Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দেশে চা উৎপাদনে নতুন রেকর্ড

প্রকাশের সময় : ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আনোয়ার হোসেন জসিম, শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) থেকে : চা উৎপাদনে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। দেশে চায়ের উৎপাদনের ইতিহাসে এত বেশি পরিমাণ এর আগে আর কখনও হয়নি বলে চা বোর্ড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। একদিকে আবহাওয়ার বৈরিতার পরও ২০১৫ সালের উৎপাদন ছাড়িয়েছে ৬৭.৩৮ মিলিয়ন কেজি। প্রতি হেক্টরে চা উৎপাদন হয়েছে ১২৭০ কেজি। ২০১৫ সালে চায়ের উৎপাদনে রেকর্ড করলেও দেশে চা আমদানি করা হয়েছে ১৫.৮৩ মিলিয়ন কেজি। এক সময় দেশের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল চা। কিন্তু এখন বাস্তবে তা আর নেই। দেশের কিছু অসাধ ব্যবসায়ী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও কেনিয়া থেকে কম মূল্যে নিম্নমানের চা আমদানি করছেন। যা দেশীয় চায়ের বাজারকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে বলে এমন অভিযোগ রয়েছে চা শিল্পের সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টদের।

চা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, গেল বছরের চা উৎপাদনের সর্বশেষ রিপোর্ট গত সপ্তাহে শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত বাংলাদেশ চা গবেষণা কেন্দ্র (বিটিআরআই) এসে পৌঁছেছে। সেই হিসাবমতো লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও চা বেশি উৎপাদন হয়েছে। ২০১৫ সালে দেশের চায়ের উৎপাদন ৬৬ মিলিয়ন কেজি হবে আশা ছিল সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু অক্টোবর-নভেম্বর মাসে উৎপাদন বাড়ায় তা ছাড়িয়েছে ৬৭.৩৮ মিলিয়ন কেজিতে। ২০১৪ সালে দেশে চায়ের মোট উৎপাদন হয়েছিল ৬৩.৮৮ মিলিয়ন কেজি। সে বছর উৎপাদন কম হওয়ায় বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছিল ৬.৬৯ মিলিয়ন কেজি চা। ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে চা আমদানি হয়েছে ১৫.৮৩ মিলিয়ন কেজি। এর আগে ২০১৩ সালে চায়ের উৎপাদনেও রেকর্ড ছিল। সে বছর চায়ের উৎপাদন ছিল ৬৬.৩৪ মিলিয়ন কেজি। চা বোর্ড সূত্র আরো জানায়, নব্বইয়ের দশকে চা রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল পঞ্চম। দেশীয় চায়ের গুণগত মান ভালো থাকায় বিদেশি ক্রেতাদের কাছে চায়ের চাহিদা ছিল বেশি। আর তখন এ দেশের রপ্তানি পণ্যের তালিকায়ও ওপরের দিকেই ছিল চা। তবে বর্তমানে কিছু চা বিদেশে রপ্তানি হলেও দেশের কিছু ব্যবসায়ীরা ভারতসহ অন্যান্য দেশ থেকে কম মূল্যে নিম্নমানের চা আমদানি করে দেশীয় ভালো মানের চায়ের সাথে মিশ্রণ করে বাজারজাত করছে। এতে নিম্নমানের চা কিনে মানুষ একদিকে যেমন প্রতারিত হচ্ছে, অন্যদিকে দেশীয় চায়ের নিলাম বাজার চাঙ্গা না হওয়ায় চা বাগান মালিকরাও হচ্ছেন হতাশ। তাছাড়া বিদেশের বাজারে দেশীয় চায়ের বাজার সৃষ্টি না করায় দিন দিন চায়ের রপ্তানিতেও নেমেছ ধস। দেশীয় বাজারে যেখানে প্রতি কেজি চা ১৮০ টাকা দরে নিলামে বিক্রয় হচ্ছে। সেখানে বৈদেশিক বাজারে প্রতি কেজি চা বিক্রয় হয়েছে ১৯৬ টাকা দরে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত কয়েক বছর ধরে যেমন দেশে চায়ের চাহিদা বেড়েছে কয়েক গুণ। সেই সাথে চায়ের উৎপাদনও বেড়েছে অনেক। আর সেই সাথে দেশে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কয়েক বছর ধরে চায়ের রপ্তানি কমেছে। সেই সুযোগে বিদেশ থেকে প্রতিবছরই চা আমদানি করা হচ্ছে। তাই চা শিল্পকে রক্ষা করতে হলে অবিলম্বে চা আমদানির ক্ষেত্রে সরকারি ট্যারিফ বৃদ্ধি করা অত্যাবশ্যকীয় বলে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা মনে করছেন। অন্যদিকে বৈদেশিক বাজারে বাংলদেশের বাজার সৃষ্টি করতে না পারায় দিন দিন চায়ের রপ্তানি কমে আসছে। ২০১৫ সালে দেশের চা বিদেশে রপ্তানি হয়েছে ৭৫ হাজার ৮৭০ কেজি। শ্রীমঙ্গলের বাংলাদেশ চা গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ১৬৬টি চা-বাগান এবং ২৫৭ জন ক্ষুদ্র চাষি চা উৎপাদন করছেন। এর মধ্যে মৌলভীবাজারে ৯০টি, হবিগঞ্জে ২৩টি, চট্টগ্রামে ২২টি, সিলেটে ২২টি, পঞ্চগড়ে ৭টি এবং পার্ব্যত চট্টগ্রাম (রাঙ্গামাটি) ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি করে চা-বাগান আছে। সেই সাথে চা বোর্ডের কাছ থেকে পাওয়া উৎপাদন তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে দেশের চা-বাগানগুলোয় ৫ কোটি ৮৫ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়। ২০০৯ সালে চায়ের উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৬ কোটি কেজিতে। ২০১০ সালেও একই পরিমাণ চায়ের উৎপাদন হয়। কিন্তু চায়ের চাহিদা যখন ক্রমেই বাড়ছিল সে অবস্থায় ২০১১ সালে চায়ের উৎপাদন আগের চেয়ে কমে যায়। সে বছর উৎপাদিত হয় ৫ কোটি ৯১ লাখ কেজি চা। অবশ্য ২০১২ সালে দেশে উৎপাদনের পরিমাণ অনেকটা বেড়ে যায়। উৎপাদিত হয় ৬ কোটি ৩০ লাখ কেজি চা। চা বোর্ড সূত্র আরো জানায়, দেশের চা-বাগানগুলোর মোট আয়তন এক লাখ ১৬ হাজার হেক্টর হলেও ২০১৩ সাল পর্যন্ত এর মাত্র ৪৭ শতাংশ জমিতে চা চাষ হতো। তখন ৬২ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে চা চাষ হচ্ছিল না। এর পর থেকে অভ্যন্তরীণ চায়ের চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিতে এবং চায়ের অব্যাহত চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সংগতি রেখে দেশে চায়ের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে চা বাগান মালিক ও সংশ্লিষ্টদের কিছু নির্দেশনা দেয়া হয়। চায়ের উৎপাদন বাড়াতে নেওয়া হয় পরিকল্পনা প্রকল্পও। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ‘চা চাষ সম্প্রসারণ প্রকল্প’। ধীরে ধীরে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হওয়ায় এবং প্রতিবছরই অনাবাদি জমিতে চায়ের চাষাবাদ প্রসার করার ফলে চায়ের উৎপাদন বেড়েছে এবং রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এতে প্রতি হেক্টরে চায়ের উৎপাদন হয়েছে ১২৭০ কেজি। শ্রীমঙ্গলে বাংলাদেশ চা গবেষণা কেন্দ্র (বিটিআরআই) সংশ্লিষ্ট সূত্র হতে জানা যায়, ২০১৫ সালে চায়ের বাম্পার ফলন হয়েছে। চা উৎপাদন হয়েছে ৬৭.৩৮ মিলিয়ন কেজি। এর পরেও ১৫.৮৩ মিলিয়ন কেজি চা আমদানি করা হয়েছে। আর রপ্তানি হয়েছে ৭৫ হাজার ৮শ’ ৭০ কেজি চা। গত বছরের প্রথম দিকে আবহাওয়া চা শিল্পের অনুকুলে না থাকায় চায়ের উৎপাদন ২০১৪ সালের চা উৎপাদন থেকে পিছিয়ে ছিল। এর মধ্যে মাকড়সা ও লাল পিঁপড়ার আক্রমণও ছিল ভয়ঙ্করভাবে। এই শিল্পের সংশ্লিষ্টদের ধারণা করছিল ২০১৫ সালে চায়ের উৎপাদন ২০১৪ সালের চা উৎপাদন থেকে পিছিয়ে থাকবে। কিন্তু বছরের মাঝামাঝি সময়ে সারা দেশে হঠাৎ করে আবহাওয়া চায়ের অনুকুলে থাকায় চায়ের উৎপাদন ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। তিনি দাবি করেন, দেশে চা উৎপাদনে ১৫৯ বছরের ইতিহাস ভেঙেছে। এ বছর দেশে চা উৎপাদনে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। সদ্যসমাপ্ত ২০১৩ সালে দেশে মোট ৬ কোটি ৪০ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে, যা এ শিল্পের ১৫৯ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১২ সালে ৬ কোটি ২৬ লাখ ২০ হাজার কেজি চা উৎপাদন করে চা শিল্প রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল। ওই রেকর্ড ২০০৫ সালের বহুল আলোচিত রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ২০০৫ সালে দেশে চা উৎপাদিত হয়েছিল ৫ কোটি ৯৬ লাখ ১০ হাজার কেজি। অনুকূল আবহাওয়া, নতুন এলাকায় চা উৎপাদন সম্প্রসারণ, ক্লোন চা গাছের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং চা বোর্ডের নজরদারির ফলে গত মৌসুমে চা শিল্পের ইতিহাসে সর্বোচ্চ চা উৎপাদন হয়েছে। এ বছর দেশে চায়ের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৬ কোটি ৫ লাখ কেজি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেশে চা উৎপাদিত হয় ৬ কোটি ৪০ লাখ কেজি। যা দেশের চা উৎপাদনে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। চা শিল্পের ইতিহাসে ৬ কোটি ৪০ লাখ কেজি চা উৎপাদনের মাধ্যমে চা শিল্পের দেড়শ’ বছরের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হলো। তিনি জানান, দেশে চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ইতোমধ্যে বাংলাদেশ চা বোর্ড ‘ভিশন ২১’ বাস্তবায়ন করছে। এ পরিকল্পনার আওতায় চা উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ চা বোর্ড ১০টি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রতিটি প্রকল্পের সময় ১২ বছর। প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে ১০ কোটি কেজি চা বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি ও পঞ্চগড় জেলার ছয় হাজার ৪৪০ হেক্টর পতিত জমিতে আরও ১০৬টি চা বাগান তৈরি করে অতিরিক্ত চা উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া চা উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সম্প্রতি বিটি-১৮ জাতের নতুন চা গাছ লাগানো হয়েছে। এগুলোর ফলন ভালো এবং খরাসহিষ্ণু। এতে চা উৎপাদন ক্রমান্বয়ে বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। চা শিল্পের জন্য নেয়া কৌশলগত পরিকল্পনা ‘ভিশন-২০২১’ বাস্তবায়ন হলে দেশে চা উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়াবে ১০কোটি কেজি। আর ভিশন-২০২১ বাস্তবায়িত হলে ২ কোটি কেজি চা রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। অবশিষ্ট ৮ কোটি কেজি চা দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে পারবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ হারিয়ে যাওয়া বাজার ফিরে পাবে বলে চা শিল্পের সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন। শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শহিদুল হক জানান, চা শ্রমিকদের উন্নয়নে সরকার বদ্ধপরিকর। একটি প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার এই উপজেলার ২৭শ’ জন চা শ্রমিককে ৫০০০ টাকা করে অনুদান প্রদান করেছে। সেই সাথে এই চা শিল্পের উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট সকলকে তিনি অভিনন্দন জানিয়েছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দেশে চা উৎপাদনে নতুন রেকর্ড

১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ