পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের নিয়ে ফুসকা উৎসবের আয়োজন করেছিল। বনানী ক্যাম্পাসে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানের স্লোগান ছিল ‘যত খুশি তত খাও’। বিনে পয়সায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ফুসকা খাওয়ার দৃশ্য দেখে ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ করে একজন শিক্ষক বলেছিলেন, ‘একদিনেই খাবে আর নয়’। ফুসকা নয় বাংলাদেশ ব্যাংক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের জন্য ‘যত খুশি তত ঋণ’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এক-দুই মাসের জন্য নয়, ৫ বছর ঋণ নিতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী এখন থেকে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী যারা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবেন তাদের ব্যাংকগুলো আগামী ৫ বছর যত খুশি তত ঋণ দিতে পারবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই প্রজ্ঞাপন জারির পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নেটিজেনরা নানা মন্তব্য-বক্তব্য দিচ্ছেন। তাদের মূল কথা এবার ব্যবসায়ী-আমলা-কামলা সবই ছুটবেন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের দিকে। রেন্টাল-কুইন রেন্টাল বিদ্যুতের সময় মন্ত্রী-এমপিসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতা, ফার্নিচার ব্যবসায়ী, ওষুধ ব্যবসায়ী, তরকারি ব্যবসায়ীরাও ব্যাংক ঋণ নিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের দিকে ঝুঁকে পড়েন। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে ‘যত খুশি তত ঋণ’ সুযোগ নিয়ে এ সেক্টরে নতুন নতুন মুখের অবির্ভাব ঘটবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কার্যত দেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য ঋণসীমা তুলে দিয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি সার্কুলার জারি করা হয়। সার্কুলার অনুযায়ী আগামী ৫ বছর বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী ব্যক্তি, গ্রুপ ও প্রতিষ্ঠানকে যত খুশি তত ঋণ দিতে পারবে ব্যাংকগুলো। বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ নির্বিঘ্ন রাখতে এ সুবিধা দেয়া হয়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১-এর ২৬খ (১) অনুযায়ী একটি কোম্পানিকে ব্যাংকের সংরক্ষিত মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ দেয়ার সুযোগ নেই। তবে নতুন নির্দেশনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ঋণের সীমা তুলে দিয়েছে। এই আইন কার্যকর হবে না।
এর আগে ২০১০ সালে ফার্নেস অয়েল ও গ্যাসভিত্তিক বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন বিপণনে দুর্নীতি-অনিয়মের বিচার করা যাবে না বিধান করে জাতীয় সংসদে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন’ পাস করেছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফরাহ মো. নাছের স্বাক্ষরিত নির্দেশনায় বলা হয়েছে, এতদ্বারা সংশ্লিষ্ট সকলের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ নির্বিঘ্ন রাখার লক্ষ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য ব্যয় যেমনÑ জমি ক্রয়, মেশিনারি আমদানি ও কয়লা ক্রয় বাবদ ব্যয়, মেশিনারি স্থাপন সংক্রান্ত ব্যয়, মেরামতের জন্য তাদের প্রয়োজনীয় ঋণ দিতে পারবে ব্যাংকগুলো। এ জন্য আগামী পাঁচ বছর ব্যাংকঋণ পেতে সংরক্ষিত মূলধনের ২৫ শতাংশ ঋণ দেয়ার হিসাব কার্যকর হবে না। এর আগে গত জুলাই মাসে ৬ মাসের জন্য এমন নির্দেশনা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ (১৯৯১ সনের ১৪ নং আইন)-এর ১২১ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এ নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ২৬খ(১) ধারার শর্তাংশে উল্লিখিত ২৫ শতাংশ ঊর্ধ্বসীমার স্থলে আগামী ৫ বছরের জন্য ঊর্ধ্বসীমা কত হবে তা বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারণ করবে।
এর আগে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ সঙ্কট দ্রুত সমাধানের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়। আর ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, বিপণনে দুর্নীতি-অনিয়মের বিচার করা যাতে না যায় সে জন্য ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে প্রণয়ন করা হয় ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন’। এ আইনের উদ্দেশ্য ‘বিদ্যুৎ সেক্টরের দুর্নীতি-অনিয়মের বিচার করা যাবে না’। ওই সময় দেশে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দ্রুত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য আইনটি করা হয়েছিল। তখন সরকার থেকে বলা হয়েছিল, প্রথম দুই বছর পরই প্রচলিত দরপত্র প্রক্রিয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাবে। তবে সেটি সম্ভব হয়নি। অতঃপর দশম জাতীয় সংসদে ৩ বছর এবং ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ফের ৫ বছরের জন্য জাতীয় সংসদে এ সংক্রান্ত ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) (সংশোধন) বিল-২০২১’ পাস হয়। এ সময় বিরোধী দলের এমপিরা আইনটির বিরোধিতা করেছিল। পরিবেশবিদ, সুশীলসমাজ এবং জ্বালানি ও বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞরা রেন্টাল থেকে সরে আসার দাবিতে বিলটির বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু সরকার কর্ণপাত করেনি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক সরকারের শাসনামলে ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিচার করা যাবে না’-এর আদলে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের অনিয়ম-দুর্নীতির বিচার করা যাবে না এমন বিধান করে সংসদে আইন পাস করেছিল, যা বাংলাদেশের মানুষের কাছে ‘ইনডেমনিটি বিধান বিল’ নামে সর্বাধিক পরিচিত।
বাংলাদেশের পরিবেশবিদরা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে। সুন্দরবনের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে তাদের বক্তব্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশের সর্বনাশ করে থাকে। তবে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক ও গ্যাস দিয়ে উৎপাদন শুরু করে ২০১০ সালে। তবে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। গুজব রয়েছে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে অনিয়ম এবং দুর্নীতির বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।
এদিকে দেশের পরিবেশবিদদের আন্দোলনের মুখে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে সরে এসেছিল সরকার। গত বছর ১০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাতিল করার ঘোষণা দেয়া হয়। বাতিলকৃত প্রকল্পগুলো হচ্ছেÑ ১. পটুয়াখালীতে ২ ইউনিট ৬৬০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, ২. উত্তরবঙ্গ ১২০০ মেগাওয়াট সুপার থারমাল পাওয়ার প্ল্যান্ট, ৩. মাওয়া ৫২২ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, ৪. ঢাকা ২৮২ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, ৫. চট্টগ্রাম ২৮২ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, ৬. খুলনা ৫৬৫ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, ৭. মহেশখালী ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, ৮. মহেশখালী ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, ৯. বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুর ৭০০ মেগাওয়াট আশ্মাসুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, ১০. সিপিজিসিবিএল-সুমিতোমো ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প। তবে এখন বিশেজ্ঞরা মনে করছেন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ব্যাংকঋণের এই সুবিধা কার্যকর হওয়ার পর অনেকেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের দিকে ঝুঁকে পড়বেন। ৫ বছর ধরে ব্যাংকঋণের সুবর্ণ সুযোগ কেউ হাতছাড়া করতে চাইবেন না। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাপানো টাকায় ‘চাহিবামাত্র ইহার বাহককে টাকা দিতে বাধ্য থাকিবে’ নির্দেশনা দেয়া রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনের পর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের চাহিবা মাত্র ব্যাংকঋণ দিতে বাধ্য থাকবে।
জানা গেছে, বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলে মোট ২৯টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি প্রকল্পÑ পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট, রামপাল ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট এবং মাতারবাড়ী ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট পর্যালোচনার আর সুযোগ নেই। কারণ, পায়রা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শেষে চালু হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. মো. আইনুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অজানা কারণে বন্ধ ছিল এবং অনেক আন্দোলন হয়েছে যে, এটা চালু করা হোক। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আমেরিকা ও অন্যান্য কিছু দেশ বন্ধ করছে পরিবেশগত ঝুঁকি ও বেশি খরচের কারণে। তবে বর্তমান দেশের বিদ্যুৎ সঙ্কট বিবেচনা করে সরকার উৎপাদন বাড়াতে এ পদক্ষেপ নিয়েছে। যেসব চুক্তি স্থগিত ছিল সেগুলো উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এ পরিকল্পনা কার্যকর হবে না। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে নজর দিতে হবে। সামনের দিকে সঙ্কট বিবেচনা করে নানা ধরনের কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। এটার জন্য আমার মনে হয় একটু গবেষণারও দরকার আছে। বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিরুৎসাহিত করছে। সেখানে উল্টো বাংলাদেশ সে পথেই হাঁটছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।