পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
একই সৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত উপভোগের একমাত্র সুযোগ রয়েছে পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটায়। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর ছুটির দিন ছাড়াও বর্তমানে প্রতিদিনই দেশ-বিদেশের পর্যটকরা ভিড় করেন সাগর কন্যা কুয়াকাটার অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করতে।
পদ্মা সেতুর জন্য সরাসরি সড়ক যোগাযোগ চালু হওয়ায় ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের সংখ্যা কয়েকগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। কুয়াকাটা সাগর সৈকতে পর্যটকদের আকর্ষণ করতে ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে আর্ন্তজাতিক মানের কয়েকটি হোটেল মোটেল রিসোর্টসহ দেড় শতাধিক হোটেল মোটেল কটেজ।
এদিকে পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার মূল আকর্ষণ সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের বিরল দৃশ্য উপভোগের সুযোগ। আর এমন সুযোগ দেশের অন্য কোন পর্যটন কেন্দ্র নেই। কিন্তু পর্যটকদের এমন মূল আকর্ষণকে ধরে রাখার পথে বড় বাধা গত কয়েকবছর ধরে অব্যাহত সৈকতের ভাঙন।
কুয়াকাটা সাগর সৈকত ছিল সাজানো গোছোনো। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সাগরের বড় বড় ঢেউয়ের আঘাতে ভাঙন সৈকত ছাড়িয়ে বর্তমানে সাগর পাড়ের স্থাপনাগুলোর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সাগরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সৈকতের জিরো পযেন্টের বেড়ি বাঁধের সীমানা। ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে এলজিইডির একটি ডাকবাংলো, সাগর সৈকত সংলগ্ন কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যানের অধিকাংশ এলাকাসহ নারকেল বাগান। হুমকির মুখে রয়েছে সাগর পাড়ের নিকটবর্তী মসজিদ, মন্দিরসহ ছোটবড় মার্কেটগুলো।
কুয়াকাটা সৈকতে আব্যাহত ভাঙন রোধসহ পর্যটকদের ভ্রমণ স্বাচ্ছন্দ করতে জিরো পয়েন্টকে ধরে সাগরের ভেতরের দিকে ইতোমধ্যে পূর্ব-পশ্চিমে জিওটিউব দিয়ে ২ কিলোমিটার এলাকায় কাজ করা হয়েছে। ২০১৯ সালে ১ কিলোমিটার এলাকায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা ব্যায়ে প্রথম জিওটিউব দিয়ে পর্যবেক্ষণমূলক হিসেবে কাজ করা হয়। পরবর্তী বছরে কাজ করা হয় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকার। সর্বশেষ সৈকত পাড়ের স্থাপনাগুলো রক্ষায় চলতি বছরে আড়াই কোটি টাকা ব্যয় ২ কিলোমিটার এলাকায় সাগরের ভেতরের এলাকা এবং সাগর পাড়ের ভাঙন রোধকল্পে ৩০০ মিটার এলাকায় জরুরি ভিত্তিতে কাজ করা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড পটুয়াখালীর সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের সময় বিপদসীমার ৭৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। এতে করে স্মরণকালের ৭ থেকে ৮ মিটার উচ্চতার ঢেউয়ের আঘাতে কুয়াকাটা বীচ সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়। প্রাথমিক ভাবে ২০১৯ সালে যখন ভাঙন রোধকল্পে জিওটিউব ও জিও ব্যাগ দিয়ে পর্যবেক্ষণমূলক ভাবে কাজ শুরু করা হয়। তার সুফলও পাওয়া যায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের আঘাতের আগে। কিন্তু ইয়াসের প্রভাবে ঢেউয়ের আঘাতে পানি আসা যাওয়ায় বীচের বালি সরে যাওয়ায় স্থাপিত জিওটিউবগুলো বসে যাওয়ার বড় ধরনের ক্ষতি হয়।
শুরুতে কুয়াকাটা বীচ রক্ষার জন্য স্থায়ী কার্যক্রমের জন্য ৫০০ কোটি টাকার একটি ডিপিপি সাবমিট করা ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে স্থানীয় দাবির প্রেক্ষিতে টেকসই কার্যক্রমের জন্য পুনরায় সমীক্ষার দাবি করা হয়। এ জন্য ইনস্টিটিউট অফ ওয়াটার মডেলিংকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে পূর্ণগঠিত ডিপিপি সাবমিট করা হয়। এতে সম্ভাব্য ব্যায় ধরা হয়েছিল ৭৫০ কোটি টাকা।
এদিকে ইয়াস ঘূর্ণিঝড় পরবর্তীতে মে মাসের শেষে কুয়াকাটা সৈকতের বিধ্বস্থ অবস্থা পরিদর্শন করেন পানিসম্পদ মন্ত্রনালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার। পরিদর্শন শেষে তিনি স্থানীয় সংবাদিকদের বলেছিলেন, ইয়াসের প্রভাবে যে সবজায়গা খুব খারাপ ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তার মধ্যে কুয়াকাটা একটি। কুয়াকাটার জন্য বিশেষ প্রকল্প তৈরী হয়েছে। প্রকল্প (২০২১ সাল) দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে অনুমোদন এবং ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শুরু করা যাবে।
এদিকে যত দেরি হচ্ছে কুয়াকাটার ভাঙন রোধকল্পের কাজ ততই হুমকির মুখে পড়ছে। প্রায় ১৮ কিলোমটিার দৈর্ঘ্যরে সৈকত। জিরো পয়েন্ট থেকে পূর্বদিকে ট্যুরিজম পার্ক পর্যন্ত মাত্র ৩০০ মিটার এলাকায় জিওটিউব ও জিও ব্যাগ দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড জরুরি প্রটেকশন দেয়ায় সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের আঘাত থেকে রক্ষা পেয়েছে বালিয়াড়ি। স্থায়ী কোন উদ্যোগ না নেয়ায় দীর্ঘ সৈকতের জাতীয় উদ্যানসহ ঝাউবাগান দুই তৃতীয়াংশ বিলীন হয়ে গেছে। কড়ই, নারিকেল, তাল ও সেগুন বাগান সাগর গিলেছে। জেলে পল্লীর দুই তৃতীয়াংশ স্থাপনা সাগরে ভেসে গেছে। এখন নিয়মিত উত্তাল ঢেউ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধের বুকে ঝাপটা দেয়।
বর্তমানে কুয়াকাটায় সাগরের ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে বেড়িবাঁধের বাইরের ছোট-বড় তিন শতাধিক স্থাপনা। ছোট ছোট শতাধিক দোকানপাট। হাজারো মানুষের জীবন-জীবিকার অবলম্বন এই বেড়িবাঁধের বাইরে সৈকতের বালিয়াড়িতে দোকানগুলোতে চলে বেচাকেনা। খুটা জেলেদের সংগঠন আশার আলো মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি নিজাম শেখ জানান, বেড়িবাঁধের বাইরে বসবাস করছে শত শত খুটা জেলেরা। সৈকত রক্ষায় স্থায়ী পদক্ষেপ নেওয়া না হলে এসব জেলেরা হারাবে আবাসস্থল। জিরো পয়েন্ট থেকে পর্যটকরা গঙ্গামতি লেক এবং খাজুরা লেম্বুরচর পর্যন্ত ঘুরতে গিয়ে সৈকতের ভাঙনের তান্ডব দেখে হতাশা ব্যক্ত করেন। সৈকত রক্ষায় স্থায়ী পদক্ষেপের অভাবে শত শত বিনিয়োগকারী জায়গা কিনে কোন কিছুই করেননি।
কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এম এ মোতালেব শরীফ বলেন, অব্যাহত ভাঙনে সৈকতের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে গেছে। দ্রুত সমাধান করা না হলে পর্যটকরা এখানে আসতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর সাধারণ সম্পাদক মেজবাহ উদ্দিন মান্নু বলেন, আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাবে স্বাভাবিক জোয়ারেই পানির উচ্চতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আর প্রতি মাসে অমবস্যা ও পূর্ণিমায় স্বাভাবিক জোয়ার জলোচ্ছাসের আকার নেয়। অতি উচ্চতার ঢেউয়ের তোড়ে সাগরের বালিয়াড়ি প্রতিনিয়ত ক্ষয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থা জিওটিউব বা জিওব্যাগ দিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। কুয়াকাটা সৈকতের অব্যাহত ভাঙন রোধকল্পে বিজ্ঞানভিত্তিক সমীক্ষা চালিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
কুয়াকাটা পৌর মেয়র আনোয়ার হাওলাদার বলেন, জিওটিউব সাগরের ভেতরের দিকে দেওয়া হয়েছে। স্বাভাবিক জোয়ারে তা অতিক্রম করে প্রবল ঢেউ তীরে আঘাত করছে। এর ফলে সাগর পাড়ের ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। ভাঙন রোধকল্পে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার দীর্ঘসূত্রিতা পর্যটকদের এখানে আসার ক্ষেত্রে বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কুয়াকাটাকে ঘিরে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হচ্ছে সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানায়। গত কয়েক বছর ধরে যে ভাবে সৈকতে ভাঙন হচ্ছে তা দ্রুততার সাথে স্থায়ী প্রতিরোধের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে সকল বিনিয়োগ ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্রকে ঘিরে এই অঞ্চলে গড়ে উঠেছে পায়রাবন্দর, পায়রা তাপবিদুৎ কেন্দ্রসহ একাধিক মেগা প্রকল্প। রেললাইন নির্মাণের কাজও এগিয়ে চলছে। যত দ্রুত কুয়াকাটাকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষার স্থায়ী প্রকল্পের কাজ শুরু করা যাবে ততই রাজস্বের পরিমাণ বাড়বে।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আসাদুল হক বলেন, পৃথিবীতে অতি মাত্রায় কার্বন ডাইঅক্স্রাইড ছড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে বৈশি^ক উষ্ণনায়ন অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। উত্তর-দক্ষিণ মেরুসহ হিমালয়ে জমে থাকা বরফের স্তরগুলো ক্রমশ: গলে ছড়িয়ে পড়ছে মহাসাগর, সাগর ও নদীর মাধ্যমে। সাগরের পানির উচ্চতা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ক্রমাগত আঘাত হানছে সাগরের পাড়গুলোতে। এর প্রভাব পড়ছে দেশের বড় দুটি পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা ও কক্সবাজারে।
সাগরের ঢেউয়ের অব্যাহত আঘাতে কুয়াকাটা সৈকত সৌন্দর্য্য হারাচ্ছে। এমন অবস্থায় উৎসাহ হারাচ্ছেন পর্যটকরা। পর্যটকরা বিমুখ হবেন একটা পর্যায়ে এখানে আসতে। ঠিক তেমনি কক্সবাজারসহ কুয়াকাটা সাগর সৈকতের সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে উন্নত বিশে^র আদলে সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। তাছাড়া বিদেশের পর্যটকরা নিরুৎসাহিত হবেন আমাদের দেশে আসতে। যা দেশের অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
পটুয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেন জানান, ‘কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত রক্ষা ও উন্নয়ন’ নামে ১ হাজার ২১১ কোটি ৩৩ লাখ টাকার একটি প্রকল্প গত ফেব্রুয়ারিতে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে গত ২২ মার্চ পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য শরীফা খান, সচিব ও জয়েন্ট চিফ পরিকল্পনা কমিশন গত ১ জুলাই প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন।
প্রাথমিকভাবে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদের মধ্যে রয়েছে সমুদ্রতীরবর্তী তীর রক্ষার কাজ, বাধ নির্মাণ, বাধের ঢালের প্রতিরক্ষা কাজ, ডিসিপার্ক, মসজিদ ও মন্দির এলাকায় প্রতিরক্ষা কাজ। এছাড়াও ওয়াকিং বে, বসার স্থান ও পার্কিং এলাকার প্রতিরক্ষা কাজ, রাস্তা পাকা করা, বিনোদন পার্ক, রেস্তোরাঁসহ আরও অনেক কাজ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।