Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৮ জুন ২০২৪, ১৪ আষাঢ় ১৪৩১, ২১ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনে সুনির্দিষ্ট আইন জরুরি

ঢাকা ফোরামের গোলটেবিলে বক্তারা

| প্রকাশের সময় : ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : ঢাকা ফোরাম আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা বলেছেন, বর্তমানে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন, গণতন্ত্র ও সুশাসনের অভাব। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন কমিশন গঠনের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেয়ার উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। কারণ তারা ক্ষমতায় আছেন। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন (ইসি) করতে সুনির্দিষ্ট আইন থাকার জরুরি। পাশাপাশি ইসি গঠনের জন্য সার্চ কমিটিতে যারা থাকবেন তাদের যোগ্যতা এবং বৈশিষ্ট্যগুলোকে পুঙ্খানুপঙ্খভাবে নিরীক্ষা করার কথা বলেছেন বক্তারা।
গতকাল শনিবার সকালে ঢাকায় সিরডাপ মিলনায়তনে ‘নির্বাচন, নির্বাচন কমিশন ও বাংলাদেশে গণতন্ত্র’ শীর্ষক এই গোলটেবিলের আয়োজন করা হয়। ঢাকা ফোরাম আয়োজিত এই গোলটেবিলে সভাপতিত্ব করেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড.এটিএম শামসুল হুদা। সাবেক রাষ্ট্রদূত মাসুদ আজিজের সঞ্চালনায় গোলটেবিলে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সিরাজুল ইসলাম।
মূল প্রাবন্ধিক বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করে বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল ভোটারবিহীন। শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ ভোট দিতে পারেনি। আওয়ামী লীগের উচিৎ একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করা। তারা তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করেছিল। পরে তারাই তা বাতিল করেছে। কিন্তু কোনো বিকল্প তো দেয়নি। এটাও আমাদের ভাবতে হবে। তিনি আরো বলেন, জনগণের হাতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার ফিরিয়ে দিলেই চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান হবে। এতে করে ভারত, শ্রীলঙ্কার চেয়েও আমরা এগিয়ে যাবো।
আলোচনায় অংশ নিয়ে শামসুল হুদা বলেন, সংবিধানেই কিন্তু নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা দেয়া আছে। শুধু সাহস নিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বর্তমান নির্বাচন কমিশন অনেক কিছুই পদক্ষেপ নিতে পারতেন। আইনের দোহাই দিয়ে তো লাভ নেই। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনেরই। কোনো দল নির্বাচনে না আসলে প্রয়োজনে সিডিউল পেছানো যায়। ভয়ের কিছুই নেই। কাজ করতে হবে।
সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, আমাদের বিদায়ের আগ মুহূর্তে গত সার্চ কমিটি হয়েছিল। এবার তো সময় আছে। আগেই নামগুলো প্রস্তাব করা হোক। তাহলে ভালো লোক চিহ্নিত করা যাবে। আসলে নির্বাচন কমিশন ৫ জনের পরিবর্তে ৩ জন হওয়া দরকার। প্রতিবেশি ভারতের মতো বিশাল দেশেও ৩ জন কমিশনার নির্বাচন কমিশন পরিচালনা করছেন।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সংবিধানে বলা আছে একটি আইনের দ্বারা প্রেসিডেন্ট স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। কিন্তু বিজয়ের এতদিন পরও আমরা স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পারিনি। এ জন্য দরকার আইনের শাসন ও প্রয়োগ। তিনি বলেন, আমরা ইসি গঠনের কথা বলছি। কিন্তু স্বাধীন ইসি গঠনের ব্যাপারে আইনের কথা কেউ বলছি না। কারণ, সার্চ কমিটি গঠন করেন  প্রেসিডেন্ট। তিনি অ্যাডহক ভিত্তিতে সেটা করেন। কেউ রিট করলে তো সে সিদ্ধান্ত আদালতই নেবেন। এব্যাপারে সংসদে আইন প্রণয়ন হওয়া দরকার। যেমন ভারতে আছে।
নির্বাচন কমিশনারের সংখ্যা প্রসঙ্গে এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ৫ জনের নির্বাচন কমিশন করা হলে এর কোনো ধারাবাহিকতা থাকেনা। আমি মনে করি ৩ জনের নির্বাচন কমিশন করা দরকার। তাহলে ধারবাহিকতা থাকবে। যেমন নেপালে আছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ ইসি গঠন করতে হলে আইনের দরকার। আইন না থাকায় ইসি গঠনের ক্ষেত্রে বারবার আমরা হোঁচট খাচ্ছি। ১৯৯১ সাল থেকে দেশে গণতন্ত্র চর্চার চেষ্টা চলছে। আসলে গণতন্ত্র ছাড়া দেশের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে। এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন দেয়া ঠিক হয়নি। এতে করে তৃণমূলে ব্যাপক সহিংসতা ও কোন্দল বেড়েছে। গত ইউপি, উপজেলা এবং পৌর ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এর প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ছিল নিষ্ক্রিয়। আসলে আমাদের দেশে এখনো দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচনের পরিবেশ নেই।
ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, বর্তমানে জনগণ রাজনীতিবিদদের ওপর আস্থা পাচ্ছেনা। এই আস্থা ফেরাতে হলে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন জরুরি। কারণ জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলে সঙ্কট উত্তরণ সম্ভব। তিনি আরো বলেন, শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ ইসি গঠন করতে হলে আইনের দরকার। ভারতেও আইন আছে। সেখানে প্রেসিডেন্ট সরকারি ও বিরোধী দলের সাথে কথা বলে ইসি গঠন করেন। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা সম্ভব কি না সংশয় আছে। কারণ, সংসদে বেশিরভাগ মানুষের জনপ্রতিনিধি নেই। কিন্তু যেসব দেশে রাজনৈতিক দলাদলি আছে সেখানে ইসি গঠনে বিকল্প ব্যবস্থা করতে হয়। যেমন নেপাল, শ্রীলঙ্কায় সাংবিধানিক কাউন্সিল আছে।
সিনিয়র সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ বলেন, কোনো সময়ই ইসিকে সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে দেয়া হয়নি। আজকে ইসি গঠনে আইন করলে কী হবে। বর্তমান সংসদে জনগণের অনেক প্রতিনিধি নেই। তাহলে তো কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল করলে তা গ্রহণযোগ্য হবেনা।  তিনি আরো বলেন, এখন ইসি গঠনের আলোচনা যদি ব্যর্থ হয় তাহলে কী নাগরিক সমাজ দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথে নামবে? যেখানে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টকে অভিশংসিত করার জন্য সব শ্রেণিপেশার মানুষ এক প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েছে?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, নির্বাচনী সঙ্কট বৃহত্তর রাজনৈতিক সঙ্কটের প্রতিফলন। অথচ একাত্তরের চেতনা ছিল জনগণের ক্ষমতায়ন। আজ তা গৌণ হয়ে গেছে। এখান থেকে উদ্ধার হওয়া জরুরি। বিগত সিটি, ইউপি, উপজেলা, পৌর নির্বাচনেই বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্কট ছিল। এসব ব্যাপারে ইসি স্বেচ্ছায় নিষ্ক্রিয়তা দেখালো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবেনা।  তিনি বলেন, প্রশাসনের পক্ষপাতিত্ব একধরনের শিল্পে পরিণত হয়েছে। অনেকে একে প্রভাব বিস্তার করে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীও নির্বাচনে আস্থার সঙ্কটে পড়ে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশ নানা সঙ্কটে পড়বে। বিশেষ করে আর্থিক এবং ব্যবসায় খাতে।
আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা ফোরামের সভাপতি ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) এম সাখাওয়াত হোসেন, বিশিষ্ট ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার, বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী, সাবেক রাষ্ট্রদূত সাবিহ উদ্দিন আহমেদ, শামীম আহমেদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, সিনিয়র সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ, সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. আহরার আহমেদ, সাবেক বাণিজ্য সচিব সোহেল আহমেদ চৌধুরী, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক মিজানুর রহমানসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ