Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

এই বিজয় এক দিনে আসেনি

| প্রকাশের সময় : ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ ফারুক খান : ১৬ ডিসেম্বর আমাদের গৌরবদীপ্ত মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার বিকেল ৪.৩১ মিনিটে ঐতিহাসিক ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত ‘যৌথ বাহিনীর’ নিকট  পাকিস্তানী  হানাদার বাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় মুক্তিযুদ্ধের মহান বিজয়। এই বিজয় এক দিনে আসেনি। একটানা ৯টি মাস সশস্ত্র যুদ্ধই শুধু নয়, তারও আগে ১৯৪৮ থেকেই  নিতে হয়েছে দীর্ঘ রাজনৈতিক এবং মানসিক  প্রস্ততি।
সত্তরের ঐতিহাসিক নির্বাচনে জাতির রায় মেনে নিতে চায়নি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন ১৯৭০ এর নির্বাচনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত বাংলার তথা পাকিস্তানের  সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি পাকিস্তানীদের  নির্বাচনে প্রদত্ত জনগণের রায় মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান। ঐতিহাসিক এ জনসভায় তিনি বাঙালি জাতিকে নির্দেশ দেন  ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়- তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বাঙালির বুকে স্বাধীনতার বীজমন্ত্র বোনা হয়ে যায় সেই দিনই। সেদিন থেকে আর বাঙালিকে দাবিয়ে রাখা যায়নি। আর সে কারণেই ২৫ মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ নামে বাঙালি নিধন শুরু হলেও রুখে দাঁড়াতে সময় নেয়নি বীর বাঙালি। ধ্বংসস্তুপ থেকে জেগে উঠে মুক্তির যুদ্ধে শামিল হয় সমগ্র জাতি।
পূর্ব বঙ্গের বাঙালিরা যে ব্রিটিশ  উপনিবেশ থেকে পাকিস্তানী উপনিবেশের শোষণে পড়েছিল, সেটা ১৯৪৭ সালেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বাঙালিকে দাবিয়ে রাখতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীদের নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা। তৎক্ষনাৎ আমরা তার তীব্র প্রতিবাদ করি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে পাকিস্তানিদের এ ইচ্ছা আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জাতিকে একটু একটু করে প্রস্তুত করতে হয়েছে। এক দিনে হুট করে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে নেমে যায়নি জাতি। এ জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের ভেতর দিয়ে দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সাহসী এবং দূরদর্শী নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ গঠন, ১৯৪৯ এ আওয়ামী লীগ গঠন, ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ এর নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করে রাষ্ট্র পরিচালনা, ১৯৫৬-তে পুনরায় নির্বাচনে জয়লাভ, ১৯৫৮-তে আইয়ুব খানের মার্শাল ‘ল’ এর বিরোধিতা, ১৯৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশকে অরক্ষিত রাখায় প্রতিবাদ, ১৯৬৬ এ বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ঘোষণা এবং আন্দোলন, ১৯৬৮ এর আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার, ১৯৬৯ এর গণ আন্দোলন এবং ১৯৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়লাভের রক্ত¯œাত এবং সাহসী পথ ধরেই  দীর্ঘ ২১ বছরের ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের’ মধ্যদিয়ে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে তৈরি করেছিলেন ‘মুক্তিযুদ্ধের’ জন্য। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ভেতর দিয়েই জাতি পেয়ে যায় সুনির্দ্দিষ্ট দিকনির্দেশনা। সেদিনই স্থির হয়ে যায় বাঙালির ভাগ্য। পাকিস্তানি শোষণের যাঁতাকল থেকে মুক্তির পথ যেন খুঁজে পায় বাঙালি জাতি। বঙ্গবন্ধু বাঙালী জাতিকে নির্দেশ দেন ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো, যার যা কিছু  আছে তাই নিয়েই শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’।  যার ফলে আমরা দেখি একাত্তরে বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরই যেন হয়ে উঠেছিল একেকটি দূর্গে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে গুটি কয়েক রাজাকার, আলবদর, জামায়াতি ছাড়া কাউকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। দেশকে শত্রুমুক্ত করার প্রত্যয়ে যুদ্ধে গিয়েছিল বাঙালি। স্বীকার করতে হয়েছিল অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষা। বাঙালি জাতির কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। পাঁচ হাজার বছর আগেও এ ভূখ-ের অধিবাসীদের বীরত্ব সম্পর্কে সমীহ করা হতো। মহাবীর আলেকজান্ডারের সঙ্গীরা এই বীর জাতির শৌর্যবীর্যের প্রশংসা করেছেন। আড়াই হাজার বছর আগে রোমান কবি ভার্জিলের কবিতায় গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের অধিবাসীদের বীরবন্দনা প্রকাশ পেয়েছে। সেই প্রাচীনকালে বাঙালি বীর বিজয় সিংহ শ্রীলঙ্কা জয় করে দূর দেশেও নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের কৃতিত্ব দেখান। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও বাঙালি বার্মা এবং উত্তর আফ্রিকার রনাঙ্গনে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হয়ে যুদ্ধে তাদের বীরত্বের প্রমাণ রেখেছে। তারপরও বলা যায়, ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা এ ভূখ-ের মানুষের ইতিহাস খুব একটা সুখকর নয়। এ দেশের সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য বিদেশি হানাদাররা বারবার হানা দিয়েছে। বৈদেশিক আধিপত্যে এক পর্যায়ে বাঙালি তার স্বকীয় মর্যাদাই হারিয়ে ফেলতে বসেছিল।
বাঙালি মুসলমানদের অগ্রণী ভূমিকায় ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও শুরুতেই ষড়যন্ত্রের শিকার হয় পদ্মা মেঘনা যমুনা বুড়িগঙ্গা পাড়ের মানুষ। সংখ্যালঘিষ্ঠ পশ্চিম পাকিস্তানিরাই এ দেশের ভাগ্য-বিধাতা হয়ে ওঠে। শোষণ ও নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয় বাঙালিরা। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান বাঙালির সাহসী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হলে পাকিস্তানিরা তাঁর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়। শুধু তাই নয়, তারা একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতের আঁধারে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় গণহত্যা। এ প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
জাতি এ বছর একাত্তরের মহান বিজয়ের ৪৬তম বার্ষিকী পালন করছে। একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে ‘সোনার বাংলা’ গঠন ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় এবং বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপে সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আজ কৃষি, শিক্ষা, ক্রীড়া, দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা, নারীর ক্ষমতায়ন, বিশ্ব শান্তিরক্ষা, খাদ্য উৎপাদন, স্বাস্থ্য, তথ্য প্রযুক্তি, অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ অনেক ক্ষেত্রেই অভাবনীয় অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। মেঘনা ও যমুনা সেতুসহ অসংখ্য বড় সেতু নির্মিত হবার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পূর্ণ দেশি অর্থায়নে দেশের সর্ববৃহৎ পদ্মা সেতু নির্মাণ করছেন।
জাতি হিসেবে আমাদের উল্লেখযোগ্য কলঙ্কও আছে। বিজয়ের চার বছরের মাথায় যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানী দালালচক্র ও ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যা করেছে স্বাধীনতার স্থপতি  জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারসহ জাতীয় চার নেতাকে। স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে আঁতাত করে ক্ষমতায় গেছে কিছু রাজনৈতিক দল। তারা রক্তপিপাসু পাক হানাদারদের দেশীয় দোসরদের মন্ত্রিত্ব দিয়েছে। তাদের গাড়িতে উড়েছে রক্তার্জিত লাল সবুজের প্রিয় পতাকা। স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তিকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিপক্ষ শক্তিকে পরাভূত করার জন্যে দীর্ঘ  ২১ বছর সংগ্রাম করতে হয়েছে। এর ফলস্বরূপ অবশেষে জাতির জনকের হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে, বিচারের রায়ও কার্যকর হয়েছে। দ-প্রাপ্ত ক’জন পলাতক আসামীকে বিদেশ থেকে ধরে এনে রায় কার্যকর করতে পারলে জাতি অন্তত জাতির পিতার হত্যার কলঙ্ক থেকে অনেকাংশে মুক্ত হবে। যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচার হচ্ছে, জাতি কলঙ্কমুক্ত হচ্ছে। এবারের ৪৬তম বিজয় দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতত্বে ২০২১ সালের মধ্যে ‘সোনার বাংলা’ গড়ার লক্ষ্যে বেশি করে লেখাপড়া করব,  বেশি করে কাজ করব এবং বেশি করে বাংলাদেশ এবং এর জনগণকে ভালোবাসব। অন্যায় করব না, অন্যায়কে প্রশ্রয় দেব না এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রকারীকে প্রশ্রয় দেব না।  
 লেখক :প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সাবেক মন্ত্রী বাণিজ্য, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ