দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
আম্মাজান আয়েশা রা বলেন, একদিন আমার নিকট একজন ভিক্ষুক নারী এলো। সাথে ছিল তার দু’টি কন্যা। তাকে আমি তিনটি খেজুর দিলাম। সে খেজুর তিনটি থেকে দু’টি দুই মেয়েকে দিল। আরেকটি নিজে খাওয়ার জন্য মুখের কাছে নিল। এমতাবস্থায় সেই একটি খেজুরও মেয়েরা খেতে চাইল। আর অমনি সেই খেজুরটিকে সে দুই ভাগ করে দুই মেয়ের মুখে উঠিয়ে দিল। আয়েশা রা বলেন, এ ঘটনা আমাকে প্রচন্ডভাবে নাড়া দিল। ফলে ঘটনাটি আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শুনালাম। সব শুনে তিনি বললেন, নিশ্চয় এই খজুরের বদলায় আল্লাহ তাআলা এই মা এর জন্য জান্নাত ওয়াজিব করে দিয়েছেন। অথবা তিনি বলেছেন, নিশ্চয় এই খজুরের বদলায় আল্লাহ এই মাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়েছেন। [মুসলিম, হাদীস: ২৬৩০] সন্তানের প্রতি বাবা-মার দরদ ও ভালোবাসা এমনই হয়। নিজে উপোস থেকে মুখের খাবার সন্তানকে খাইয়ে পরম তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন মা-বাবা। কিন্তু মানুষের ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি অবহেলা, অজ্ঞতা, সামাজিক, মানসিক ও আদর্শিক নানা পরিবর্তনের কারণে বর্তমানে একান্নবর্তী পরিবার বা যৌথ ফ্যামেলি ব্যবস্থা ক্রমশই ভেঙ্গে পড়ছে। পাশাপাশি ধর্মের প্রতি অনুরাগ হ্রাস পাওয়ায় বাবা-মা সন্তান-সন্ততির কাছে চরমভাবে অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন এবং যে সন্তান বাবা-মাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারতো না, যে বাবা-মাই ছিল এক সময়কার সকল কিছুর ভরসা ও আশ্রয়স্থল, সেই বাবা-মাকেই তারা আজ উটকো ঝামেলা মনে করছে! ফলে তাঁদেরকে রেখে আসছে বৃদ্ধাশ্রমে বা বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছে অবলীলায়। কিংবা অবহেলা ও দুর্ব্যবহার করে এমন অবস্থার সৃষ্টি করছে যে, তারা নিজেরাই বাধ্য হয়ে বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাচ্ছে অথবা নিজের বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছে। ঠুনকো ঠুনকো অজুহাতে জন্মদাতা বাবা-মা এর সাথে চরম দূর্ব্যবহার করছে কিংবা বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ফলে পরিবার ও সন্তান-সন্ততি থাকা সত্তেও তারা কষ্টের পাথর বুকে চেপে নিদারুণ জীবন যাপন করছেন। একজন মা বা বাবার পক্ষে এরচে’ বড় দঃখ আর কি হতে পারে? বিভিন্ন সময়ই বৃদ্ধাশ্রম থেকে সন্তানদের কাছে লেখা বৃদ্ধ বাবা-মার চিঠি পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়। যা পড়ে চোখের পানি সংবরণ করা যায় না। একজন দু’জন নয়, অসংখ্য বাবা-মা প্রতিদিন চোখের জলে বুক ভাসিয়ে যাচ্ছেন। আর অপেক্ষা করছেন কাফনের কাপড়ের জন্য। আজকে আমরা যারা বাবা-মাকে অবহেলা করছি, তাদেরকে ‘ভারী বোঝা’ মনে করে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে রেখেছি কিংবা তাদের সাথে দূর্ব্যবহার করছি, তারা কি একবারো ভেবে দেখেছি আজ তারা বৃদ্ধ। একদিন আমরাও বৃদ্ধ হবো। তখন আমাদেরও যদি বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে হয়, তাহলে কেমন হবে? আরও ভাবা দরকার, আজ তারা বৃদ্ধ। তারা তো পৃথিবীতে বৃদ্ধ হয়ে আসেননি। তারা তো পরিবারের বোঝা ছিলেন না; বরং আমরা সন্তানরাই তো তাদের বোঝা ছিলাম। তারা তো কখনো আমাদেরকে বোঝা মনে করেননি; বরং পরম আদরে বুকে টেনে নিয়েছেন। আগলিয়ে রেখেছেন পরম যত্নে। গর্ভধারণ, প্রসব, স্তন্যদান, ভেজা কাপরে রাত কাটানো ইত্যাদির কি সীমাহীন কষ্ট মা সহ্য করেছেন তার কি বিবরণ দেওয়া সম্ভব? পৃথিবীর সকল মায়েরাই এ কষ্টগুলো সহ্য করে থাকেন। আল্লাহ তাআলা মায়ের কষ্ট ও তাদের প্রতি সন্তানদের করণীয় বর্ণনা করে কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেছেন, ‘আর আমি মানুষকে তার মা-বাবার সাথে ভালো ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। কারণ তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট সয়ে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দু ছাড়ানো হয় দু’ বছরে। [আমি আরো নির্দেশ দিয়েছি] তুমি কৃতজ্ঞ হও আমার ও তোমার মা-বাবার প্রতি। অবশেষে আমার নিকটই ফিরে আসতে হবে। আর মা-বাবা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন কোনো কিছু শরীক করতে চাপ প্রয়োগ করে, যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তুমি তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করবে। তুমি তার পথই অনুসরণ করবে যে আমার অভিমুখী হয়।’ [ লুকমান:১৪-১৫] বর্ণিত আয়াতের ‘দুনিয়াতে তুমি তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করবে’ এই অংশটুকু অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, মা-বাবা কাফের হলেও দুনিয়াতে তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে। আল্লাহর অবাধ্যতা হয়, এমন ক্ষেত্রে তাদের কথা মানা না গেলেও অন্য সকল ক্ষেত্রেই তাদের সাথে উত্তম আচরণ করতে হবে। তাদের সাথে বেআদবী ও অশালীনতাপূর্ণ আচার-আচরণ করা যাবে না। তাদের মনোবেদনার উদ্রেক হয়, এমন কোনো কাজ করা যাবে না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাকে ছাড়া আর কারো ইবাদত করো না এবং মা-বাবার সাথে সদ্ব্যবহার কর। মা-বাবার কোনোও একজন কিংবা উভয়ে যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে উফ্ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না; বরং তাদের সাথে সম্মানজনকভাবে কথা বল এবং তাদের প্রতি মমতাপূর্ণ আচরণের সাথে তাদের সামনে নিজেকে বিনয়াবনত কর এবং এই দুআ কর, হে আমার প্রতিপালক! তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছেন, তেমনি আপনিও তাদের প্রতি দয়া করুন।’ [ বনী ইসরাঈল: ২৩-২৪] উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসিসরীনে কিরাম লিখেছেন- বাবা-মার সেবা-যত্ন ও আনুগত্য কোনো সময় ও বয়সের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়; বরং সব বয়সেই এবং সর্বাবস্থায় মা-বাবার সেবা-যত্ন, আনুগত্য ও তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করা ফরজ। তবে মা-বাবা বার্ধক্যে উপনীত হলে সন্তানের খেদমত ও সেবা-যত্নের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে এবং তাদের জীবন নির্বাহ সন্তানের দয়া ও কৃপার উপর পুরোপুরি নির্ভশীল হয়ে পড়ে। অপরদিকে বার্ধক্যের উপসর্গসমূহ স্বভাবগতভাবেই মানুষকে খিটখিটে করে দেয়। তৃতীয়য়তঃ বার্ধক্যের শেষ প্রান্তে বুদ্ধি-বিবেচনাও যখন অকেজো হয়ে পড়ে, তখন তাদের বাসনা ও দাবী-দাওয়াও এমনি হয়ে যায়, যা পূর্ণ করা সন্তানের পক্ষে কঠিন হয়। এহেন অবস্থায়ও তাদেরকে উহ্ বলা বা বিরক্তি প্রকাশ পায় এমন কোনো শব্দ উচ্চারণ কিংবা বিরক্তিবোধক দীর্ঘশ^াস ছাড়াও নিষেধ। [মাআরিফুল কুরআন: ৪৫৮-৪৫৯] যেই বাবা-মার আচার-আচরণে কষ্ট পেয়ে বিরক্তিবোধক দীর্ঘশ^াস ছাড়াও হারাম ও নিষেধ, সেই বাবা-মাকে ঠুনকো অজুহাতে বার্ধক্যে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়ে কিংবা বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে অথবা তাঁদের দাবী-দাওয়া পুরো না করে স্ত্রী সন্তানাদী নিয়ে সুখের পিদিম জেলে তৃপ্তিবোধ করা যে কতখানি অমানবিক ও অন্যায়, মনে হয় তা বলে বুঝানোর অপেক্ষা রাখে না। মা-বাবাকে অবহেলা করা এবং তাদের যথাযথ সেবাযত্ন না করা ইহকাল ও পরকালে বরবাদী ডেকে আনে। সাহাবী জাবের ইবনে আব্দুল্লাহর বর্ণনায় এক হাদীসে আছে- তিনি বলেন, একদা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেম্বারে আরোহণ করলেন। প্রথম ধাপে উঠে বললেন, আমীন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপেও উঠে বললেন আমীন। সাহাবাগণ জিজ্ঞাস করলেন, ব্যাপার কি ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি এভাবে তিনবার আমীন বললেন। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি যখন মেম্বারের প্রথম সিড়ীতে উঠলাম তখন জিবরীল আ. আগমন করে বললেন, সেই ব্যক্তি হতভাগা, যে রমযান পেয়েও নিজ গুনাহ মাফ করাতে পারলো না। আমি বললাম আমীন। অতপর বললেন, সেই ব্যক্তি হতভাগা, যে বাবা-মাকে অথবা কোনো একজনকে পেল অথচ তারা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করালো না। [ অর্থাৎ সে বাবা-মার খিদমত করে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারলো না।] আমি বললাম আমীন। তৃতীয় বার বললেন, সেই ব্যক্তি হতভাগা, যার সামনে আপনার নাম উচ্চারিত হলো আর সে আপনার উপর দুরুদ পাঠ করলো না। আমি বললাম আমীন।’ [ আল আদাবুল মুফরাদ, ইমাম বুখারী, হাদীস: ৬৪৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস: ৭৪৫১] জিবরীল আ. বদদুআ আর তাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আমীন বলা, এ দুটো বিষয় লক্ষ্য করলেই বুঝতে বাকী থাকে না যে, বাবা-মার সেবা-যত্ন করাটা কত বড় বিষয়। আর না করাটা কত বড় অপরাধ। বিখ্যাত তাবেয়ী উওয়াইস কারনী রহ. এর কথা তো আমাদের সবারই জানা যে তিনি মায়ের সেবার কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সাক্ষাৎ করে সাহাবী হওয়ার সুমহান মর্যদা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এরপরও উমর রা.কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উওয়াইস কারনী রহ. এর দ্বারা দুআ করানোর অসীয়ত করে গিয়েছিলেন। [মুসলিম, হাদীস: ২৫৪২] এ ছাড়াও বহু হাদীসেই মা-বাবার সেবা-যত্নের তাকীদ ও সুফল আর না করার কুফলের কথা বর্ণিত হয়েছে। উপরোক্ত আয়াত ও হাদীসগুলোর আলোকে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় একজন মুমিন স্বীয় বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে রাখা কিংবা তাদের খারাপ আচরণের কল্পনাও করতে পারে ন। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও মানবতার দাবী এটাই। তাই মা বাবা জীবিত থাকলে সন্তানের করণীয় হলো-১. তাঁদের চাহিদা ও দাবীগুলো পূরণের যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। ২. তাদেরকে কখনো ধমক দেওয়া যাবে না। দিলে মারাত্মক ধরণের কবীরা গুনাহ হবে। ৩. কোনো অবস্থাতেই কোনো ধরণের দূর্ব্যবাহার করা যাবে না। ৪. তাঁরা কষ্ঠ পায় এমন কোনো আচরণ বা কাজ করা থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। ৫. তাদেরকে সম্মান দিয়ে বিনয়ের সাথে কথা বলতে হবে। ৬. তাদের প্রতি মমতাপূর্ণ আচরণর করতে হবে। ৭. তাদের সামনে নিজেকে ছোট করে পেশ করা। ৮. তাদের যেন ইহকাল-পরকালে মঙ্গল হয় সর্বদায় এই দুআ করতে থাকা। আর যদি মারা গিয়ে থাকেন, তাহলে করণীয় হলো- ১. তাঁদের পরকালীন নাজাত ও মুক্তির জন্য জায়েয পদ্ধতিতে বেশি বেশি ইসালে সওয়াব করতে থাকা। ২. হজ¦ ফরয হওয়া সত্তেও না করে থাকলে বদলী হজে¦র ব্যবস্থা করা জরুরী। এভাবে নামায, রোযা, যাকাত আদায় না করে থাকলে সেগুলো যথানিয়মে আদায়ের ব্যবস্থা করাও খুবই জরুরী। ৩.তাঁদের কোনো বৈধ অসিয়াত থাকলে সেগুলো পুরো করার চেষ্টা করা। ৪. অসমাপ্ত কোনো নেক কাজ থাকলে সমাপ্ত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করা। ৫. তাঁরা যেন সর্বদায় সওয়াব পেথে থাকেন, এমন কোনো সদকায়ে জারীয়ার ব্যবস্থা করা। ৬. তাঁদের আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সুসম্পর্ক রাখা। ৭. তাঁদের বন্ধ-বান্ধবদের সাথে সুসম্পর্ক রাখা। ৮.কারো সাথে কোনো অঙ্গিকার করে থাকলে তা পুরো করা। [ সুরা বনী ইসরাঈল, আয়াত: ২৩-২৪; তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন:৫/৪৫৭; শুআবুল ঈমান, বাইহাকী, হাদীস ৭৫১৪, ৭৫২৩]
লেখক : সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া মাখযানুল উলূম, তালতলা মোমেনশাহী, ইমাম ও খতীব, মসজিদুল আমান, গাঙ্গিনারপাড়, মোমেনশাহী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।