Inqilab Logo

শনিবার ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ২৯ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

নষ্ট হচ্ছে অসংখ্য যানবাহন

সিটি করপোরেশনের জায়গা নেই, প্রয়োজনের তুলনায় সামান্যই ডাম্পিং স্টেশন মামলায় আলামত হিসেবে জব্দ করা যানবাহনের যন্ত্রাংশ রাতের আঁধারে গায়েব হয়ে যায় হ শেষ পর্যন্ত বডি ছাড়া কিছুই থাকে ন

হাসান-উজ-জামান | প্রকাশের সময় : ৫ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রত্যেকটি থানা কম্পাউন্ডে অযত্ন ও অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে হাজার কোটি টাকা মূল্যের যানবাহন। মামলার আলামত হিসেবে জব্দকৃত বিভিন্ন ধরনের যানবাহন কাগজে-কলমে পুলিশের হেফাজতে থাকে। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে, একটা সময় এসে এসব যানবাহন জব্দ করার সময়কার অবস্থায় আর থাকে না। বিশেষ করে রাতের অন্ধকারে যানবাহনের মূল্যবান যন্ত্রাংশ গায়েব হয়ে যায়। রাজধানীর থানা কম্পাউন্ডের বাইরেও জব্দকৃত যানবাহন রাখতে হয় পুলিশকে অনেকটা বাধ্য হয়ে।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এসব যানবাহন অনেকটাই বেওয়ারিশ। শুধু রাজধানীতেই অন্তত ১০ হাজার বিভিন্ন ধরনের যানবাহন রোদ-বৃষ্টিতে নষ্ট হচ্ছে। আবার সংঘবদ্ধ চোর চক্রের পেটে চলে যাচ্ছে এসব যানবাহনের মূল্যবান যন্ত্রাংশ। ঘুরেফিরে সেগুলোর ঠিকানা হয় ধোলাইখালে। থানা কম্পাউন্ডের এসব যানবাহন আর কখনোই সচল হয় না। গংধু ঢাকায় নয়, সারা দেশেই জব্দকৃত যানবাহনের ক্ষেত্রে একই চিত্র।

ঢাকাসহ দেশের জেলা শহরগুলোতে দেখা যায়, জব্দকৃত যানবাহনগুলো বছরের পর বছর ধরে থানার সামনের ব্যস্ত সড়কে ফেলে রাখা হয়। যে কারণে যানজটসহ নানা জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এতে যানবাহনসহ জনসাধারণের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয় জনসাধারণকে। মামলা জটিলতায় এসব যানবাহন সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে মাটিতে মিশে না যাওয়া পর্যন্ত এর সমাধানে অনেক সময় আদালতের নির্দেশ মেলে না।

রাজধানীর হাতিরঝিল থানার ওসি আব্দুর রশিদ বলেন, অন্যান্য থানার চেয়ে হাতিরঝিল থানার পরিস্থিতি আরো নাজুক। থানা কম্পাউন্ডে জায়গা না থাকায় জব্দকৃত কয়েকটি বাস রাখা হয়েছে হাতিরঝিল গোল চত্বরে। মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেলগুলো রাখা হয়েছে ফাঁড়িতে। তিনি বলেন, দুর্ঘটনাকবলিত যানবাহনগুলো কোথায় রাখব। খুবই বিব্রত পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। এক কথায় করুণ অবস্থা। বংশাল থানার সামনের রাস্তাজুড়ে পড়ে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। এতে আদালতপাড়া কিংবা সদরঘাট রুটের পরিবহনগুলোকেও ভোগান্তির শিকার হতে হয়। বনানী থানার সামনে রাস্তাজুড়ে পড়ে আছে জব্দকৃত পরিবহন। ঢাকার আদাবর থানাসহ ডিএমপির অধিকাংশ থানারও একই অবস্থা। শাহবাগ থানার জব্দকৃত যানবাহনগুলোর পরিস্থিতি খুবই খারাপ। বলতে গেলে এক্ষেত্রে সবগুলো থানার এলাকার একই চিত্র।

ঢাকার থানাগুলোর জব্দৃকত মোট যানবাহনের সঠিক সংখ্যা জানা নেই কারো। হিসাব মেলানোর আগে এ সংখ্যা বলা কঠিন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। থানা কম্পাউন্ড ও থানা সংলগ্ন এলাকায় গেলেই দেখা যায়, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, শত শত গাড়ি, মোটরসাইকেল, রিকশাসহ বিভিন্ন রকম যানবাহনের ভাগাড়। প্রতি মাসে যে পরিমাণ গাড়ি জব্দ করা হয়, সে অনুসারে মামলার নিষ্পত্তি হয় না। ফলে যানবাহনের সংখ্যা ক্রমে বাড়তে থাকে।
অতি দামি যানবাহনগুলো পড়ে আছে অযত্ন-অবহেলায়। ডাম্পিং স্টেশন নামে পরিচিত ভাগাড়গুলোতে নেই কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা কিংবা কঠোর নজরদারি। ফলে হরদম গায়েব হচ্ছে এসব যানবাহনের মূল্যবান যন্ত্রাংশ। কিছু অবশিষ্ট থাকলেও রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে এসব গাড়ির যন্ত্রাংশে মর্চে ধরে গেছে। অচলাবস্থায় পড়ে থাকায় অধিকাংশ যানবাহন চলাচল ক্ষমতা হারিয়েছে। আইনি প্রক্রিয়ার ধীরগতির কারণে এসব গাড়ি নিলামে তোলাও সম্ভব হচ্ছে না। এতে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, লাইসেন্সবিহীন, চোরাই, দুর্ঘটনাকবলিত, মাদক বহনকারী, অবৈধ মালপত্রসহ বিভিন্ন কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেসব যানবাহন জব্দ করে, সেগুলো আইনি প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত পুলিশের নির্ধারিত ডাম্পিংয়ে রাখা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মামলা হওয়ার পর আলামত হিসেবে যানবাহন আটকে রাখা হয়। এর মধ্যে কিছু যানবাহন আদালতের নির্দেশে মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপেক্ষা করতে হয় মামলা নিষ্পত্তি পর্যন্ত। আর মামলার দীর্ঘসূত্রতাই আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা। মামলা নিষ্পত্তি হতে অনেক সময় বছরের পর বছর এমনকি এক দশক বা এক যুগও পেরিয়ে যায়। এরপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আদালত। হয় গাড়ি মালিকের কাছে ফিরিয়ে দিতে বলে, না হয় নিলামে বিক্রির আদেশ দেয়। কিন্তু নিলাম প্রক্রিয়া অনেক জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। তা ছাড়া দীর্ঘদিন নিলাম না হওয়ায় এগুলো বিক্রিও করা যায় না।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের ডিসি ফারুক হোসেন গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, ঢাকায় কতগুলো যানবাহন জব্দ আছে তার সঠিক পরিসংখ্যা আমাদের কাছে নেই। তবে সংশ্লিষ্ট থানা ও ইউনিটগুলোতে এর হিসাব রয়েছে। যানবাহনের জন্য থানায় পর্যাপ্ত জায়গা না থানার কারণে সেগুলো বাধ্য হয়ে রাস্তা বা খোলা জায়গায় রাখা হয়। এতে অনেক যানবাহন নষ্ট হচ্ছে এটা সত্য। এসব যাববাহন নিতে মালিকদের পক্ষে আদালতের নির্দেশ থাকতে হবে। তাহলেই যানবাহন প্রকৃত মালিককে ফিরিয়ে দেয়া হয়। মালিকবিহীন যানবাহনগুলো দীর্ঘদিন ধরে এভাবেই পড়ে থাকে। পরে নিলামে তোলা হয়। কিন্তু বিভিন্ন জটিলতায় আদালত সহজে নিলামের আদেশ দেয় না। পুলিশের পক্ষ থেকে এসব যানবাহন নিলামের জন্য সব সময়ই প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকে। তিনি আরো বলেন, রাস্তায় পড়ে থাকা জব্দ গাড়িগুলো নষ্ট হয়। এর যন্ত্রাংশ খোয়াও যায়। আসলে কে পাহারা দেবে বলুন। সিটি কর্পোারেশনের জায়গা নেই। নেই ডাম্পিং স্টেশন। কিন্তু মামলার জন্য পুলিশকে তো আলামত রাখতেই হবে। বিনষ্ট করার কোনো সুযোগ নেই।

এদিকে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়ায় গাড়ির মালিককে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে। আবার দিনের পর দিন থানা ও তার আশপাশে পড়ে থাকা এসব গাড়ি জব্দ করেও রীতিমতো বিপাকে পড়তে হয় পুলিশকেও। ঢাকার আগারগাঁও, মিরপুর ও কাঁচপুরে একটি করে ডাম্পিং স্টেশন থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই সামান্য।

দুর্ঘটনা, চুরি, মাদকসহ বিভিন্ন মামলা-মোকদ্দমায় আটক ভালো ভালো যানবাহনগুলোর স্থান হয় থানার ডাম্পিং এলাকায়। একবার থানায় ঢুকলে সেটি আর সহজে বের হতে পারে না।
আবার দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ি কিংবা ট্রাফিক সংক্রান্ত মামলার গাড়ি মালিকদের অভিযোগ, একটি গাড়ি যদি বছরের পর বছর ফাঁকা জায়গায় পড়ে থাকে তাহলে সেই গাড়ির কিছুই থাকে না, এ জন্য গাড়ির মালিকরা গাড়ি নিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তা ছাড়া ডাম্পিং স্টেশনে গাড়ি আসামাত্র অল্প টাকায় বেহাত হতে থাকে এসব গাড়ির মূল্যবান যন্ত্রাংশ।

ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ট্রাফিক পুলিশের কাজ হলো অবৈধ গাড়ি ধরে ডাম্পিংয়ে রাখা। পরে যেসব যানবাহনের নামে মামলা হয় সেগুলোর মামলা নিষ্পত্তি হলেও আদালতের অনুমতিপত্র পেলে আমরা ওই সব যানবাহন ছেড়ে দেই। তিনি বলেন, অনেক গাড়ির মালিক মামলা নিষ্পত্তি হলেও তাদের যানবাহন নিতে আসে না। অনেক মালিককে পাওয়া যায় না। সে ক্ষেত্রে আমরা ওই সব গাড়ির বিষয়টি আদালতে জানাই। আদালত একটি নিয়মে নিলামের জন্য আদেশ দেন। আদালতের নির্দেশ মোতাবেক আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করি। এরপরও এমন কিছু গাড়ি আছে, যা নিলামে উঠলেও কেউ নিতে চায় না। যে কারণে ওই সব গাড়ি ডাম্পিংয়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, যেসব গাড়ি নিলামে বিক্রি হয় সেগুলোর টাকা সরকারের রাজস্ব খাতে জমা হয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নষ্ট হচ্ছে অসংখ্য যানবাহন
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ