পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
ফজলুর রহমান ও নূরুল আমীন : আজকের শিশুটির জন্য ভবিষ্যতের পৃথিবীকে আরো বেশি বাস উপযোগী করে তুলতে সভ্য সমাজের মানুষেরা কতই না প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। কিছুদিন আগে নিজের শিশু সন্তানের নাম নিয়ে নিজের সম্পদের প্রায় সবটুকুই দাতব্য কাজে ব্যয়ের প্রতিশ্রুতি করেছিলেন ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ। সভ্য সমাজে শিশুদেরকে সবচেয়ে নিরাপদ হিসেবে গণ্য করা হলেও আমাদের বাংলাদেশ যেন দিন দিন নিষ্পাপ শিশুদের জন্য নরকে পরিণত হচ্ছে। প্রতিদিন বড়দের অপরাধের নৃশংস বলি হতে হচ্ছে কোনো না কোনো শিশুকে। যার সর্বশেষ করুণতম দৃষ্টান্ত স্থাপিত হল হবিগঞ্জের বাহুলবল উপজেলায়। ৫ দিন ধরে নিখোঁজ থাকার পর গতকাল বুধবার এক সাথে চারটি শিশুর মাটিচাপা লাশ উদ্ধার করা হয়েছে সেখানে। সাম্প্রতিক সময়ে বর্বরভাবে একের পর এক শিশুহত্যার ঘটনা দেশের মানুষকে কাঁদিয়ে চলেছে। শিশু রাজন, রাকিব, তক্বী, আব্দুল্লাহর খুনের স্মৃতি এখনো বিবেকবান মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তবে বাহুবলের ঘটনা যেন বর্বরতার চূড়ান্তে পৌঁছেছে। গতকালের ঘটনায় শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছেন হবিগঞ্জবাসী। সামাজিক মাধ্যমে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন বিস্ময়ে বিমুঢ দেশবাসী।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বাহুবল উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রামের ৪ শিশু নিখোঁজ হওয়ার ৫ দিন পর মাটি চাপা অবস্থায় তাদের লাশ পাওয়া গেছে। বাড়ীর পাশেই শিশুদেরকে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়া ছিল তাদের লাশ। গতকাল সকালে লাশের সন্ধান পাওয়ার পর হাজার হাজার মানুষ ছুটে যায় ঘটনাস্থলে। এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। কান্নার মাতম চলে সর্বত্র। স্বজন ও সাধারণ মানুষের কান্নায় করাঙ্গী নদীরপাড়ের গ্রামটিতে সৃষ্টি হয় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। র্যাব, পুলিশ, সিআইড, ডিবি পুলিশ জনপ্রতিনিধি আর প্রশাসনের লোকজন সেখানে গিয়ে সান্ত¦না দেয়ার চেষ্টা করেন শোকাহত পরিবারগুলোকে।
ঘটনার সূত্রপাত:
গত শুক্রবার সুন্দ্রাটিকি গ্রামের মোঃ ওয়াহিদ মিয়ার পুত্র জাকারিয়া আহমেদ শুভ (৮), তার চাচাত ভাই আব্দুল আজিজের পুত্র তাজেল মিয়া (১০) ও আবদাল মিয়ার পুত্র মনির মিয়া (৭) এবং তাদের প্রতিবেশী আব্দুল কাদিরের পুত্র ইসমাঈল হোসেন (১০) নিখোঁজ হয়। ওইদিন বিকেল বেলা তারা উত্তর ভাদেশ্বর গ্রামে ফুটবল খেলা দেখতে গিয়েছিল। এ ব্যাপারে পরদিন ওয়াহিদ মিয়া বাদী হয়ে বাহুবল থানায় সাধারণ ডায়েরী করেন। মঙ্গলবার রাতে থানায় অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা দায়ের করেন নিখোঁজ এক শিশুর পিতা। এই ঘটনার পর পুলিশের একাধিক টিম ও র্যাব মাঠে নামে ওই শিশুদের অনুসন্ধানে। সোমবার বিকেলে হবিগঞ্জের পুলিশ সুপারের পক্ষ থেকে নিখোঁজ শিশুদের সন্ধানদাতাকে ২০ হাজার টাকা পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা করা হয়। মঙ্গলবার রাতে নিখোঁজ শিশু মনির মিয়ার পিতা আবদাল মিয়া বাদী হয়ে বাহুবল মডেল থানায় অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেন।
মাটিচাপা লাশ উদ্ধার:
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সুন্দ্রাটিকি গ্রামের দিনমজুর কাজল মিয়া প্রতিদিনের ন্যায় গতকাল সকালে বাড়ি থেকে বেড় হয়ে করাঙ্গী নদীর পাশে মাটি কাটতে যান। সকাল ৯টার দিকে তার সাথে কাজ করতে যাওয়া কয়েক জনের জন্য দুই শিশু সকালের নাস্তা নিয়ে যাচ্ছিল। পাশের জমিতে মাটির ভেতর থেকে মানুষের হাত বের হয়ে আছে দেখে তারা চিৎকার দেয়। তখন কাজল মিয়া ছুটে এসে দেখতে পান মাটিচাপা অবস্থায় একটি হাত ও মাথা দেখা যাচ্ছে। দুর্গন্ধ আসছিল ভেতর থেকে। কাজল মিয়া নিখোজ ৪ শিশুর পরিবারকে খবরটি জানান। স্থানীয়রা পুলিশকে খবর দেন। মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়া খবরে এলাকায় জড়ো হতে থাকেন সাধারণ মানুষ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। লাশগুলো সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে পুলিশ নিয়ে যায় হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপতালে। সেখানে সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির পর নেয়া হয় মর্গে।
কাজল মিয়া ইনকিলাবকে বলেন, মাটি চাপা অবস্থায় যে লাশের হাত দেখা গিয়েছিল সেটি ছিল শিশু তাজেল মিয়ার। হাতের কিছু অংশ শিয়ালে খেয়ে ফেলেছে বলেও তিনি জানান। লাশ উত্তোলনে সহায়তাকারী আকলিছ মিয়া জানান, সব শিশুর গায়েই পরনের পোশাক ছিল। লাশের মুখ ছিল কাটা এবং জিহ্বা বের করা। ১/২ ফুট পর পর লাশগুলো চাপা দেয়া হয়। গর্তগুলোর গভীরতা ছিল ৩ ফুটের মত। বালু উত্তোলনের ফলে সৃষ্ট গর্তে লাশগুলো রেখে মাটিচাপা দেয়া হয়েছিল।
পুলিশের অসহযোগিতার অভিযোগ:
নিখোঁজ শিশু মনিরের পিতা ও অপর তিন শিশুর চাচা আব্দাল মিয়া অভিযোগ করেন, বাহুবল থানায় মামলা দিতে গেলে তারা মামলা নেয়নি। পরে মঙ্গলবার এসে পুলিশ বলে মামলা দিতে। ঘটনার দিন থানায় গেলে ওসি বলেন, ‘আল্লা আল্লাহ করেন, আর তজবি পড়েন। আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি আর মেলা বান্নিতে খুঁজ করেন।’ পুলিশ প্রথম থেকে সক্রিয় হলে শিশুদেরকে উদ্ধার করা যেত বলে মনে করেন অভিভাবকরা।
তবে বাহুবল মডেল থানার ওসি মোশারফ হোসেন জানান, তিনি ডেকে নিয়েই আব্দাল মিয়াকে দিয়ে মামলা করিয়েছেন। খবর পাওয়ার পর থেকেই পুলিশ তন্ন তন্ন হয়ে সব জায়গায় খোঁজ করেছে। আব্দাল মিয়া যে অভিযোগ করেছেন তা সঠিক নয়।
বড়দের দ্বন্দ্বের বলি শিশুরা:
সুন্দ্রাটিকি গ্রামে বিগত সময়ে এ ধরনের হত্যাকা- ঘটেনি। এমনকি বাহুবল উপজেলায়ও এ ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন। তবে সুন্দাটিকি গ্রামে গ্রাম্য সংঘর্ষের ঘটনা নিয়মিতই ঘটে। নিহত মনির মিয়ার পিতা আব্দাল মিয়া জানান, ঘটনার দিন নিখোঁজ শিশুদের খোঁজ করতে গেলে স্থানীয় লোকজন জানায়, তারা একই গ্রামের আব্দুল বারিকের ছেলে বাচ্চু মিয়ার সিএনজি-অটোরিক্সাতে বাচ্ছাদের দেখেছে। কিন্তু বাচ্চু মিয়া বিষয়টি অস্বীকার করে। বাচ্চু আব্দুল আলী বাগালের পঞ্চায়েতের লোক হওয়ায় তারা পরিকল্পিতভাবে এই ঘটনা ঘটাতের পারে বলে আব্দাল মিয়া অভিযোগ করেন। বাচ্ছু মিয়া ও আব্দুল আলীর বাড়ীতে গেলে কাউকে পাওয়া যায়নি।
গ্রামের নুরুল হক বলেন, দুই পঞ্চায়েতের বিরোধের খবর সবাই জানে। গ্রামে প্রায়ই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলেও ভোটের আশায় নেতাকর্মীরা সালিশের মাধ্যমে বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করেন। এতে করে অনেক সময় চাপা ক্ষোভ থেকে যায়। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে গ্রামে এ ধরনের ঘটনা ঘটত না। নাম প্রকাশে অনচ্ছিুক গ্রামের এক মুরুব্বি জানান, আব্দুল আলী বাগাল ও তার লোকজন এলাকায় চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসী হিসাবে পরিচিত। চুরি ডাকাতির সাথে তারা জড়িত। পুলিশের সাথেও তাদের ভাল সম্পর্ক রয়েছে। ফলে তারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। আব্দুল আলী বাগাল একজন চা বাগানের কর্মচারী।
খুনিদের ধরতে পুরস্কার ঘোষণা:
৪ শিশুর লাশ পাওয়ার খবর পাওয়া গেলে সিলেটের ডিআইজি মিজানুর রহমান পিপিএম, পুলিশ সুপার জয়দেরব কুমার ভদ্র, জেলা পরিষদ প্রশাসক ডা. মুশফিক হোসেন চৌধুরী, বাহুবল উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল হাই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় উপস্থিত সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় সিলেটের ডিআইজি মিজানুর রহমান পিপিএম, এই ঘটনার সাথে জড়িতদের বিষয়ে সন্ধান দিতে পারলে জনসম্মুখে ১ লাখ টাকা প্রদানের ঘোষণা দেন।
পরিকল্পিত হত্যা:
সুন্দাটিকি গ্রামে ৪ শিশু নিখোঁজ হওয়ার পর সকলেই ধারণা করছিলেন অপহরণের ঘটনা হতে পারে। গ্রামের মানুষ ও স্বজনরা অপেক্ষায় ছিলেন হয়তবা কোন ফোন থেকে মুক্তিপণ দাবী করা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন ফোন আসেনি। পাওয়া গেল লাশ। এতে অনেকের ধারণা হত্যা করার জন্যই তাদেরকে অপহরণ করা হয়। সহকারী পুলিশ সুপার মাসুদুর রহমান মনির জানান, এখনও বলা যাচ্ছে না এটি পরিকল্পিত হত্যাকা- নাকি শুধু অপহরণ ছিল। পুলিশ ক্লু উদ্ধারের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এলাকায় আতঙ্ক:
৪ শিশুর মাঝে ৩ জনই স্থানীয় সুন্দাটিকি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। এর মাঝে মনির মিয়া ১ম শ্রেণীতে, জাকারিয়া আহমেদ শুভ ২য় শেণী এবং তাজেল মিয়া ৪র্থ শ্রেণীতে লেখা পড়া করত। শুভ ছিল ক্লাসের সেকেন্ড বয়। ৩ ছাত্রের মৃত্যুতে স্কুলে নেমে আসে শোকের ছায়া। স্কুলের সহকারী শিক্ষিকা নুরে জান্নাত শেফা জানান, শুভ ও তাজেল ভাল ছাত্র ছিল। তারা দর্রিদ কৃষক পরিবারের সন্তান। তবে লেখাপড়ার প্রতি তাদের আগ্রহ ছিল বেশী। স্কুলের প্রধান শিক্ষক সাজিদুল ইসলাম জানান, ৪ শিশু নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই স্কুলে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি অনেক কমে যায়। বুধবার লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে অভিবাবকরা তাদের সন্তানদেরকে নিয়ে যান। স্কুলের ৩ ছাত্রের হত্যার ঘটনায় শেকাসভা আয়োজন করা হবে বলেও তিনি জানান। তাজেল মিয়ার সহপাঠি রুবেল মিয়া জানান, তারা একসাথে খেলাধুলা করতেন। এখন তাজেল আর স্কুলে আসবে না শুনে সে বিমূর্ষ হয়ে পড়ে। স্কুলের আর এক শিক্ষার্থী মজুন মিয়া তার সহপাঠির মৃত্যুর বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
প্রসঙ্গত, গত জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ২৯ শিশু খুন হয়েছিল বলে এ মাসের শুরুতে জানিয়েছিল মানবাধিকার সংস্থা অধিকার। এর পর ঢাকা-রাজশাহীসহ বিভিন্ন এলাকায় আরো কয়েকজন খুন হয়েছে। গত দেড় মাসে এই সংখ্যা ৪০ এর বেশি।
এদিকে ওই নৃশংস হত্যাকা-ে জড়িত সন্দেহে গত রাত পৌনে নয়টার দিকে হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার রশিদপুর কাছ থেকে দুজনকে আটক করেছে পুলিশ। বাহুবল মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোশারফ হোসেন আটকের সত্যতা নিশ্চিত করেন বলেন, আটক ব্যক্তিরা হলেন, আবদুল আলী ও তাল ছেলে জুয়েল মিয়া। তাদের থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।