Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

‘বিদেশীদের সাথে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তা’

প্রকাশের সময় : ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হাসান সোহেল : ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের এটিএম জালিয়াতিতে বিদেশীদের সাথে ব্যাংক কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার আশঙ্কা করছে অনুসন্ধান দল। গত শুক্রবার জালিয়াতির পর থেকে তিনটি অনুসন্ধান দল চারটি এটিএম বুথের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে বিদেশীর সাথে একটি বুথে বাংলাদেশীও রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে। একই সঙ্গে সন্দেহ করা হচ্ছে গত ২০১৩ সালের মতো এবারো এই জালিয়াতির ঘটনায় ব্যাংক কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা। এখনো নিশ্চিত করে না বললেও আশঙ্কা করা হচ্ছে এই জালিয়াত চক্রের সঙ্গে ব্যাংক কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুসন্ধান দল গ্রাহকদের এটিএম কার্ডের টাকা আত্মাসাতের ঘটনা এখনো অনুসন্ধান করছে। যদিও বলা হচ্ছে ব্যাংকগুলো ও তার গ্রাহকরা প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়াতেই তার সুযোগ নিচ্ছে জালিয়াত চক্র। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটিএম কার্ড পাঞ্চ করার স্থানে আগেভাগে স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে রাখলে পরে গ্রাহক এটিএমে কার্ড পাঞ্চ করলে এর তথ্য কপি হয়ে যায়। এ ধরনের ডিভাইসের দাম মাত্র ২০০ ডলার। যে ডিভাইস যে কারোর পক্ষেই ক্রয় করা সম্ভব। তাই এটিএম বুথের জালিয়াতি রোধে ব্যাংকগুলোকে আরও সতর্ক হতে হবে।
বিশ্লেষক ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী উভয় পক্ষেরই বক্তব্য ব্যাংকের ভেতরকার লোক না হলে বুথের ভেতরে এই ডিভাইস স্থাপন করা সম্ভব নয়। বাইরের কোনো চোর এতটা অল্প সময়ের মধ্যে ডিভাইস স্থাপন করতে পারবে না। প্রাথমিক তদন্তেও এ ব্যাপারে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে বলেই জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা ইনকিলাবকে বলেন, বিদেশীরা জড়িত ছিল এটা নিশ্চিত। তবে একটি বুথে বাংলাদেশীকেও দেখা গেছে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, অনুসন্ধান দল সন্দেহ করছে ব্যাংক কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয়টিও। সে অনুযায়ী তদন্তও চলছে। তবে ২০১৩ সালে ঘটা এটিএম জালিয়াতির সঙ্গে ব্যাংক কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেন। এদিকে একজন গ্রাহক দৈনিক কত টাকা উত্তোলন করতে পারবে বা একসাথে কত টাকা উত্তোলন করবে, এটা ব্যাংকগুলো নিজেদের মতো ঠিক করে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ভূমিকা রাখে না। একই সঙ্গে কোনো নির্দিষ্ট টাকা উত্তোলন সীমার বিষয়েও কোনো নির্দেশনা দেয়নি। যদিও প্রতিদিন কত টাকা উত্তোলন করা যাবে এবং একবারে কত টাকা উত্তোলন করতে পারবে গ্রাহকরা, সে বিষয়ে শিগগিরই বাংলাদেশ ব্যাংক সিদ্ধান্ত দিতে পারে। তবে মানুষের তাৎক্ষণিক প্রয়োজনের বিষয়টিও বিবেচনায় থাকবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং ব্যবস্থায় গ্রাহকও ক্রমেই প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠেছে। কিন্তু সেই প্রযুক্তির সুবিধা নিয়েই জালিয়াত চক্র গ্রাহকের গচ্ছিত অর্থ চুরি করছে ব্যাংকগুলোর এটিএম বুথ থেকে। এক ব্যাংকের গ্রাহকের অর্থ জালিয়াত চক্র তুলে নিচ্ছে অপর ব্যাংকের বুথ থেকে। এতে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ভয়াবহ সঙ্কট তৈরি হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী এটিএম কার্ডের তথ্য চুরি করে টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। তবে বাংলাদেশের জন্য এই অভিজ্ঞতা অনেকটাই নতুন। এর আগে ২০১৩ সালে এই চক্রকে চিহ্নিত করে জেলহাজতেও পাঠানো হয়। ওই সময়ে জালিয়াত চক্রে একাধিক ব্যাংক কর্মকর্তা জড়িত ছিল বলে গোয়েন্দা সূত্র জানায়। এমনকি একাধিক ব্যাংক কর্মকর্তাকে গ্রেফতারও করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তারা জামিনে বের হয়ে যায়। দীর্ঘদিন চুপ থাকার পর ওই চক্রটিই এই ঘটনা ঘটালো কিনা সে নিয়েও তদন্ত চলছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে কেন ঘটল এমন ঘটনা? আর কি পরিমাণ টাকাই বা তুলে নিয়েছে জালিয়াতি চক্র? এসব বিষয় খতিয়ে দেখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তিনটি তদন্ত দল মাঠে রয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে।
অনুসন্ধান দল সূত্র জানিয়েছে, একটি ভিডিও ফুটেজের সূত্র ধরে কথা উঠেছে বিদেশী চক্রও জড়িত থাকতে পারে এই জালিয়াতিতে। সূত্র জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, জালিয়াতের ঘটনার শিকার তিনটি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও পুলিশ মিলে ওই ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে। গত সপ্তাহে চারটি বুথ থেকে টাকা বের করে নেওয়ার ভিডিও ফুটেজ রয়েছে তাদের হাতে। অন্ততপক্ষে দুই জন বিদেশী ধরা পড়েছে এসব ফুটেজে। ওই বুথগুলো থেকে প্রায় ২৫ লাখ টাকা সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
বনানী ও গুলশানের তিনটি বুথে একজন বিদেশীকে বড় হুডওয়ালা ক্যাপে মুখ ঢেকে ঢুকে ভেতরে দীর্ঘ সময় অবস্থান করতে দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে তখনই কার্ড স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে দেয় ওই বিদেশী। অন্য এক বিদেশী মিরপুরের কালশির অপর একটি ব্যাংকের বুথে ঢুকে পড়ে। ফুটেজ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক অনেকটাই নিশ্চিত যে, ওই দুই বিদেশীই জালিয়াত চক্রের হবে। পুলিশও বিষয়টিতে একই মত পোষণ করছে। তবে কে বা কারা ওই বিদেশী তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সূত্র জানায়, যেসব ব্যাংকের এটিএম মেশিনে অ্যান্টি স্কিমিং ডিভাইস ছিল না সেগুলোকেই টার্গেট করেছিল চক্রটি। এ সময়ে তারা ১৭ ব্যাংকের ২০০ গ্রাহকের কার্ডের তথ্য চুরি করতে সক্ষম হয়। তাই গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংক অ্যান্টি স্কিমিং ডিভাইস বসানো বাধ্যতামূলক করে ব্যাংকগুলোকে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। যদিও ব্যাংক থেকে সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে এটিএম বুথে কার্ড স্কিমিং ও পিন ক্যাপচার ডিভাইস বসিয়ে গ্রাহকের কার্ডের তথ্য ও পিন নম্বর সংগ্রহ করেই জালিয়াত চক্র বুথ থেকে গ্রাহকের টাকা তুলে নিয়েছে।
অবশ্য প্রযুক্তি ব্যবহারে অপেক্ষাকৃত নতুন হলেও বাংলাদেশের গ্রাহকদের আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। প্রযুক্তি ব্যবহারের সাথে সাথে সমস্যাও থাকবে, তারপরও উন্নত প্রযুক্তি সংযোজনের পথেই আছে বাংলাদেশ ব্যাংক বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গ্রাহকদের চুরি যাওয়া ফেরত দেয়ার নির্দেশনা দিলেও অর্থ কীভাবে ফেরত আসবে সে নিয়ে অবশ্য কোনো নির্দেশনা এখনো নেই। আর এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি কোন ব্যাংকের উপর এই কার্ড জালিয়াতির দায় যাবে। আর কারা এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে তাও এখনও খুঁজে বের করা যায়নি।
তদন্তে সহায়তাকারী ইনসাইট বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন মনে করছে, বিদেশীরা এই চক্রের হোতা হতে পারে তবে তাদের সঙ্গেও অবশ্যেই রয়েছে ব্যাংকের ভিতরকার কারো সম্পৃক্ততা। ব্যাংকের কারো যোগসাজশ ছাড়া এই ডিভাইস স্থাপন সম্ভব নয় বলেই মত সংস্থাটির।
এদিকে সতর্কতা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পুরোনো সার্কুলার নতুন করে জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে প্রয়াজনীয় সতর্কতা ব্যবস্থাগুলো না নেওয়ার কারণেই এমনটা ঘটেছে। ২০১৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর একই ধরনের একটি সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সার্কুলারটি নতুন করে জারি করে ব্যাংকগুলোকে ৬টি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এর অন্যতম হচ্ছেÑ নতুনভাবে স্থাপিত এটিএম বুথসমূহে বাধ্যতামূলকভাবে অ্যান্টি স্কিমিং ও পিন শিল্ড ডিভাইস থাকতে হবে। আর এরই মধ্যে স্থাপিত বুথে একমাসের মধ্যে এন্টি স্কিমিং ও পিন শিল্ড ডিভাইস বসাতে হবে। এছাড়াও প্রতিদিন এটিএম বুথে সংগঠিত লেনদেনসমূহের ভিডিও ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং তাতে কোনো সন্দেহজনক বিষয় মনে হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
তবে গ্রাহককেও কিছুটা সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এটিএম বুথে টাকা তোলার সময় পিন কোড বসাতে গিয়ে এক হাত দিয়ে ঢেকে রাখতে পারেন। গোপন ক্যামেরায় যাতে তা না দেখা যায়। পরিচিত এটিএম বুথগুলোতেই বেশি যাওয়া, যেসব বুথ ভিডিও ক্যামেরা বসিয়ে পর্যবেক্ষণে রাখা সেগুলোই ব্যবহার করা, বুথের ভেতরে ঢুকে নিজেও একটি সতর্ক ভাবে পর্যবেক্ষণ করা আর নিয়মিত নিজের ব্যাংক ব্যালেন্স চেক করা।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার ইস্টার্ন, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ও দ্য সিটি ব্যাংকে কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে ২১ জন গ্রাহকের টাকা উত্তোলনের ঘটনা ঘটেছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক সতর্কতা জারি করে এ ব্যাপারে তার উদ্বেগ জানিয়েছে। আন্তঃব্যাংক এটিএম লেনদেনও অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ‘বিদেশীদের সাথে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তা’
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ