Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিদেশে কদর দেশীয় ফার্নিচারের

ছুটির দিনে ঢাকায় জমজমাট মেলা

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ৮ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০০ এএম

দেশের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বাইরে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বাংলাদেশের ফার্নিচার শিল্প। গত ১০ বছরে এই খাতে রফতানি বেড়েছে ১০ গুণের বেশি। বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতির তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১১০ দশমিক ৩৬ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ফার্নিচার রফতানি করা হয়েছিল, যা আগের বছরের তুলনায় ৩৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেশি। এর আগে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে আসবাবপত্র রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার। এর বিপরীতে আয় হয়েছে ৬ কোটি ৩১ লাখ ডলার। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় যা ২১ লাখ ডলার বেশি। ইপিবি সূত্র জানায়, ২০১০-১১ অর্থবছরে ১৫২ কোটি ১৬ লাখ টাকার আসবাবপত্র বিদেশে রফতানি হয়েছে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো’র তথ্য মতে, দেশের ফার্নিচার শিল্প প্রায় প্রতিবছরই রফতানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করছে। বিনিমিয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করলেও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় নিজের অবস্থান সংহত করতে খাতটি হিমশিম খাচ্ছে। অথচ তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য খাতের মতো নীতি সহায়তা পেলে এ খাত থেকে বড় অঙ্কের বৈদশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এ শিল্পের উন্নয়নে যুগোপযোগী নীতি কৌশল ও কর কাঠামো নিয়ে সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, এ শিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত দেশের অর্থনীতি। কাঁচামাল আমদানিতে উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের বড় অঙ্কের শুল্ক দিতে হয়। এতেই চূড়ান্ত পণ্যের দাম বেড়ে যায়।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, বিশ্বে ৪৮ হাজার ৭০ কোটি ডলারের ফার্নিচার বাজারের ৩১ দশমিক ৭ ভাগই চীনের দখলে। ২০২৫ নাগাদ এই বাজারের আকার হতে পারে ৬৫ হাজার ৪৬০ কোটি ডলার। তবে আশার কথা ফার্নিচার খাতে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে চীন। তাই এ খাতে ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের জন্য।
সূত্র মতে, দেশের ফার্নিচার বাজার প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার। যার ৯৫ শতাংশ পূরণ করছে দেশে উৎপাদিত ফার্নিচার। দেশের মার্কেটের চাহিদাপূরণের পর এখন রফতানিতে ব্যাপক সম্ভাবনা দেখছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, কাঁচামাল আমদানিতে সরকারের নীতি সহায়তা পেলে এ খাত থেকে রফতানি আয় বাড়বে। আর এ খাত শ্রমঘন হওয়ায় অধিক কর্মসংস্থানেরও সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতির চেয়ারম্যান সেলিম এইচ রহমান বলেন, ফার্নিচার খাতের প্রসার ঘটছে। বাংলাদেশে এক সময় প্রচুর ফার্নিচার আমদানি হতো। এখন স্থানীয় উদ্যোক্তারা ৯৫ শতাংশ পূরণ করছে। ফার্নিচার শিল্পের জন্য হার্ডওয়্যার, লিকার, ফেব্রিক্সসহ অনেক কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে ডিউটি, ট্যাক্স ও ভ্যাট সব কিছু মিলে ১০০ শতাংশের উপরে দিতে হয়। কাঁচামাল আমদানি করে যখন পণ্য রফতানি করি তখন আমরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ি। আমাদের পণ্য উৎপাদন খরচ বেশি হয়। বন্ডের ওয়্যারহাউজ সুবিধা পেলে, বাংলাদেশের ফার্নিচারের রফতানি আরো বাড়বে।
সেলিম এইচ রহমান বলেন, ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী ফার্নিচারের বাজারের আকার ৭০০ বিলিয়ন ডলারের। প্রতি বছর এই বাজার বড় হচ্ছে। সরকারের নীতি সহায়তা পেলে আমাদের সুযোগ আছে এ খাতে রফতানি আয় বাড়ানো। এই শিল্পকে কেন্দ্র করে এখনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। তাই দক্ষ জনবল পেতে বেগে পেতে হয়। তিনি বলেন, ১৫-২০টি প্রতিষ্ঠান এখন রফতানি করছে। সর্বশেষ বাজেটে ফার্নিচারের বেশ কিছু কাঁচামালের উপর আগের থেকে আরও ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয় যা ফার্নিচার শিল্পের জন্য আরও দুঃসংবাদ। একই সঙ্গে ফার্নিচার এখন আর বিলাস দ্রব্য নয়; মানুষের প্রয়োজনীয় পণ্য। কিন্তু অনেক আমদানিকৃত কাঁচামালকে বিলাসদ্রব্য হিসেবে ধরা হয়। যা এ শিল্পের জন্য প্রতিবন্ধক বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতির তথ্য মতে, তাদের তিন হাজারের বেশি সদস্য রয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। দেশে এখন ফার্নিচার মার্কেট প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার। ২০২১-২২ অর্থবছরে ১১০ দশমিক ৩৬ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ফার্নিচার রফতানি করা হয়েছিল, যা আগের বছরের তুলনায় ৩৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশ ভারত, নেপাল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে ফার্নিচার রফতানি করে। ল্যাবরেটরি, স্পা, অফিস, রেস্টুরেন্ট, ক্যাম্পিং সাইট, শোবার ঘর, লাইব্রেরি, পার্ক এবং দোকানে ফার্নিচার ব্যবহৃত হয়।
বেশিরভাগ আসবাবপত্রই বিভিন্ন ধরনের উপকরণ ব্যবহার করে তৈরি করা হয় এবং বৈচিত্র্যময় নানান নকশায় পাওয়া যায়। পারটেক্স স্টার গ্রুপের চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) শাহ আলম মুন্সী বলেন, ফার্নিচার শিল্পে ব্যবহার করার জন্য ৭০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। এগুলো আমরা হাই ট্যাক্স দিয়ে নিয়ে আসি। এখন লেবার খরচ, সিপিং খরচ বেড়ে গেছে। সব মিলে আমাদের পণ্য উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, ১০ দিন আগে ভিয়েতনামে একটি কনফারেন্সে গিয়েছি। সেখানের ফার্নিচার উৎপাদন দেখেছি। তাদের এক্সেসরিজ ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শক্তিশালী। আমাদের এখানে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ গড়ে তুলতে হবে। আমাদের কাঁচামাল খরচ কমে গেলে পণ্য উৎপাদন ব্যয় কমে যাবে। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য রফতানিতে সক্ষমতা বাড়বে।
উড টেক সলুশনের (ডব্লিউটিএস) প্রতিষ্ঠাতা মো. নইমুল হোসেন খান। গত দুই দশক ধরে এ শিল্পের উন্নয়নে অনন্য ভূমিকা রাখছেন। ফার্নিচার শিল্পকে প্রযুক্তিনির্ভর করা, এ খাত সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষিত করাসহ খাতটিকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে কাজ করছেন। প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কারখানার নকশা (ফ্যাক্টরি ডিজাইন) করা, মেশিনারিজের লে-আউট তৈরি, প্রয়োজনমতো মেশিনারিজ দেয়া, হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে দক্ষ জনবল তৈরি করা এবং আফটার সেলস সার্ভিস দেয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে কাজ করছেন। এরই মধ্যে ডব্লিউটিএস আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত বাংলাদেশের আসবাবপত্র নির্মাণ খাতের একমাত্র ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেশিনারিজ ব্র্যান্ড। বাংলাদেশ ও চীনে নিবন্ধন করা ডব্লিউটিএস’র মেশিন বর্তমানে সার্কভুক্ত দেশের পাশাপাশি ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, সউদী আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, বাহরাইন, ওমান, ইরান, মিসর, মরক্কো, আলজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজেরিয়া, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, বুলগেরিয়াসহ বিশ্বের ৪৩ দেশে রফতানি করা হচ্ছে। নইমুল খান বলেন, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে বাংলাদেশের ফার্নিচার শিল্পের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বেশ পেছনে পড়ে রয়েছি।
অবশ্য ব্র্যান্ডের ফার্নিচার কোম্পানির সাথে সাথে নন-ব্র্যান্ড ফার্নিচার শিল্পও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক হতে পারে। পাশাপাশি বর্তমানে দেশ-বিদেশে মানুষ পরিবেশবান্ধব পন্যের দিকে ঝুঁকছে, সেই হিসেবে প্লাস্টিকের চেয়েও কাঠের ফার্নিচার পরিবেশ সম্মত হওয়ায় আগামীতেও এর চাহিদা বাড়বে। তবে এখানে মূল সমস্যা তদারকির অভাব। এসএমই ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, কম করে হলেও বার্ষিক ৩০ হাজার কোটি টাকার বাজার দেশের ফার্নিচার খাতের, এরমধ্যে নন-ব্র্যান্ড ফার্নিচারের বাজারের বাজার ৫০ শতাংশের বেশি। উদ্যোক্তারা বলছেন, সরকারি নীতির সহায়তা পেলে ব্র্যান্ডেড ফার্নিচার কোম্পানির সাথে সাথে এই শিল্পও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক হতে পারে, কারণ বিশ্বব্যাপী পরিবেশবান্ধব পণ্যের চাহিদা বাড়ছে।
খাত সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ নন-ব্র্যান্ড আসবাবপত্র এসব ক্ষুদ্র কারখানায় তৈরি নির্মিত হয়। তাদের বাদ দিয়ে ছোট ও মাঝারি পর্যায়ের কারখানার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় হাজার। এর বাইরে সারাদেশে প্রায় ৬ হাজার ৫০০টি এসব নন ব্র্যান্ড ফার্নিচার কারখানা গড়ে উঠেছে।
এ ব্যাপারে এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. মুফিজুর রহমান বলেন, বর্তমানে দেশ-বিদেশে মানুষ পরিবেশবান্ধব পণ্যের দিকে ঝুঁকছে, সেই হিসেবে প্লাস্টিকের চেয়েও কাঠের ফার্নিচার পরিবেশ সম্মত হওয়ায় আগামীতেও এর চাহিদা বাড়বে। ইতোমধ্যে সারাদেশে এসব স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠা বেশ কিছু ক্লাস্টারে আমরা সম্ভাব্যতা যাচাই গবেষণা করেছি। সামনে কারিগর শ্রমিকদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোকে উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার জন্যও সুপারিশ করেন তিনি।
ছুটির দিনে জমজমাট ফার্নিচার মেলা
ছুটির দিনে গতকাল ক্রেতা-দর্শনাথীতে জমজমাট ছিল ফার্নিচার মেলা। ক্রেতারা সাধ্যের মধ্যে ভালো মানের ফার্নিচারের খোঁজে মেলায় ভিড় করেছেন। গত বৃহস্পতিবার দেশীয় ফার্নিচার শিল্পের সবচেয়ে বড় আয়োজন ১৭তম জাতীয় ফার্নিচার মেলা শুরু হয়েছে। করোনার কারণে ২ বছর পর এবার মেলার আয়োজন। রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরাতে (আইসিসিবি) পাঁচ দিনব্যাপী এ মেলার উদ্বোধন করেন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। আগামী ১০ অক্টোবর পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত মেলা চলবে। আয়োজকরা জানান, মেলার উদ্দেশ্যÑ দেশীয় ফার্নিচার শিল্পের বিকাশ ঘটানোর পাশাপাশি দেশের বাইরেও রফতানি বাড়ানো। মেলায় হাতিল, আক্তার, নাভানা, পারটেক্স, রিগাল, নাদিয়া এবং ব্রাদার্সসহ ৩৪টি প্রতিষ্ঠানের মোট ১৮২টি স্টল অংশ নিয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিদেশে কদর দেশীয় ফার্নিচার
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ