Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দেশকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব সবার

| প্রকাশের সময় : ৮ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ ফারুক খান এমপি : দেশের রপ্তানি আয় বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ লাখ ৭৩ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪২৪ কোটি ১৮ লাখ মার্কিন ডলার। আগের বছরের চেয়ে এ আয় ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ বেশি। অর্থনৈতিক মন্দা এবং চারদিকের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিগত বছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ২১ শতাংশ রপ্তানি আয় বেড়েছে।
রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ অর্থাৎ প্রায় ৮২ শতাংশ এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। গত অর্থবছর শেষে পোশাক খাতে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮০৯ কোটি ৪১ লাখ ডলার। পোশাক খাতের এই আয় ২০১৪-১৫ অর্থবছরের চেয়ে ১০ দশমিক ১৪ শতাংশ এবং সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি অর্থাৎ ২০২১ সালে পোশাক রপ্তানি আয় ৫ হাজার কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়ার যে লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে সে নিরিখে দেশের পোশাক শিল্পকে আরও জোরে এগিয়ে যেতে হবে। এ জন্য প্রতিবছর ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে।
বিদায়ী অর্থবছরের শেষ মাস অর্থাৎ গত জুনে ৩৫৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। ২০১৫ সালের জুনে রপ্তানি আয় হয়েছিল ৩০৬ কোটি ডলার। ২০১৫ সালের জুনের চেয়ে ২০১৬ সালের জুনে রপ্তানি বেড়েছে ১৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ। বিদায়ী অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে ১১৬ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় হয়েছে। এই আয় তার আগের ২০১৪-১৫ অর্থবছরের ১১৩ কোটি ডলারের চেয়ে ২ দশমিক ৬৯ শতাংশ বেশি। পাট ও পাটজাত পণ্যে ৯১ কোটি ৯৫ লাখ ডলারের রপ্তানি আয় হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে কৃষিপণ্য রপ্তানিতে আয় হয়েছে ৫৯ কোটি ৬০ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার। যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তুলনায় এই খাতের রপ্তানি আয় ১ দশমিক ৭১ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া বিদায়ী অর্থবছরে হোম টেক্সটাইল রপ্তানিতে ৭৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার, হিমায়িত মাছে ৫৩ কোটি ৫৮ লাখ ডলার, প্রকৌশল পণ্যে ৫১ কোটি ডলার, ওষুধসহ রাসায়নিক পণ্যে ১২ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় হয়েছে। রপ্তানি খাতে বাংলাদেশের আয় বৃদ্ধি বিশেষত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম আশাজাগানিয়া ঘটনা।
দেশ এগিয়ে চলেছে এমন খবর প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষের কাছে স্বস্তিকর ও আনন্দদায়ক। বাংলাদেশ শুরু থেকেই বিপুল বাণিজ্য ঘাটতির দেশ হিসেবেই পরিচিত ছিল। এক দশক আগেও বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ১২ বিলিয়ন ডলারের নিচে। প্রবৃদ্ধির হার এখন ৪০ শতাংশের ওপর। আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে ক্রমান্বয়ে ভারসাম্য আসছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আমরা শুধু উদ্বৃত্ত নয়, বড় ধরনের উদ্বৃত্ত-বাণিজ্যের দেশে পরিণত হবো। গত অর্থবছরে দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগও বেড়েছে ৪০ শতাংশের মতো। প্রথমবারের মতো দেশে বিদেশি বিনিয়োগ সোয়া দুই বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। বিদেশি বিনিয়োগের প্রথম শর্ত অবকাঠামো খাতেও দেশের অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক। তারই সুফল হচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি। আর বিনিয়োগ যত বাড়বে, রপ্তানির পরিমাণও তত বাড়তে থাকবে।
তৈরি পোশাক খাতই বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য। রানা প্লাজা ধসের পর এই খাতটি বড় ধরনের বিপর্যয় মোকাবেলা করে। যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা বন্ধ হয়ে যায়। ইউরোপেও বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার চলে। তা সত্ত্বেও এই খাতটি দ্রুত এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। গত অর্থবছরেও এ খাত থেকেই এসেছে ২৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি বা ৮২ শতাংশের ওপর। অবশ্য অন্যান্য খাতও দ্রুত এগোচ্ছে। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রপ্তানি আয় বেড়েছে প্রায় সাড়ে আট শতাংশ।
দেশ ও জাতীর উন্নয়নের সার্থে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশ ও সংস্থাসমূহ যাতে এদেশের শিল্প খাতে বিনিয়োগ করে তার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। আর তার জন্য গঠনমূলক ও জনকল্যাণমূলক রাজনীতির করতে হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ অবকাঠামোগত সার্বিক উন্নয়ন সাধন করতে হবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরো উন্নয়ন ঘটাতে হবে, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সমস্যার কার্যকর, বাস্তবসম্মত, দূরদর্শী ও যুগোপযোগী সমাধান করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে তাদেরকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। এ ব্যাপারে সারা বিশ্বে বাংলাদেশ নিযুক্ত কূটনৈতিক মিশন কে কাজ করতে হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে।
বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাস্তবমুখী ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের সাথে সাথে দেশের জিডিপি বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশীয় সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। আর তার জন্য কৃষি ও শিল্প-উভয়ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে এবং সে সাথে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দেশীয় উদ্যোক্তাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য দেশের সকল নাগরিককে দেশীয় পণ্য ক্রয়ে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বাংলার মাটি সোনার চেয়ে খাঁটি, জনগণকে এ মাটির সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে। রপ্তানির বাজার সম্প্রসারণ করতে হবে, রপ্তানিযোগ্য পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে এবং এসব পণ্য রপ্তানির জন্য নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে। রপ্তানির পণ্য তালিকায়ও নতুন নতুন উপযুক্ত পণ্য সংযোজন করতে হবে। কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি, আমদানি হ্রাস এবং রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমেই অর্থনৈতিক স্বর্নিভরতা সম্ভব। আর আমাদের মনে রাখতে হবে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ব্যতীত রাজনৈতিক স্বাধীনতা মূল্যহীন। অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কারণ অর্থনীতিই হচ্ছে আমাদের মূল চালিকাশক্তি।
দেশ গড়ার দায়িত্ব কারো একার নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন দেশের সকল শ্রেণির মানুষ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার জীবনপণ সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল, তেমনি এখন জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বও সবার। আমাদের প্রত্যেককে যার যার অবস্থান থেকে দেশের উন্নয়নের জন্য কিছু না কিছু কাজ করতে হবে। সামগ্রিক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই কেবল একটি দেশের উন্নয়ন সম্ভব।
আমাদেরকে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ থেকে শুরু করে হাজারও পণ্য আমদানি হয়। ভারত ও বাংলাদেশের মাটিতে গুণগত তেমন কোনো পার্থক্য নেই। ভারত তার বিশাল জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটানোর পরে যদি রপ্তানি করতে পারে তবে আমরা উৎপাদন করে অন্তত নিজের চাহিদা কেন পূরণ করতে পারবো না? পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচসহ এই রকম ৫/৭টি পণ্যের দিকে নজর দিলে বছরে বিশাল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচানো সম্ভব।
গুলশানের হলি আর্টিজান রোস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার পরেও আগস্টে ২০ শতাংশ রপ্তানি বৃদ্ধির ঘটনা প্রমাণ করে, দেশে জঙ্গি হামলা রপ্তানিতে কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। রপ্তানি আয় বাড়ায় সরকারেও স্বস্তি এসেছে। কেননা গুলশান হামলার পর রপ্তানি খাতে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া কারো কারো মধ্যে উদ্বেগ ছিল।
লেখক : প্রেসিডিয়াম সদস্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সাবেক মন্ত্রী বাণিজ্য, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দেশের রপ্তানি
আরও পড়ুন