Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভুমধ্যসাগরে অবৈধ যাত্রা থামছে না

ইতালির শেলটার হোমে ১২ হাজার বাংলাদেশি

শামসুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০৩ এএম

দালাল চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে প্রচুর অর্থ
ভ‚মধ্যসাগরে বাংলাদেশিদের অবৈধ যাত্রা থামছে না। স্বপ্নের দেশ ইউরোপে ঢুকার আশায় দালালদের শরণাপন্ন হচ্ছে নিরীহ যুবকরা। চড়া সুদে ঋণ এবং ভিটেমাটি ও গবাদিপশু বিক্রি করে ১০/১১ লাখ টাকার বিনিময়ে দালালদের মাধ্যমে প্রথমে লিবিয়ায় গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। লিবিয়ার বিভিন্ন এলাকায় দালালচক্র এসব বাংলাদেশিদের জিম্মি করে রাখে। নৌকা যোগে ইতালি পাঠানোর নাম করে দফায় দফায় অভিবাসী প্রত্যাশিদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আদায় করা হয়। মানবপাচারের শিকার এসব বাংলাদেশিদের পরিবার পরিজনরা চরম উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন।
এদিকে, ইতালির প্রায় ৫০টি শেলটার হোমে প্রায় ১২ হাজার অবৈধ বাংলাদেশি কর্মী অবস্থান করছে। একাধিক ভুক্তভোগী এসব তথ্য জানিয়েছে। আগামী ১২ সেপ্টেম্বর বয়স কমিয়ে নতুন পাসপোর্টের দাবিতে রোমস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে প্রবাসী বাংলাদেশিরা।

দেশীয় দালাল ও আন্তর্জাতিক দালালচক্রের ফাঁদে পড়ে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গ্রামাঞ্চলের নিরীহ যুবকরা ভ‚মধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের ইতালিসহ অন্যান্য দেশে ঢুকার চেষ্টা চালাচ্ছে। ইতিপূর্বে ভ‚মধ্যসাগরে নৌকা ঢুবে অনেক অভিবাসী অকালে প্রাণ হারিয়েছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসী সাহায্য সংস্থা আইওএম এর সার্বিক সহায়তায় বিভিন্ন সময়ে লিবিয়া থেকে শত শত বাংলাদেশি শরণার্থী দেশে ফিরেছে।

লিবিয়া উপক‚ল থেকে যাত্রা করা একটি নৌকা ৩৮ জন বাংলাদেশি অভিবাসী নিয়ে ইতালির সিসিলিতে পৌঁছেছে। ইতালি থেকে বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্র এতথ্য জানিয়েছে। নৌকায় আসা দুই অভিবাসী জানিয়েছেন, ইতালি উপক‚লে পৌঁছানোর আগে অভিবাসীরা টানা দুই দিন সমুদ্রে ভেসেছিলেন। লিবিয়ার বেনগাজি উপক‚ল থেকে যাত্রা করা একটি অভিবাসী নৌকা ৩৮ অভিবাসী নিয়ে গত মঙ্গলবার ইতালির সিসিলি উপক‚লে পৌঁছেছে। নৌকাটিতে আসা দুই অভিবাসী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইনফোমাইগ্রেন্টসকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

তারা জানান, অস্থায়ী নৌকায় আসা এই অভিবাসী দলের সবাই বাংলাদেশি নাগরিক। যাদের মধ্যে অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ হয়ে লিবিয়ায় এসেছিলেন। আবার অনেকেই পূর্ব থেকে লিবিয়ায় অভিবাসী হিসেবে অবস্থান করছিলেন। অভিবাসীরা জানিয়েছে, মূলত তিন দিন আগে নৌকাটি লিবিয়া উপক‚ল থেকে যাত্রা করলেও যাত্রার একদিন পরেই খাবার ও জ্বালানি তেল শেষ হয়ে যায়। ফলে তাদের ইতালি উপক‚লে আসতে অনেক দেরি হয়ে যায়। সাগরের একটি অংশে একটি মাছ ধরার নৌকার কাছে সাহায্য চাইলে তাদের পানি ও খাবার দেয়া হয়। মধ্য ভ‚মধ্যসাগরের বেশ কিছু অংশে সাগর উত্তাল থাকায় নৌকাটি বারবার ঝুঁকিতে পড়ে যাওয়ায় যাত্রার একপর্যায়ে অভিবাসীদের অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত বড় কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই সবাই ইতালি উপক‚লে আসতে সক্ষম হয় বলে জানায় ইনফোমাইগ্রেন্টসকে সাক্ষাৎকার দেয়া দুই অভিবাসী।

ইতালি উপক‚ল আসার পর দেশটির কোস্টগার্ডের সদস্যরা নৌকায় থাকা সব অভিবাসীদের সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে উপক‚লে নিয়ে আসেন। আশ্রয় আবেদনের প্রাথমিক কাজ শেষ হলে তাদের সবাইকে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়ার কথা রয়েছে।
উল্লেখ্য, আফ্রিকা, এশিয়া থেকে ভ‚মধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বড় একটি অংশ প্রতি বছর পৌঁছায় ইতালিতে। এই তালিকায় বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের মধ্যে বরাবরই উপরের দিকে থাকছেন বাংলাদেশিরা। ২০২২ সালের প্রথম আট মাসেই তাদের সংখ্যা ২০২১ সালে ১২ মাসে আগতদের কাছাকাছি পৌঁছেছে। গত ১৮ আগস্ট প্রকাশিত ইতালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

২০২১ সালের জুলাই মাসের শেষের দিকে ভ‚মধ্যসাগরে কাঠের নৌকায় বিপজ্জনকভাবে ভাসমান থাকা বেশকিছু বাংলাদেশিসহ ৩৯৪ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীকে উদ্ধার করা হয়েছে। বাংলাদেশি ছাড়া উদ্ধারকৃত বাকিরা মরক্কো, মিসর এবং সিরিয়ার নাগরিক বলে রয়টার্স জানিয়েছে। এক প্রতিবেদনে বার্তা সংস্থাটি বলেছে, স্থানীয় সময় রাতে ছয় ঘণ্টার অভিযানে ভূমধ্যসাগর থেকে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বহনকারী কাঠের নৌকা থেকে তাদের উদ্ধার করা হয়। সি ওয়াচ-থ্রি ও ওশান ভাইকিং নামে জার্মান এবং ফরাসি দুটি এনজিও ভূমধ্যসাগরের উত্তর আফ্রিকা উপক‚লের তিউনিসিয়ার পানিসীমা থেকে তাদের উদ্ধার করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে রয়টার্স জানিয়েছে, গভীর সমুদ্রে যাত্রীদের ভারে কাঠের নৌকাটি ভেঙে পড়ে। সেটির ইঞ্জিনও নষ্ট হয়ে পড়ে। উদ্ধারকারী জাহাজ দেখে নৌকার আরোহীরা লাফিয়ে সাগরে পড়েছিল। ভূমধ্যসাগরের বিভিন্ন উপক‚ল বিপজ্জনকভাবে পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টাকালে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের উদ্ধারের খবর প্রায় আসে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আবহাওয়া পরিস্থিতি শান্ত থাকার কারণে এ প্রবণতা বেড়েছে। এভাবে সমুদ্রপাড়ি দিতে গিয়ে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। গত বছরে অন্তত ১ হাজার ১০০ জন প্রাণ হারিয়েছেন বলে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) জানিয়েছে।

চলতি বছর সবচেয়ে বেশি অভিবাসীর আগমন ঘটেছে জুলাই মাসে। তখন ১৩ হাজার ৮০১ জন পৌঁছায় দক্ষিণ ইউরোপের দেশটিতে। আর চলতি মাসের ১৮ দিনে এসেছেন আট হাজার ৩০৬ জন। অপেক্ষাকৃত অনুক‚ল আবহাওয়ার কারণে গ্রীষ্মে বরাবরই সমুদ্রপথে আসা আশ্রয়প্রার্থীদের সংখ্যা বাড়ে যায়। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টাকালে গত এপ্রিল মাসে পাঁচশ’র মতো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে লিবিয়ার পুলিশ। তাদের মধ্যে ২৪১ জন বাংলাদেশি বলে নিশ্চিত করেছে ত্রিপলীস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃপক্ষ। আটককৃত এসব বাংলাদেশিকে ত্রিপোলির সেফ হোমে রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থাসহ (আইওএম) সংশ্লিষ্টদের সহায়তায় তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন তার দফতরে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছিলেন।

ঢাকায় পাঠানো এক বার্তায় ত্রিপোলীস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস জানিয়েছিল লিবিয়ার উপকূলে একটি নৌযান থেকে ৫০০ বাংলাদেশিসহ ৬০০ ব্যক্তিকে দেশটির কোস্টগার্ড আটক করে। পরে তাঁদের লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলির একটি বন্দিশিবিরে নেয়া হয়। কিন্তু সেখানে আটক ব্যক্তিদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তাঁদের একটি বড় অংশকে ত্রিপোলির বিমানবন্দর সড়কের একটি সেফ হোমে সরিয়ে নেয়া হয়। আটক বাংলাদেশিদের সেখানে রাখা হয়েছে। উদ্ধারকৃত ব্যক্তিদের আইনি সহায়তা দেয়ার পাশাপাশি আগ্রহী লোকজনকে দেশে ফেরত আনার জন্য আইওএমের সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ দূতাবাস।

পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন ওই সময়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ভূমধ্যসাগরের উপক‚ল হয়ে বাংলাদেশিদের ইউরোপযাত্রার সংখ্যাটা ঢাকার জন্য উদ্বেগের। লিবিয়ায় আটক পাঁচ শতাধিক বাংলাদেশিকে লিবিয়ার সেফ হোমে রাখা হয়েছে। তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত তাঁদের ফিরিয়ে আনার জন্য আইওএমসহ সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা নেবেন। এক বছরের মধ্যে লিবিয়া থেকে এক হাজারের বেশি বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

পররাষ্ট্রসচিব আরও বলেন, ‘ভূমধ্যসাগর উপকূল হয়ে ইউরোপযাত্রার সংখ্যাটা কমছে না। আমরা এটা নিয়ে কঠোর অবস্থানে যাব। যেসব জেলার লোকজন বেশি যাচ্ছেন, বিশেষ করে ফরিদপুর, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর অঞ্চলের লোকদের বোঝানোর জন্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম নেয়া হবে। এখানে মানব পাচারের বিষয়টাতে আমরা গুরুত্ব দিতে চাই। লিবিয়াতে আমাদের শ্রমবাজার অল্প অল্প করে খুলছে। তাই বাংলাদেশ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। সরকারী উদ্যোগে মানবপাচার রোধে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ক’মাস আগে পদ্মার ওপারে গুরুত্বপূর্ণ সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল।

ইতালি থেকে প্রবাসী সাংবাদিক হাসান মাহমুদ গতকাল বৃহস্পতিবার ইনকিলাবকে জানান, ইতালিতে ৫০ টিরও বেশি হোম শেলটার অথবা আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। এসব আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে বসবাসকারি অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার বলে দাবি করেছেন ভুক্তভোগীরা। তবে রোমস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস বলছে, এই সংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি নয়। দালালদের মাধ্যমে বাংলাদেশি অভিবাসীরা তাদের নাম, ঠিকানা, জন্মতারিখ এমনকি ধর্মও পরিবর্তন করে থাকে। এসব অবৈধ অভিবাসী পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর নিজেদের অপ্রাপ্তবয়স্ক বলে দাবি করে এবং ভিন্ন নাম ও জন্মতারিখ দিয়ে থাকে। ফলে এরা বিপাকে পড়ছে।

পাসপোর্ট বয়স কমানোর দাবিতে রোম দূতাবাসের এরা বেশ কয়েকবার বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছে এবং সর্বশেষ বিক্ষোভ চলাকালে দূতাবাসের বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর করেছে। তিনি বলেন, এ ঘটনার পর স্থানীয় প্রশাসন কঠোর অবস্থানে গিয়েছে। ভুক্তভোগীরা আগামী ১২ সেপ্টেম্বর আবারো রোমস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে সামনে মানববন্ধনের কর্মসূচি দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করলে এ সকল ভুক্তভোগী বাংলাদেশিরা বয়স কমিয়ে পাসপোর্ট পাবে বলে মনে করেন না ওই প্রবাসী সাংবাদিক।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভুমধ্যসাগর
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ