো ‘বুক নয় তোমার ওড়নার ভেতর দিয়ে আমার পৌঁছে যাবো ভেতরের ভেতর নীচে থাকুক না জিন্স হিল কোনো আপত্তি নেই, বোন বহিনরে তুমি হাঁইটা যাও ভেরেরর লাজুকতা চরিত্র ঋণ করে পথ-পথান্তর গৃহ-গ্রাহান্তর, কোনো বাধা নেই যতিচহ্নি নেই বোন বহিনরে যে বিষয়টি নিয়ে এত শত কথা চক্র তার চর্চা পশ্চিমে বহুত হয়েছে তার উঁচু চিকোলো ঝাপটায় অনেক অনেক গগন ভূমিতে পড়ে টুকরো হয়ে গেছে, ভাই সব অনেক ধরেছে গীত আহারে আহারে আমি কোথায় পাব তারে আহারে যাকে যাদের খোঁজো তিনারা আছে নম্র বক্ষের ভেতর অনেচান ছৈল ধরে যাবে রেস্তোরাঁয় যবে কনসার্টে পথ বড়ই হিবিজিবি উথাল পাথাল কোথাও সে তিনারা সেই, বুক আটকে দাও চোখ আটকে দাও আলোতীর সেই বন্ধ চোখে ঢুকে ঠিক ঠিকই দেখিয়ে দেবে কোথায় কোনখানে আছে ঘাপটি মাইরা সে সে এবং তিনি’। এই হলো আমাদের বাংলা সাহিত্যের প্রতিষ্ঠিত এক কবির কবিতা। প্রতিষ্ঠিত কবির কবিতার যদি এই হাল হয় তাহলে ---।

 



 

Show all comments
  • Hasan ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১:১৬ পিএম says : 0
    that is really true
    Total Reply(0) Reply
  • তানবীর ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১:১৮ পিএম says : 0
    হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর যে হারে বই বের হচ্ছে সে হারে পাঠক বাড়ছে না।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ‘এ দুনিয়া কবির হাটবাজার’

১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ