Inqilab Logo

মঙ্গলবার ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চিলমারি নৌবন্দর ফাইলবন্দি

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ৬ বছর আটকে রেখেছে আমলারা

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ২১ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০১ এএম

৬ বছরেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুতি দেয়া প্রকল্পের বাস্তবায়ন নেই। টেন্ডার প্রক্রিয়া ও জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার মধ্যে আটকে আছে ঐতিহ্যবাহী চিলমারি নদীবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ। আমলাদের টেবিলে লালফিতায় বন্দি ফাইলপত্র। এ প্রকল্পের প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২৫ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা। এরমধ্যে এজন্য গত বছর ২৩৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) এর সভায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের অনুমোদন দেয়া হয়। প্রকল্পটি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডবিøউটিএ) বাস্তবায়ন করবে। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে গত ২০২১ সালের জানুয়ারী থেকে আগামী ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। নতুন এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও রংপুর জেলার প্রায় ৬০ লাখ মানুষ এবং বছরে প্রায় ৩ দশমিক ২৫ লাখ যাত্রী ও ১ দশমিক ৫ লাখ টন মালামালের সুষ্ঠু ও নিরাপদ উঠা-নামা নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি নৌ-বাণিজ্য ও অতিক্রমন প্রটোকলের আওতায় ভারতের আসাম এবং নেপাল ও ভুটানের সাথে যোগাযোগব্যবস্থা প্রবর্তনে অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। বুড়িমারি এবং সোনারহাট স্থলবন্দর থেকে পাথর চিলমারি দিয়ে বাহাদুরাবাদসহ দেশের বিভিন্ন পৌঁছানো সম্বব হবে। ইতোমধ্যে বন্দর প্রকল্প এলাকায় ঘাট নির্মাণ করা হয়েছে এবং গড়ে উঠেছে দোকানপাট।

ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম তীরে অবস্থিত যা জেলা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে। এ বন্দরটি এক সময় কৃষিপণ্য ক্রয়-বিক্রয় এবং যাত্রী ও মালামাল পারাপারে অন্যতম প্রধান বন্দর বাজার হিসেবে পরিচিত ছিল। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে যমুনা নদীর ভাঙন কমে আসবে। আবহাওয়া অবস্থা নিশ্চিত হবে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ,নদীর ভাঙন রোধ এবং নদীশাসন বাস্তবায়ন হবে। এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়বে। দিনে দিনে এ বন্দরের গুরুত্ব বাড়বে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর চিলমারিকে নদীবন্দর হিসেবে ঘোষণা করেন এবং অন্যান্য নদী ও সমুদ্রবন্দরের সাথে একে সংযোগ করার বিষয়ে জোর দেন। সে অনুসারে ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর এ সংক্রান্ত বাংলাদেশ গেজেট প্রকাশিত হয়। গেজেট প্রকাশের ৬ বছর পেড়িয়ে গেলেও চিলমারি নদীবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি। কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক বলছেন, গত ফেব্রæয়ারিতে জমি অধিগ্রহণের চিঠি পেয়েছি। আমার জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার কাজ শুরু করেছি। আশা করছি দ্রæত শেষ হবে।

এ বিষয়ে চিলমারি নদীবন্দর উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালক ও বিআইডবিøউটিএ’র পরিচালক মো. শফিউল হক ইনকিলাবকে বলেন, ইতোমধ্যে চিলমারি বন্দরের কার্যক্রম ও উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার শুরু করেছি। চিলমারি বন্দরের মধ্যে জমি অধিগ্রহণের জন্য কুড়িগ্রাম জেলার জেলা প্রশাসককে চিঠি দেয়া হয়েছে। তিনি (ডিসি) জমি অধিগ্রহণ প্রকিয়ার কাজ শুরু করেছেন। এর মধ্যে সভা করেছেন। আর আমরা এখনো টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু করেনি। তবে বন্দরে ডিজাইনের জন্য পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর পরে আগামী মাসে বন্দের টেন্ডার আহবান করা হবে। বন্দর পরিদর্শন করে তিনি আশ্বাস দিয়েছেনÑ এটি আন্তর্জাতিক নৌ-রুট হিসেবে ব্যবহৃত হবে। চিলমারি বন্দর বাস্তবায়নের প্রকল্পটি সরকার একনেকে পাস করেছে। আমরা সচেষ্ট রয়েছি, চিলমারি নদী বন্দরটি দ্রæত চালু হোক এবং এলাকার উন্নয়ন ঘটুক।

এক সময় দেশে ৮টি বৃহৎ নদীবন্দরের মধ্যে চিলমারি বন্দর ছিল অন্যতম বন্দর। বর্তমানে ৩৫টি নদীবন্দর রয়েছে। এ চিলমারি বন্দরসংলগ্ন ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে ব্রিটিশ আমলে বড় বড় জাহাজ চলাচল করত, পণ্যবোঝাই জাহাজ নোঙর করত। ১৯৬৭ সালের দিকে চিলমারি বন্দর এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙন তীব্র হয়ে ওঠে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বিলীন হয়ে যায় বন্দরটি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিলীন হওয়া বন্দরের তিন কিলোমিটার দূরে রমনা বাজারে সীমিত আকারে নতুন বন্দরের কাজ চলে। নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায়, অব্যবস্থাপনা এবং নৌপথের উন্নয়ন না হওয়ার কারণে আগের মতো বড় বড় জাহাজ এ রুটে আসতে পারে না। তবে এখানে কুড়িগ্রাম সীমান্ত থেকে ব্রহ্মপুত্র নৌরুটে ভারতের পণ্যবাহী জাহাজ সীমিত আকারে আসাম থেকে কলকাতায় যাতায়াত করে। কিন্তু নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় এ রুটে জাহাজ আসার সংখ্যা কমে গেছে। ভারতের জাহাজগুলো মূলত এ পথে আসামের শীলঘাট থেকে চাঁদপুর-বরিশাল হয়ে কলকাতা যাওয়া শুরু হয়ে যায়। চিলমারিতে রাজস্ব আদায়ের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একটি শুল্ক স্টেশন রয়েছে। বর্তমানে মাসে একটির বেশি জাহাজ আসে না। জাহাজের সংখ্যা একেবারে কমে যাওয়ায বন্দরের কোনো কর্মমুখরতা নেই। চিলমারির রমনা, ফকিরের হাট ও জোড়াগাছ ঘাট থেকে প্রতিদিন বাহাদুরবাদ, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, বাঘাবাড়ী, ফুলছড়ি, রৌমারী ও রাজিবপুরে নৌকা চলাচল করে। বর্তমানে চিলমারি নদীবন্দরের রমনা ঘাট এলাকায় কংক্রিট বাঁধ দেয়া হয়েছে। চিলমারি বন্দরে পাটের কারবার শুরু হয় তিরিশের দশকে। ব্রহ্মপুত্রের কোলঘেঁষে কয়েক কিলোমিটারব্যাপী ছিল বন্দরের অবস্থান। প্রশাসনিক ভবন, কাস্টমস অফিস, পাটের গোডাউন। জুট ট্রেডিং কোম্পানিসহ প্রায় ৩০টি পাটকল ও কোম্পানি এখানে কারবারজুড়ে বসে। স্থাপন করে বিশাল বিশাল পাট গুদাম। পাট প্রসেসিং ও বেল তৈরির মেশিন স্থাপিত হয়। পাট ক্রয়, বাছাই ও বেল তৈরির কাজে অনেক শ্রমিক এখানে কাজ করতেন প্রতিদিন। এর বাইরে শত শত বেপারি, কৃষক, ফরিয়াদের আগমন হতো এখানে। বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার গরুর গাড়ির মাধ্যমে দূর-দূরান্ত থেকে পাট এনে নারায়ণগঞ্জ, দৌলতপুর, খুলনা, চট্টগ্রামসহ নানা এলাকায় সরবরাহ করা হতো। বিদেশেও রফতানি করা হতো উন্নত মানের পাট। সে সময়ে আসামের সঙ্গে ফেরি সার্ভিস চালু ছিল। বলা চলে, বিভিন্ন এলাকার সঙ্গে নৌ যোগাযোগ ও পরিবহনের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল চিলমারি।

প্রকল্পটির এলাকা হচ্ছে, কুড়িগ্রাম জেলার অন্তর্গত চিলমারি উপজেলার রমনা ও জোড়গাছ ঘাট এলাকা, রাজিবপুর উপজেলার রাজিবপুর ঘাট ও নয়ারহাট ঘাট এলাকা এবং রৌমারী উপজেলার রৌমারী ঘাট এলাকা। প্রকল্পটির প্রধান উদ্দেশ্য বলা হয়, রংপুর বিভাগের অপেক্ষাকৃত সুবিধাবঞ্চিত কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারি, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার কতিপয় এলাকার নৌপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে চিলমারি এলাকায় বন্দর অবকাঠামো সুবিধাদি নির্মাণ।

প্রকল্পের কার্যপত্রে বলা হয়, চিলমারি বন্দর কুড়িগ্রাম জেলায় ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম তীরে অবস্থিত যা জেলা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে। এ বন্দরটি এক সময় কৃষিপণ্য ক্রয়-বিক্রয় এবং যাত্রী ও মালামাল পারাপারে অন্যতম প্রধান বন্দর বাজার হিসাবে পরিচিত ছিল। যমুনা নদীর ভাঙনে দিনে দিনে এ বন্দরের গুরুত্ব কমেছে। বর্তমানে স্থানীয়ভাবে অসংখ্য যাত্রী এবং মালামাল রৌমারী, রাজীবপুর, কোদালকাঠি, নায়েরহাট, অষ্টমিরচর ইত্যাদি এলাকা থেকে চিলমারি এলাকায় ওঠানামা করে থাকে। প্রতিদিন প্রায় ৫০০-৬০০ যাত্রী এ এলাকা দিয়ে যাতায়াত করে। শুধু রৌমারী ও চিলমারির মধ্যেই প্রতিদিন বৃহদাকার ৮-৯টি জলযান আসা-যাওয়া করে থাকে। চিলমারি এবং রাজীবপুরের মধ্যেও একইরকম সার্ভিস বিদ্যমান। ৬ থেকে ৭টি বৃহদাকার ইঞ্জিন বোট বিভিন্ন স্থানে যেমনÑ কাওমারি, বড়চর, নয়ারহাট, অষ্টমিরহাটিসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে নিয়মিত চিলমারিতে চলাচল করে থাকে। এছাড়া ৭০ থেকে ৮০ টন মালামাল প্রতিদিন এ বন্দর দিয়ে ওঠানামা করে। এছাড়া বাংলাদেশ ও ভারতের বিদ্যমান নৌ প্রটোকলে চিলমারি একটি পোর্ট অব সেল হিসাবে চিহ্নিত। চিলমারি বন্দরটির মাধ্যমে অন্যান্য পরিবহন মাধ্যম যেমন সড়ক, রেল ও নৌপথের সমন্বয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের উভয় তীরের জনগণের জন্য অন্যতম পরিবহন হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব।
গত ২০০৯ সালে চিলমারি বন্দরের উজান ও ভাটিতে ৮০ কিলোমিটার নৌরুটে নাব্যতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিআইডবিøউটিএ সমীক্ষা চালালেও পরবর্তী সময়ে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। চিলমারির অতীত বিবেচনা করে ২০১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিলমারি উপজেলার অর্থনৈতিক উন্নয়নে চিলমারি নৌবন্দরের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রæতির ঘোষণা দিলে পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে চিলমারি নৌবন্দরের নৌ- যোগাযোগেরও কথা বলেন। এর পরে ২০১৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর চিলমারির রমনা ঘাট নামক স্থানে একটি পল্টুন স্থাপন করে চিলমারি নদীবন্দরের উদ্বোধন করেন তৎকালীন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। কিন্তু গত ৬ বছরেও নৌবন্দরের কাজের খুব বেশি অগ্রগতি নেই। বন্দরটি চালু রাখার একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রয়োজনীয় ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা করা। বর্তমানে বড় ভ্যাসেলগুলো চলাচলের জন্য বিআইডবিøউটিএ অল্প পরিমাণ ড্রেজিং করছে। কিন্তু পণ্যবাহী বড় জাহাজ চলাচলের জন্য গভীর ও প্রশস্ত করে ড্রেজিং করা প্রয়োজন।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন ও বাণিজ্য প্রটোকল (পিআইডবিøউটিটি) স্বাক্ষরিত হয় এবং এ পর্যন্ত এতে দুটি সংযোজন ঘটেছে। প্রথম সংযোজন ২০১৫ সালের ৬ জুন বাংলাদেশ ও ভারত পিআইডবিøউটিটি নবায়ন করেছে, যেখানে আটটি চিহ্নিত রুটের মধ্যে চিলমারিকে বাংলাদেশের পোর্ট অব এক্সিট (রুটস ১ ও ৭) ও এন্ট্রি (রুটস ২ ও ৪) এবং কার্গো জাহাজের বাঙ্কারিং পয়েন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। গত ২০২০ সালের ২০ মে পিআইডবিøউটিটির দ্বিতীয় সংযোজনে বাংলাদেশের আগের ছয়টি পোর্ট অব কলের সঙ্গে নতুন করে পাঁচটি পোর্ট অব কল সংযোজন করা হয়েছে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চিলমারি
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ