Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সন্দেহপ্রবণতা: মারাত্মক এক ব্যাধি

মোঃ আবদুল গনী শিব্বীর | প্রকাশের সময় : ১৭ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষকে উন্নত দেহাবয়ব ও চমৎকার আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন। প্রত্যেকটি মানুষের মাঝে ‘ফিতরাত’ তথা উত্তম চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। মানুষের বাচনভঙ্গি, সুন্দর মানসিকতা, উত্তম ব্যবহার, উন্নত রুচিবোধ মানুষকে অন্য সকল মাখলুক থেকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। প্রকৃত সুন্দর মানুষ ঐ ব্যক্তি যার মানসিকতা সুন্দর , ধ্যান ধারণা সুন্দর, চিন্তা চেতনাও সুন্দর। সকল মানুষের বুকের পিঞ্জিরায় চোট্ট একটি হৃদয় রযেছে। এ হৃদয়টি খুবই সুন্দর ও বড়ই কোমল। নানাবিধ কারণে মানুষের এ নিষ্কলুষ হৃদয়টি কলুষিত হয়ে পড়ে। হৃদয়ের আলোকপ্রভা ব্যক্তিকে তখন আর আলোকিত করে না, আনন্দে মনকে পুলকিত করে না, জীবনকে ঝলকিতও করে না। হৃদয়ের এ ব্যাঘাত জনিত কারণে হৃদয়ে অসহায়ত্ববোধ সৃষ্টি হয়।

সন্দেহপ্রবণতা মারাত্মক ব্যাধিঃ সন্দেহপ্রবণতা মনের এক মারাত্মক ব্যাধি। মানুষের মনে প্রথমতঃ সাধারণ ধারণা এরপর অনুমানের উপর ভিত্তি করে এটি প্রকাশ পায়। কারো ব্যাপারে অমূলক কিংবা অতিরিক্ত অনুমান বৈধ নয়। ইসলাম ধর্মে এ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা বেশি অনুমান থেকে দূরে থাকো। নিশ্চয়ই কোনো কোনো অনুমান তো পাপ। আর তোমরা গোপন বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের গিবত করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো তা অপছন্দই করে থাকো। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ বেশি তাওবা কবুলকারী, অসীম দয়ালু।’ (সুরা হুজরাত: আয়াত: ১২)। অনুমান নির্ভর ব্যক্তিরা স্বাভাবিকভাবে সন্দেহপ্রবণ হয়ে থাকে। তারা সবকিছুকেই সন্দেহের চোখে দেখে, অথচ তা একেবারেই অনুচিত। এ বিষয়ে মহান আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন, ‘হে মুমিনরা, তোমাদের কাছে যদি কোনো ফাসেক ব্যক্তি কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে তা যাচাই করো। অজ্ঞতাবশত কোনো গোষ্ঠীকে আক্রান্ত করার আগেই, (না হলে) তোমরা কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে। ’ (সুরা : হুজুরাত: আয়াত : ৬)। এ আয়াত সন্দেহপ্রবণ ব্যক্তির জন্য এক মহৌষধ।

সন্দেহপ্রবণতায় আক্রান্ত ব্যক্তির নিকট তার স্ত্রী, পিতামাতা, সন্তান সন্তুতি, আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশি, গুরুজন, বন্ধুবান্ধব কেউই নিরাপদ নয়। সবাইকে সে সন্দেহ করে, তাদের ব্যাপারে মন্দ ধারণা করে। সন্দেহপ্রবণতার কারণে নিজ সতীস্বাধী স্ত্রী, পরিবার পরিজনকে জঘন্য মিথ্যা অপবাদ দিতেও কুন্ঠিত হয়না। সন্দেপ্রবণ ব্যক্তির অনুচিত কর্মকান্ড মারাত্মক পাপ, অমূলক সন্দেহের কারণে তাকে পাপের বোঝা বইতে হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা বিনা অপরাধে ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।’ (সুরা আহযাব : আয়াত : ৫৮)। তিনি আরো বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা সচ্চরিত্রবান সরলমনা মুমিন নারীদের ব্যভিচারের অপবাদ দেয়, তারা দুনিয়া ও আখিরাতে অভিশপ্ত এবং তাদের জন্য (আখিরাতে) আছে মহাশাস্তি। (সুরা নুর: আয়াত : ২৩)।

অস্পষ্টতা ও গোপনীয়তা সন্দেহপ্রবণদের সন্দেহপ্রবণতা আরো বাড়িয়ে দেয়। ইসলাম ধর্মে সন্দেহপ্রবনতা দুরীকরণের নির্দেশনা গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ রয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সাহাবীদেরকে এ বিষয়ে নসিহত করেছেন, যেন তাঁরা কখনো সন্দেহপ্রবণ না হন। সন্দেহপ্রবণতা খুবই মারাত্মক ব্যাধি। এ ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেকে ও অন্যান্যদেরকে মারাত্মক ক্ষতিতে নিমজ্জিত করে। এ প্রসঙ্গে হাদিস বর্ণিত রয়েছে, নুমান বিন বাশির রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি (এ কথা বলে তিনি আঙ্গল দিয়ে নিজ কানের দিকে ইঙ্গিত করেন; অর্থাৎ নিজ কানে শুনেছি।)- ‘নিশ্চয় হালাল সুস্পষ্ট এবং হারাম সুস্পষ্ট; এতদুভয়ের মাঝে রয়েছে অস্পষ্ট বিষয়াবলি- যা অধিকাংশ লোকই জানে না। সুতরাং যে অস্পষ্ট বিষয়াবলি থেকে দূরে থাকবে তা তার সম্মান ও দীনদারি উভয়ের জন্য কল্যাণকর সাব্যস্ত হবে। পক্ষান্তরে যে এতে পতিত হবে সে হারামে লিপ্ত হবে। যেমন- রাখাল সংরক্ষিত এলাকা থেকে সভয়ে দূরে থাকে যাতে সে এতে ঢুকে না পড়ে। মনে রেখ প্রত্যেক রাজারই কিছু সংরক্ষিত স্থান থাকে আরও মনে রেখ আল্লাহর সংরক্ষিত এলাকা (যার সীমানা অতিক্রম করা নিষিদ্ধ) হলো, তাঁর হারাম ঘোষিত বিষয়গুলি। তোমরা মনে রেখ, নিশ্চয় (মানুষের) শরীরে একটি মাংসপিন্ড আছে। সেটা যদি সুস্থ থাকে তাহলে সারা দেহ সুস্থ আর সেটা যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে সারা শরীর অসুস্থ হয়ে যায়। মনে রেখ সেটা হলো কলব বা আত্মা।’

সন্দেহপ্রবণতার সুচনা ‘কুধারণা’ থেকে শুরু হয়। কুধারণা ধীরে ধীরে ব্যক্তিকে কুমন্ত্রণার বিষে বিষিয়ে তোলে। সন্দেহপ্রবতার মারাত্মক ব্যাধির ফলে ব্যক্তির মাঝে এমনসব অপরাধপ্রবণতা দেখা যায়, যেটি থেকে বের হয়ে আসা অনেকটাই অসম্ভব। এ বিষয়টি হাদিসে স্পষ্ট হয়েছে এ মর্মে, আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা কু-ধারণা পোষণ করা থেকে বিরত থাক। কারণ কু-ধারণা সব চাইতে বড় মিথ্যা কথা। অপরের গোপনীয় দোষ খুঁজে বেড়ায়ো না, অপরের গোয়েন্দাগিরি করো না, একে অপরের সাথে অসৎ কাজে প্রতিদ্বন্ধিতা করো না, পরস্পরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করো না, একে অপরের বিরুদ্ধে শত্রুভাবাপন্ন হইয়ো না। তোমরা আল্লাহর বান্দা, ভাই ভাই হয়ে যাও; যেমন তিনি তোমাদেরকে আদেশ দিয়েছেন। এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার প্রতি জুলুম করবে না, তাকে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেবে না এবং তাকে তুচ্ছ ভাববে না। আল্লাহ-ভীতি এখানে রয়েছে। আল্লাহ-ভীতি এখানে রয়েছে। এই সাথে তিনি নিজ বুকের দিকে ইঙ্গিত করলেন। কোন মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ ভাবা একটি মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য যথেষ্ট। প্রত্যেক মুসলিমের রক্ত, সম্ভ্রম ও সম্পদ অপর মুসলিমের উপর হারাম। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের দেহ ও আকার-আকৃতি দেখেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমল দেখেন।’’ (আল হাদিস)।

সন্দেহপ্রবণতা মানুষকে ধারণাতীত মারাত্মক অপরাধে শামিল করে দেয়। তাইতো আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি তাঁর প্রিয় সাহাবীদেরকে এহেন নিন্দনীয় মারাত্মক পাপাচার থেকে বেঁচে থাকার তাগিদ দিয়েছেন। তিনি তাঁর প্রিয়তম সাহাবীদেরকে বায়আত করিয়েছেন এমর্মে, যেটির বর্ণনা হাদিসে এসছে, হজরত ওবাদা ইবনু সামিত (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা নবী (সা.)-কে ঘিরে একদল সাহাবি বসে ছিলেন। এমতাবস্থায় তিনি তাঁদের উদ্দেশ্য করে বললেন, আমার হাতে এ কথার বাইয়াত গ্রহণ করো যে, আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার (জিনা) করবে না, নিজেদের সন্তানাদি (অভাবের দরুন) হত্যা করবে না। কারো প্রতি (জিনার) মিথ্যা অপবাদ দেবে না। শরিয়তসম্মত কোনো বিষয়ে অবাধ্য হবে না। তোমাদের মধ্যে যারা এসব অঙ্গীকার পূর্ণ করতে পারবে, তাদের জন্য আল্লাহর কাছে পুরস্কার রয়েছে। অন্যদিকে যে লোক (শিরক ব্যতীত) অন্য কোনো অপরাধ করবে এবং এ জন্য দুনিয়ায় শাস্তি পেয়ে যাবে তাহলে এই শাস্তি তার গুনাহ মাফ হওয়ার কাফফারা হয়ে যাবে। আর যদি কোনো গুনাহর কাজ করে, অথচ আল্লাহ তা ঢেকে রাখেন (বা ধরা না পড়ে), এ জন্য দুনিয়ায় এর কোনো বিচার না হয়ে থাকে, তাহলে এই কাজ আল্লাহর মর্জির ওপর নির্ভর করবে। তিনি ইচ্ছা করলে আখিরাতে তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন অথবা শাস্তিও দিতে পারেন। বর্ণনাকারী (ওবায়দা) বলেন, আমরা এসব শর্তানুযায়ী নবী (সা.)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করলাম। (সহীহ বুখারি: হাদিস : ১৮)।

সন্দেহপ্রবণতার ক্ষতিসমুহঃ সন্দেহপ্রবণতা মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনে। ১. সন্দেহপ্রবণতা মিথ্যার নামান্তর। ২. এটি মারাত্মক পাপ যা ব্যক্তির আমলনামাকে কলুষিত করে। ৩. এ অভ্যাস সংশ্লিষ্টজনকে ঘৃণারপাত্র বানায়। ৪. এ ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিকে কেউ পছন্দ করে না। ৫. সন্দেহপ্রবণতার কারণে জঘন্য অপরাধ সংগঠিত হয়। ৬. সন্দেহপ্রবণ ব্যক্তি নিজেকেও বিশ্বাস করতে পারে না। ৭. সন্দেহপ্রবণতা হঠকারিতার জন্ম দেয় ৮. অপরের প্রতি অযথা সন্দেহের দরুন শত্রুতা সৃষ্টি করে ৯. প্রতিশোধ স্পৃহা সৃষ্টি হয় ১০. ধ্বংসাত্মক পরিণতি ডেকে আনে।
পরিশেষে মহান আল্লাহপাক আমাদেরকে সন্দেহপ্রণতা ও এর ক্ষতিকর প্রভাব হতে হেফাজত করুন। মহান মালিকের সন্তুষ্টি লাভের আমলে নিয়োজিত হবার তাওফিক দান করুন।

লেখকঃ মোঃ আবদুল গনী শিব্বীর, মুহাদ্দিস, নোয়াখালী কারামাতিয়া কামিল মাদরাসা, সোনাপুর, সদর, নোয়াখালী।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ