Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পাশবিকতাকে হার মানালো যে ঘটনা...

প্রকাশের সময় : ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হাসান-উজ-জামান : মাটির ভেতর থেকে বেরিয়ে আছে শিশুর হাত! দেখা যাচ্ছে কারো হাটু, কারো মাথা। এক এক করে বের করা হয় চার শিশুর লাশ। কোমলমতি নিষ্পাপ এসব শিশুদের হত্যা করে মাটি চাপা দেয়া হয়। নিহত এসব স্কুলশিশু হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রাম থেকে নিখোঁজ হয় ঘটনার পাঁচ দিন আগে। নির্মম এ খবরে গতকাল ঘুম ভাঙে বাংলাদেশের।
বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, মানুষের বিবেক মরে গেছে। আমাদের চরিত্রের মধ্যে হিং¯্র মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে। নষ্ট হয়ে গেছে সামাজিক মূল্যবোধ। শিশু নির্যাতনের কথা বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সিলেটের রাজন, খুলনার রাকিব বা বরগুনার রবিউলের নিষ্পাপ মুখগুলো। চরম নিষ্ঠুুরতায় এসব শিশুদের হত্যাকা- সকল বিবেকবান মানুষকে নাড়া দিয়েছে। সেসব স্মৃতি ভুলতে না ভুলতেই বছরের শুরুতে কেরানিগঞ্জে শিশু আবদুল্লাহসহ কয়েক শিশুকে অপহরণের পর লাশ উদ্ধারের ঘটনা ঘটে। কিন্তু সকল অমানবিকতা, বর্বরতা ও হিং¯্রতাকে হার মানিয়েছে হবিগঞ্জের ঘটনা। মানবাধিকার কর্মীদেরই প্রশ্ন এমনও অমানুষ কেউ হতে পারে? চারপাশের এসব নির্মম ঘটনা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে সমাজ ব্যবস্থাকে।
শিশুদের ওপর নির্যাতন প্রসঙ্গে কয়েকমাস আগে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সেভ দ্য চিলড্রেনের কান্ট্রি ডিরেক্টর ম্যাক কার্ল বলেছিলেন, পৃথিবীর সব রাষ্ট্রেই শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। অন্যান্য দেশে নির্যাতনের সাথে যারা জড়িত তারা সকলেই জন্মগতভাবে অপরাধপ্রবণ। বাংলাদেশে যারা এ ধরনের অপরাধ করছেন তাদের বেশিরভাগই বিত্তবান শ্রেণির। এসব ঘটনায় প্রশাসনের সাথে সংশ্লিষ্টদেরও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। শিশু নির্যাতনের সাথে জড়িতরা নরপশুর চেয়েও জঘন্য।
অভিযোগ রয়েছে, মাসখানেক আগে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রামে ওয়াহিদ মিয়ার সঙ্গে প্রতিবেশী আব্দুল হাইয়ের বিবাদ হয়। এর জের ধরে ওয়াহিদ মিয়ার ছেলে ও তার ভাইদের ৭ থেকে ১০ বছর বয়সী স্কুলপড়–য়া ৪ শিশুকে অপহরণ করে আব্দুল হাই। এরপর শিশুদের হত্যা করে মাটিচাপা দেয়া হয়। একই পরিবারের ৪ শিশু নিখোঁজের পর স্থানীয় থানায় প্রথমে জিডি পরে অপহরণ মামলা করা হয়। কিন্তু পুলিশ ওইসব শিশুদের উদ্ধারে কিংবা অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করেনি।
রংপুরের নিউ আদর্শপাড়ার মোছাদ্দেক হোসেন রাঙার শিশুসন্তান রহিমুল ইসলাম রওনক (৪) গত ১ ডিসেম্বর নিখোঁজ হয়। দুই মাস পর গত ৩০ জানুয়ারি রংপুরের মিঠাপুকুর থেকে রওনকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। স্বজনদের অভিযাগ, শিশুটির বাবার সঙ্গে স্থানীয় এক প্রভাবশালীর বিরোধের জের ধরেই এই হত্যাকান্ড ঘটে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়াতেই বারবার শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনার পর রাষ্ট্র ও প্রশাসনের নীরব ভূমিকা অনেক সময় পরোক্ষভাবে এমন ঘটনা ঘটাতে সহায়তা করে। তিনি বলেন, শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে রাজনৈতিক দলগুলোরও কোনো ধরনের ভূমিকা দেখা যায়নি। শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে তাই সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে বলেও অভিমত প্রকাশ করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর মাসুদা এম রশীদ চৌধুরী বলেন, দুঃখ হয়, যখন শিশুদের ওপর চরম আঘাত এনে তাদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন করা হয়। দিনে দিনে বেড়ে চলেছে এ অন্যায়। কিন্তু নেই কোন প্রতিকার। ভবিষ্যত নেতৃত্বের জন্য যে শিশুদের আদর, ভালবাসা ও সুশিক্ষা দিয়ে গড়ে তোলা দরকার, তাদের ওপরই আক্রমণ করা হচ্ছে। কন্যা শিশুদের ধর্ষণ করে জীবন ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। কোথায় সেই ভালবাসা, কোথায় বিবেক? একেই কি বলে সভ্যতা। তিনি বলেন, সকল অন্যায়ের উপুক্ত শাস্তি, নিরপত্তা এবং নতুন প্রজন্মকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পারলেই এ ধরনের নিষ্ঠুরতা কমবে।
সাবেক ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ রোকন উদ-দৌলা (বর্তমানে যুগ্মসচিব, পরিচালক (আইন) রাজউক) বলেন, আমাদের সকলের চরিত্রের মধ্যে হিং¯্র মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে। নষ্ট হয়ে গেছে সামাজিক মূল্যবোধ, উপযুক্ত সাক্ষ্য ও যথাযথ প্রমাণের অভাবে অনেক মামলায় অপরাধীরা শাস্তি পায় না। এটা রোধ করতে হলে আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক মূল্যবোধ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। শিশুদের প্রতি মায়া মহব্বত ও সহজাত মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। সর্বোপরি নিজ বিবেককে সচেতন করতে হবে।
২০১৬ সালের বছরের শুরুর দিকেই শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনার পরিসংখ্যানে এরই মধ্যে যোগ হয়েছে চট্টগ্রামে ১১ বছরের আজিমকে জবাই করে হত্যা, খুলনায় প্রতিবন্ধী মেয়েকে হত্যার পর পিতার আত্মহত্যা। এছাড়া গাজীপুরের ১২ বছরের শিশু শ্রমিক মোজাম্মেলকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা। পারিবারিক ও সামাজিক গ-ির মধ্যে শিশু নির্যাতন ও হত্যার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা। তারা বলেন, মানসিক এবং শারীরিক ভাবে দুর্বল হওয়ায় এমন ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে।
শিশু নির্যাতন ও হত্যার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় মানবাধিকার কর্মীরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, আইনের যথাযথ প্রয়োগ, সকলের নিরপত্তায় রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা, নৈতিক মূল্যবোধ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলাসহ সর্বোপরি নিজের বিবেককে সচেতন করলেই এ ধরনের বর্বরতা বন্ধ হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পাশবিকতাকে হার মানালো যে ঘটনা...

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ