ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা : দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাবেই বৈদেশিক শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। সরকার অতিমাত্রায় অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ব্যস্ত থাকায় বৈদেশিক বাণিজ্য, কর্মসংস্থান ও কূটনীতিতে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে। বৈদেশিক শ্রমবাজার সম্প্রসারণ দূরের কথা ক্রমেই তা সঙ্কোচিত হয়ে আসছে। ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহে আশঙ্কাজনকভাবে ভাটার টান পড়েছে। দেশের ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ কমতে কমতে এখন সর্বনি¤œ পর্যায়ে নেমে এসেছে। প্রতিবেশী দেশের সাথে বাণিজ্য ঘাটতিও ক্রমবর্তমান। রাষ্ট্রযন্ত্রের উদাসীনতায় বৈদেশিক সাহায্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। প্রতিশ্রুত অর্থও ছাড় করাতে পারছে না রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনাকাঙ্খিত অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। যদিও সরকারের পক্ষে তা স্বীকার করা হচ্ছে না।
দেশের অর্থনীতিতে এই হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতিতে শুধু দেশীয় নয় বরং আন্তর্জাতিক মহলও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এমনকি ব্যবসার জন্য বাংলাদেশ আদর্শ স্থান নয় বলে মন্তব্য করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী বাণিজ্য সাময়িকী ফোর্বস। সম্প্রতি প্রকাশিত ফোর্বস সাময়িকীর ‘দ্য বেস্ট কান্ট্রিজ ফর বিজনেস-২০১৫’ শীর্ষক প্রতিবেদন মতে, ব্যবসার পরিবেশের দিক থেকে ১৪৪ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২১তম। দক্ষিণ এশিয়ার সবার নিচে আছে বাংলাদেশ। ১১টি উপদানের ভিত্তিতে প্রতিটি দেশের ব্যবসার পরিবেশ বিশ্লেষণ করেছে ফোর্বস। এগুলো হলো বাণিজ্য স্বাধীনতা, আর্থিক স্বাধীনতা, সম্পত্তি অর্জনের অধিকার, উদ্ভাবন, প্রযুক্তি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, বিনিয়োগকারীর সুরক্ষা, দুর্নীতি, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, করের বোঝা ও শেয়ারবাজারের অবস্থা। সূচকগুলো বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ফোর্বস বলেছে, বিশ্বে ব্যবসা করার জন্য উৎকৃষ্ট দেশ ডেনমার্ক। শীর্ষ পাঁচে এরপর রয়েছে নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড ও সুইডেন। তালিকায় শেষের পাঁচটি দেশ হলো যথাক্রমে মিয়ানমার, হাইতি, লিবিয়া, গিনি ও চাদ। আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশেগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা ৯১, ভারত ৯৭, ভুটান ১০১, পাকিস্তান ১০৩ ও নেপাল ১১৮তম অবস্থানে রয়েছে। শীর্ষ ২৫টি দেশের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই ইউরোপের দখলে। বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর শীর্ষ থাকা যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান চার ধাপ পিছিয়েছে। এ বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ২২তম।
আসলে ব্যবসার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বিনিয়োগ সুরক্ষা, পরিবেশের স্থিতিশীলতা ও ব্যবসাবান্ধব কর কাঠামো। এছাড়াও ঋণের সহজ প্রাপ্তি, সম্পত্তির মালিকানা লাভের প্রক্রিয়া, আধুনিক প্রযুক্তি, নতুন উদ্ভাবন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার অনুপস্থিতি এবং বাকস্বাধীনতাও ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। এসব মানদ-ে কোনটিতেই সুবিধাজনক অবস্থানে নেই বাংলাদেশ। ফলে আন্তর্জাতিক লগ্নী প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ থেকে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে শুরু করেছে। আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জাতীয় অর্থনীতিতে।
বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় সবসময়ই রফতানি আয়ের চেয়ে বেশি। আমদানি যতটুকু বেশি, ততটুকু হলো বাণজ্যি ঘাটতি। বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের বড় দরপতনের কারণে বাণিজ্যে ঘাটতি কমে আসবে বলে মনে করা হয়েছিল; কিন্তু পরিসংখ্যান তা বলছে না। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য ব্যাপকভাবে হ্রাস পেলেও অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম কমেনি। মনে করা হয়েছিল যে, ব্যাপক ঘাটতি পূরণ করতে এটি সহায়ক হবে। কিন্তু তেলের দাম সমন্বয় বাণিজ্যনীতিকে সময়োপযোগী করতে সরকারের উপর্যুপরি ব্যর্থতার কারণেই আমরা সে সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। ফলে জনজীবনের এর খারাপ প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। লেনদেনে ভারসাম্যের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বরে) বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে ৩২৬ কোটি ২০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরে একই সময়ে ছিল ৩০৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার। বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে প্রায় ৭ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে আমদানি ও রফতানি বেড়েছে ৭ শতাংশের মতো। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাস পর্যন্ত বাণিজ্য ঘাটতি আগের বছরের একই সময়রে চেয়ে কম ছিল। এর কারণ, আমদানি ব্যয় ছিল কম। গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে আমদানি বেশ বেড়েছে। কিন্তু রফতানি সেই আগের অবস্থাতেই আছে।
আসলে বৈদেশিক লেনদেনে আমদানি-রফতানি ও রেমিট্যান্স মুখ্য ভূমিকা রাখে। সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি বড়েছে। কমেছে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণও। রেমিটেন্স নিয়ে দুশ্চিন্তা বেড়েছে। রেমিটেন্সের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ ভোগের সম্পর্ক রয়েছে। রেমিট্যান্স কমে গেল অর্থনীতিতে চাহিদা কমে যেতে পারে। রেমিট্যান্সের সঙ্গে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধির সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৮৬৪ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে চেয়ে বেশ কম। গত অর্থবছরে তেলের দাম কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের সার্বিক পরিস্থিতি ভালো ছিল না। এর পরও রেমিট্যান্সে প্রায় ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল। আইএমএফ বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের ভবিষ্যত নিয়ে নেতিবাচক বার্তা পাঠিয়েছে। রফতানি নিয়েও সংস্থাটির আশাবাদ খুবই হতাশাব্যঞ্জক। এ অবস্থায় আইএমএফ চলতি র্অথবছর শেষে বাংলাদেশের চলতি হিসাবে ২৭০ কোটি ডলারের ঘাটতি থাকবে বলে সংস্থাটি জানিয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ নিয়ে এক পর্যালোচনায় আইএমএফ এমন মতামত দিয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিদেশের সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে বর্তমানে একমাত্র দুর্বলতা রেমিটেন্স। আমদানি বেড়ে যাওয়া নেতিবাচক নয়। কিন্তু আমদানি-রফতানির মধ্যে একটা যৌক্তিক ভারসাম্য তৈরি করা জরুরি। সরকারের ভ্রান্তনীতির কারণে বিদেশে শ্রমবাজার ক্রমেই সংকোচিত হচ্ছে, ফলে আশঙ্কজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। কিন্তু সরকার এ সমস্যা সমাধানে কোন কার্যকর সমাধান না করে কথামালার ফুলঝুরির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। বিদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টির কথা ফলাও করে প্রচার করা হলেও তা একেবারেই অন্তসারশূন্য বলেই মনে হয়। সম্প্রতি আগামী ৩ বছরে মালয়েশিয়ায় ১৫ লাখ শ্রমিক পাঠানোর কথা বলা হয় সরকারের পক্ষে। কিন্তু তা কতখানি বাস্তবসম্মত তা অবশ্য সময়ই বলে দেবে।
এদিকে আইএমএফ-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ রফতানি পণ্যের প্রধান গন্তব্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে অর্থনীতিতে মন্দাভাব চলছে। এ পরস্থিতি রফতানি আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ১২টি দেশের মধ্যে সম্প্রতি যে টিপিপি চুক্তি হয়েছে, তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। তাদের মধ্যে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য হবে বিধায় প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এক-চর্তুথাংশ রফতানি হয় টিপিপিভুক্ত দেশে। আইএমএফ বলছে, বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তেলের নি¤œমূল্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর ইতোমধ্যেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির সবেচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো প্রতিবেশী দেশের সাথে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যঘাটতি। দেশটির সঙ্গে ১০ বছরে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে চারগুণ। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আট বছরে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ। ক্রমেই বাংলাদেশের প্রতিকূলে যাচ্ছে বাণিজ্য ভারসাম্য। ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাতটি ছিল ১৬০ কোটি ৬৫ লাখ ডলার। ১০ বছরের ব্যবধানে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এসে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৯৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এক বছরের ব্যবধানে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ৩৩.৭৬ শতাংশ। যদিও এ সময়টায় ট্রানজিট থেকে শুরু করে বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করার সুযোগসহ অনেক কিছু পেয়েছে ভারত। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাষায়, ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সুসম্পর্ক শুধুই দেয়ার জন্যই। ত্যাগে আনন্দিত এ দেশের নীতিনির্ধারকরা।
আসলে জাতীয় অর্থনীতিতে চাঙ্গাভাব আনতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু দেশে যে অচলবস্থা চলছে তাতে সহসাই এ অবস্থা উত্তরণের কোন সম্ভবনা দেখা যাচ্ছে না। আর এ কারণেই দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতিকূলে চলে গেছে। তাই ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যাতে বিনিয়োগে নিরাপদবোধ ও আগ্রহী হয়ে ওঠেন সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দেয়া জরুরি। একই সাথে বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতিও একটা যৌক্তিক পর্যায়ে আনতে হবে। সংকোচিত বৈদেশিক শ্রমবাজারও সম্প্রসারণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। গতিশীলতা আনতে হবে রেমিট্যান্স প্রবাহেও। একমাত্র সরকারের সদিচ্ছা ও কার্যকর উদ্যোগই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।