Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নির্বিঘ্নে পাচার হচ্ছে স্বর্ণ

ধরাছোঁয়ার বাইরে গডফাদাররা। ভারত-বাংলাদেশ স্থল সীমান্তে সক্রিয় ৮০ চক্র সীমান্ত ঘেঁষা ১২ জেলার অর্ধশতাধিক পয়েন্টে সক্রিয় ১৮ ভারতীয় চোরাকারবারি

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ১৬ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০০ এএম

সীমান্ত ঘেঁষা ১২ জেলার অর্ধশতাধিক পয়েন্ট দিয়ে ভারতে স্বর্ণ পাচার বাড়ছে। ভারতে কোটি কোটি টাকার স্বর্ণ পাচার হচ্ছে, আর ওপার থেকে আসছে মাদক। নির্বিঘ্নে পাচারের জন্য অভিনব কৌশল নিচ্ছে পাচার চক্রের সদস্যরা। এরা কখনো কৃষক, দিন-মজুর, ট্রাক-লরির চালক, খালাসি, রাখাল ও জেলে সেজে স্বর্ণ পাচার করছে। টিফিন বক্স, মৌসুমি ফলের ঝুড়ি, সবজি ও মানব শরীরে স্বর্ণ পাচারের সময় হরহামেশাই গ্রেফতারও হচ্ছে। সারা দেশে অন্তত ৮০টি সিন্ডিকেট ভারতে স্বর্ণ পাচারে সক্রিয় থাকার তথ্য রয়েছে। মূলত তাদের নিয়ন্ত্রণেই পাচার হচ্ছে স্বর্ণের চালান। আর এসব চক্রের সঙ্গে শাহজালাল, শাহ আমানত ও ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের যোগসাজশ আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে চোরাচালানের মূল হোতাদের ধারেকাছেও যেতে পারছে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। যার ফলে বড় চালানগুলো থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

সূত্র জানায়, বিদেশ থেকে স্বর্ণ আসার পরই সীমান্ত এলাকা দিয়ে ১৮ ভারতীয় চোরাকারবারি বাংলাদেশের কারবারিদের কাছ থেকে চালান নিয়ে যায়। সাতক্ষীরা, বেনাপোল, কুষ্টিয়া, যশোর, লালমনিরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী দিয়ে বেশি স্বর্ণ পাচার হচ্ছে। স্বর্ণ চোরাকারবারিরা বাংলাদেশের মোবাইল-সিম ব্যবহার করে। এসএমএসের মাধ্যমে চালানের তথ্য আদান-প্রদান হয়। আকাশপথে আসা স্বর্ণ বাস ও ট্রেনে সীমান্ত জেলাগুলোতে যায়।

বিজিবির কর্মকর্তারা বলছেন, দুই দেশের সীমান্ত রক্ষীরা স্বর্ণ পাচারের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে নজরদারি করছে। যে সব পয়েন্ট দিয়ে স্বর্ণ পাচার হচ্ছে সেখানে নজরদারি ও টহল বাড়ানো হলেও কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি সময়ে স্বর্ণ পাচার তৎপরতাও বেড়ে গেছে অস্বাভাবিকভাবে। গ্রেফতার হলেও জামিনে বেরিয়ে ফের কারবারে নেমে পড়েন।

শুল্ক গোয়েন্দা ও সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একাধিক কর্মকর্তারা সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বর্ণ পাচার সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য ফিরোজ আলম। তিনি প্রায়ই দুবাই আসা-যাওয়া করেন। এছাড়া আলোচিত পাচারকারীদের মধ্যে রয়েছেন মোহাম্মদ আনিস ও মোহাম্মদ ওয়াহেদুজ্জামান। তাদের বাসা সায়েদাবাদ। একাধিকবার বিদেশ ভ্রমণ করেন তারা। বর্তমানে তারা সিঙ্গাপুর অবস্থান করছেন। আরেকজন আবদুল আউয়াল। তার সঙ্গে শাসক দলের একাধিক নেতার যোগাযোগ রয়েছে। আরেক সিন্ডিকেট সদস্য ফারুক আহম্মেদ বর্তমানে অবস্থান করছেন দুবাই। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি স্বর্ণ পাচার করছেন। এর বাইরে সোহেল রানা, সুমন সারোয়ার, খলিল রহমান, মনির আহম্মেদ, ওয়ায়েদউল্লাহ, মিরপুরের সাইফুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জের মঞ্জুর হোসেন, পল্লবীর সামসুল হুদা, মুন্সীগঞ্জের ইসলাম শেখ, রাজবাড়ীর মোহাম্মদ হানিফ, মুন্সীগঞ্জের মোহাম্মদ রুবেল, বেবিচকে কর্মরত শরীয়তপুরের মিজান, শরীয়তপুরের রফিকুল ইসলাম, গফরগাঁওয়ের আনসার উল্লাহ জসিম, ফরিদপুরের ইদ্রিস মোল্লা, ভারতীয় নাগরিক রূপসাহা, গোপাল বিজন, বিজন হালদার, লক্ষণ সেন, গোবিন্দ বাবু, লালু জয়দেব, গওহর প্রসাদ, সঞ্জীব, রামপ্রসাদ, মিন্টু, সুমন চ্যাটার্জি, রিয়াজ, তপন সাহা, ডালিম, মোনায়েম, ফারুক, বসাক চ্যাটার্জি ও স্বপন সাহা বাংলাদেশে স্বর্ণ পাচারের সঙ্গে জড়িত। তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রোফাইল আছে তদন্তকারী সংস্থাগুলোর কাছে।
কাস্টমস ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, চোরাকারবারিরা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোসহ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও দুবাই থেকে স্বর্ণ এনে বাংলাদেশ ও ভারতের বাজারে সরবরাহ করছে। এ কাজে তারা নিজস্ব বাহক যেমন কাজে লাগাচ্ছে, তেমনি টাকার টোপে কখনো পাইলট, কখনো ক্রু, কখনো বিমানবালাকেও কাজে লাগাচ্ছে। তাছাড়া বিমানের ক্লিনার, ট্রলিম্যান এমনকি প্রকৌশলীরাও এই চক্রের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে স্বর্ণ পাচার চালিয়ে যাচ্ছে। যাত্রীবেশী বাহকের সঙ্গে থাকা ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, ইলেকট্রিক মোটর, দেহের বিভিন্ন অংশ, ট্রলির ওপরের হ্যান্ডেল ও মানিব্যাগে করে স্বর্ণ পাচারের ঘটনা ঘটছে। এছাড়া রোগী সেজে হুইল চেয়ারে, ঊরুতে অ্যাংকলেট বেঁধে, জুতার মধ্যে, বেল্ট দিয়ে কোমরবন্ধনীর ভেতরে, শার্টের কলারের ভেতরে, স্যান্ডেলের সঙ্গে, সাবান কেসে, সাউন্ড বক্সের অ্যাডাপটরে লুকিয়ে, বিভিন্ন ধরনের খাদ্য বা ওষুধের কৌটা, প্যান্টের নিচে শর্টসের ভেতর, ল্যাপটপের ব্যাটারির ভেতর, মানিব্যাগে ও গলায় চেইনের সঙ্গে ঝুলিয়ে লকেট হিসেবেও আনা হচ্ছে সোনার বার।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজিবির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, বিজিবি সীমান্ত রক্ষায় সব সময় চেষ্টা করছে পাচার রোধ। তারপরও নিরঙ্কুশ ও নিশ্চিত করা যায়নি। সোনা চোরাচালান ধরা পড়ার পর পাচারকারীরা কৌশল বদলায়, নতুন রুট তৈরি করে। ব্যবসায় তাদের লাভ বেশি তাই ঝুঁকিও তারা নেয়। তারপরও বিজিবি কাজ করছে।

কেনো গডফাদার ধরা পড়ে না বা আলোচিত হোতারা বাইরে থাকে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, অনেক সময় পরিত্যক্ত অবস্থায় স্বর্ণের বার পাওয়া যায়। বিজিবির অভিযান বুঝতে পেরে পালিয়ে যায়। যারা ধরা পড়ে তারা বাহক মাত্র। তারা নানা কৌশলে হাত বদল করে। একেটা গ্রুপ একেক অংশে দায়িত্ব পালন করে, যার কাছ থেকে তারা গ্রহণ করে তাদের যেমন তারা চেনে না তেমনি যার কাছে দেয় তাদেরকেও চেনে না। কিছু সাংকেতিক, কিছু সিম্বল তারা ব্যবহার করে একে অপরের কাছে বদল করে। এ কারণে যেমন শিকড়ের গোড়ায় যাওয়া যায় না।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছেন, সীমান্তঘেঁষা ১২ জেলার অর্ধশতাধিক পয়েন্ট শনাক্ত করা হয়েছে চলতি বছরই। পাচারের জন্য চুয়াডাঙ্গায় রয়েছে তিনটি পয়েন্ট। সেগুলো হলো- কাপাসডাঙ্গা, দর্শনা ও জীবননগর। সাতক্ষীরা লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী ৬ পয়েন্ট দিয়ে পাচার হয়। পয়েন্টগুলো হলো-ভাদিয়ালী, কালীগঞ্জ, শেরপুর, ভোমরা, নোংলা ও কৈখালী। যশোরের রয়েছে পাঁচ পয়েন্ট। এ ছাড়া রাজশাহীর সোনাইকান্দি, হরিপুর, কাশিডাঙ্গা, আলাইপুর, বাগা, মুক্তারপুর, চড়ঘাট। চাঁপাইনবাবগঞ্জের কিরণগঞ্জ, ভোলাহাট। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট, ফুলবাড়ী, হিলি, কামালপুর ও বিরল সীমান্ত, কুড়িগ্রাম সীমান্ত এলাকার রৌমারী ও ফুলবাড়ী। লালমনিরহাটের বুড়িরহাট, শ্রীরামপুর, দহগ্রাম সীমান্ত।

ধস্তাধস্তিতে স্বর্ণের বার ফেলে নদীতে ঝাঁপ দিল পাচারকারীরা: বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, বিজিবি সদস্যরা গত শুক্রবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে শার্শার পাঁচভূলোট সীমান্তে অভিযান চালান। এ সময় অগ্রভূলোট গ্রামের ভেতর থেকে লুঙ্গি পরা তিনজন হেঁটে সীমান্তের দিকে যাচ্ছিলেন। সীমান্তের ১০০ গজের কাছে পৌঁছালে বিজিবি সদস্যরা তাদের জাপটে ধরেন। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে তারা কোমরে বাঁধা স্বর্ণের প্যাকেট ও লুঙ্গি খুলে রেখে দৌড়ে ইছামতী নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে ভারতের দিকে চলে যান। ফেলে যাওয়া প্যাকেট থেকে ৪৩টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। যার ওজন ৫ কেজি ১৪ গ্রাম। মূল্য সাড়ে তিন কোটি টাকা।

খুলনা ব্যাটালিয়ন (২১ বিজিবি) অধিনায়ক লে. কর্নেল তানভীর রহমান বলেন, বাংলাদেশ থেকে ওই স্বর্ণ ভারতে পাচারের জন্য সীমান্তের দিকে নেয়া হচ্ছিল। অভিযানের সময় ৪৩টি স্বর্ণের বার ফেলে তিনজন পালিয়ে যায়।



 

Show all comments
  • Md. Aman Ullah Talukder ১৬ অক্টোবর, ২০২২, ৭:৪৪ এএম says : 0
    প্রশ্ন হচ্ছে স্বর্ণের দাম কি ভারতে অনেক বেশী যে পাচার করতে হবে?
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নির্বিঘ্নে পাচার হচ্ছে স্বর্ণ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ