পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টালিন সরকার : ‘শিল্পে বাঁচি শিল্প বাঁচাও’-স্লোগান নিয়ে জাতীয় শহীদ মিনারে ৫ দফা দাবিতে বুধবার সমাবেশ করেছে দেশের নাট্টাঙ্গনের হাজারো শিল্পী-কলাকুশলী। টিভি নাটক-সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকা, শিল্পী কলাকুশলীদের দাবিগুলো যৌক্তিক। রুটি-রুজির প্রয়োজনে দেরিতে হলেও তারা বিদেশি অপসংস্কৃতির প্রতিহত করে দেশজ শিল্প-সাহিত্য-কৃষ্টি-কালচার চর্চার দাবি তুলছেন। ৩০ বছর ধরে ইনকিলাব যে লড়াই করে আসছে টিভির শিল্পী-কলাকুশলীদের সে আন্দোলনে এখন রাস্তায়। এ আন্দোলনের প্রতি দেশ-দরদী সবার সমর্থন জানানো উচিত। নাট্য নির্মাতা-শিল্পীদের কেউ কেউ অন্তর থেকেই চাচ্ছেন অপসংস্কৃতি রুখে দিয়ে দেশজ সংস্কৃতি চর্চায় ব্রতী হতে। তবে কিছু নাট্য-ব্যক্তিত্বের কথাবার্তায় বোঝা গেল ‘শিল্পে বাঁচি শিল্প বাঁচাও’ স্লোগানকে তারা কার্যত ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন। ডাবিং করে দেশের চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত ইসলামের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং মুসলিম শাসকদের নিয়ে নির্মিত বিদেশি সিরিয়ালগুলো বন্ধই তাদের মূল উদ্দেশ্য। ভারতের হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি, উলুধ্বনি, ভাইফোঁটা, রাখিবন্ধন, হোলিখেলা, ভ্যালেন টাইন ডে, ঢোল-ডম্পের সংস্কৃতি চর্চায় তাদের আপত্তি নেই। ভারতীয় চ্যানেলে ওইসব অপসংস্কৃতি দেশের দর্শক দেখুক কিন্তু বাংলাদেশী কোম্পানিগুলো বিজ্ঞাপন দিতে পারবে না এই হলো তাদের প্রত্যাশা। কিন্তু তারা একাট্টা দেশের চ্যানেলগুলোর ইসলামী ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে নির্মিত সিরিয়ালগুলো বন্ধ করতে হবে। ঢাকার টিভিগুলোতে প্রচারিত ইসলামের ইতিহাস নিয়ে নির্মিত সিরিয়ালগুলো যে বার্তা দিচ্ছে সেদিকে তাদের ভ্রƒক্ষেপ নেই।
বিবিসির এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সুলতান সুলেমানের ধাক্কায় বিপন্ন টিভি নাটক’। বাংলাদেশের টিভি দর্শকরা কি বার্তা দিচ্ছেন? বার্তা হলো তারা ভারতীয় চ্যানেলে প্রচারিত হিন্দুয়ানি সিরিয়াল দেখতে অভ্যস্ত হলেও দেশি চ্যানেলগুলোতে তারা মুসলিম কালচার, ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্প-সংস্কৃতি দেখতে চায়। মূলত দীপ্ত টিভিতে প্রচারিত অটোমান সা¤্রাজ্য নিয়ে নির্মিত ‘সুলতান সুলেমান’ সিরিয়াল ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর অন্য বেসরকারি চ্যানেলগুলোর চোখ কপালে উঠে যায়। দেশি নাটক-সিরিয়ালের পাশাপাশি ব্যবসায়িক সাফল্যের আশায় তারাও বিদেশি সিরিয়াল প্রচারের সিদ্ধান্ত নেয়। মাছরাঙা টিভি ‘দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান’ জিটিভি ‘আলিফ লায়লা’ আরটিভিও ‘সিনড্রেলার বোন’ নতুন করে প্রচারের বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়াও এসএ টিভি ও চ্যানেল টুয়োন্টিফোর ‘ইউসূফ জুলেখা’, ‘অ্যারাবিয়ান নাইটস’ দেখানোর লক্ষ্যে বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। মুসলিম ইতিহাস, মুসলিম শাসকদের কর্মকা-, ক্ষমতা দখল, দেশ-শাসন, ইসলামী ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে নির্মিত এসব বিদেশি সিরিয়াল বাংলায় ডাবিং করে প্রচার হচ্ছে। ঢাকার চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত এসব সিরিয়াল শিল্পী-কলাকুশলীদের ভাষায় দর্শকরা শুধু ‘খাচ্ছেই’ না ‘গিলছে গো-গ্রাসে’। যে দর্শক কলকাতার চ্যানেলের হিন্দুয়ানি কালচারে নির্মিত সিরিয়াল দেখছেন সেই দর্শক দেশীয় চ্যানেলে প্রচারিত বাংলায় ডাবিং করা বিদেশে নির্মিত ইসলামী ধারার সিরিয়ালগুলো দেখছেন। শুধু তাই নয়, দেশের চ্যানেলগুলোতে মধ্যপ্রাচ্য তথা ইসলামের ইতিহাস ঐতিহ্য, মুসলিম শাসকদের যাপিত জীবন নিয়ে নির্মিত সিরিয়ালগুলো প্রচার হওয়ায় কলকাতার সিরিয়ালগুলোর দর্শক কিছুটা হলেও কমতে শুরু করেছে। প্রশ্ন হলো দর্শকদের জন্য দেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচারের লক্ষ্যে আমাদের নাটক-সিনেমার ব্যক্তিত্বরা কেন ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে নাটক-সিনেমা-প্রামাণ্য চিত্র বানাতে আগ্রহী হচ্ছেন না? নাকি আমাদের টিভির নাটক অনুষ্ঠানের অংশিজনদের মগজ ধোলাই হয়ে গেছে ইসলাম-বিদ্বেষী চিন্তা-চেতনায়?
দেশের টেলিভিশন মিডিয়ার ১৩টি সংগঠনের সম্মিলিত প্লাটফর্ম ফেডারেশন অব টেলিভিশন প্রফেশনাল অর্গানাইজেশন (এফটিপিও)। সংগঠনের আহ্বায়ক মামুনুর রশীদ ঘোষণা দিয়েছেন ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বিদেশি ডাবিং সিরিয়াল (মূলত ইসলামী ইতিসাহ-ঐতিহ্য নিয়ে নির্মিত) প্রচার বন্ধ করতে হবে। ১৬ ডিসেম্বর থেকে আর বিদেশি ডাবিং করা সিরিয়াল দেখানো যাবে না। যেসব চ্যানেলে বিদেশি সিরিয়াল প্রচার হবে সেই চ্যানেল ঘেড়াও করবে শিল্পী-কলাকুশলীরা।
শিল্পী-কলাকুশলীদের ৫ দফা দাবির মধ্যে রয়েছেÑ টিভি চ্যানেলে বাংলায় ডাবিং বিদেশি সিরিয়াল/অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ, অনুষ্ঠান নির্মাণ ক্রয় ও প্রচারে ক্লায়েন্ট/এজেন্সির হস্তক্ষেপ বন্ধ, সর্বক্ষেত্রে এ.আই.টির ন্যূনতম ও যৌক্তিক হার পুনঃনির্ধারণ, বিদেশি শিল্পী-কলাকুশলীদের কাজ করা বন্ধ এবং ডাউনলিংক চ্যানেলের মাধ্যমে বিদেশি চ্যানেলে দেশীয় বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ করতে হবে। এ দাবিগুলোতে বোঝা যায়, মূল টার্গেট ইসলামী ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে নির্মিত ডাবিংকৃত সিরিয়ালগুলোর প্রচার বন্ধ করার প্রতি শিল্প-কলাকুশলীদের একটা অংশ বেশি আগ্রহী। বিজ্ঞাপনের বিষয়টি এসেছে ৫ নম্বর দাবিতে। ভারতীয় চ্যানেলের অপসংস্কৃতি বন্ধ ইত্যাদি বিষয়ে শিল্পীদের তেমন আগ্রহ নেই। যদিও গাজী রাকায়েত, আফজাল শরীফ, ড. ইনামূল হক, ডলি জহুর, আজিজুল হাকিম, তৌকীর আহমেদ, বিপাশা হায়াৎ, আবুল হায়াৎ, শহীদুজ্জামান সেলিমের মতো শিল্পীরা বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন বন্ধ করে দেশী সংস্কৃতির চর্চার প্রতি জোর দিয়েছেন। তারা মূলত কোলকাতার সিরিয়ালের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। কিন্তু এটিএম শামসুজ্জামান, রামেন্দু মজুমদার, রোকেয়া প্রাচী, হাসান ইমাম, মামুনুর রাশিদরা মুসলিম ঐতিহ্য, ইসলামের ইতিহাস নিয়ে নির্মিত বাংলায় ডাবিং করা সিরিয়ালগুলো বন্ধের প্রতি জোর দিচ্ছেন বেশি। বেসরকারি টিভি মালিক ও শিল্পীদের মধ্যকার চলমান এই আন্দোলনে ‘দাবি-দাওয়া’ সংক্রান্ত মতবিরোধে ইতোমধ্যেই চ্যানেল আইয়ের মালিক ফরিদুর রেজা সাগর এটিএনের মালিক ড. মাহফুজুর রহমান ও একাত্তর টিভির মালিক মোজাম্মেল বাবুর বিরুদ্ধে শত কোটি টাকার মানহানির মামলা দায়ের করেছেন। আন্দোলনকারী শিল্পীদের দাবিগুলো শুনলে মনে হয় তারা যেন ডাবিং করে প্রচারিত ইসলামের ইতিহাসের সিরিয়ালগুলো বন্ধের জন্য বেশি উদগ্রীব। বিদেশি ওই সিরিয়ালগুলো জনপ্রিয় হওয়ায় বিজ্ঞাপনদাতারাও ঝুঁকছেন সেদিকেই। ফলে ব্যবসাও বেশি যাচ্ছে এসব অনুষ্ঠান সম্প্রচারকারী টেলিভিশন চ্যানেলে। এ নিয়ে আপত্তি তুলেছে বেসরকারি টেলিভিশন মালিকদের একাংশ। অন্যদিকে কলকাতার সিরিয়ালগুলো জনপ্রিয়তার কারণে দেশের টিভি চ্যানেলের বড় বিজ্ঞাপনদাতারাও এখন বিদেশি চ্যানেলমুখি। এতেও ব্যবসা হারাচ্ছে দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলো। এ নিয়ে আপত্তি রয়েছে টিভি চ্যানেল মালিকদের। বিজ্ঞাপন থেকে পাওয়া আয়ই বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর মূল ব্যবসা। বিদেশি চ্যানেলে বাংলাদেশের পণ্যের বিজ্ঞাপন বন্ধে আন্দোলন সমর্থন করা শ্রেয়। কারণ বিজ্ঞাপনই টিভি চ্যানেলগুলোর একমাত্র আয়ের উৎস। চ্যানেল টিকিয়ে রাখতে হলে বিজ্ঞাপন বিদেশি টিভিতে দেয়া বন্ধ করতেই হবে। কিন্তু শিল্পীদের ভাষায় দর্শক যা ‘খায়’ সেটাইতো তাদের নির্মাণ করার কথা। এতে তাদের ম্লোগানের সার্থকতা থাকে। বাংলাদেশের দর্শকরা ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য, মুসলিম শাসকদের জীবন কাহিনী নিয়ে নির্মিত সিরিয়ালগুলো ‘গোগ্রাসে গিলছে’। যার কারণে বিবিসির মতো মিডিয়াও এই বাস্তবতা তুলে ধরেছে। তাহলে দেশের টিভির শিল্পী-কলাকুশলী এবং অংশিজনেরা দর্শকের চাহিদার কথা বিবেচনা করে ইসলামী ঐতিহ্যগুলো নিয়ে নাটক-সিনেমা নির্মাণে মনোনিবেশ করছেন না কেন? ইসলামের ইতিহাস ঐতিহ্যের কাহিনী নিয়ে নির্মিত সিরিয়াল দর্শক খায় এবং বিজ্ঞাপনও বেশি পাওয়া যায়; তারপরও সেদিকে নির্মাতাদের ধাবিত না হওয়ার পিছনে কি শুধুই ইসলাম বিদ্বেষ? নাকি অপসংস্কৃতিতে ভরপুর ভারতীয় টিভির প্রচারিত সিরিয়ালের বাংলাদেশে বাজার নষ্ট হবে এই ভয়ে? মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস না হোক ভারতের ইসলামের ইতিহাস নিয়েও শত শত নাটক-সিনেমা নির্মাণ করা যায়। সেগুলো না করে শুধুই ইসলামী ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে নির্মিত ডাবিংকৃত ধারাবাহিক বন্ধের মতলব হলে আন্দোলন বুমেরাং হবে। বরং ভারতীয় অপসংস্কৃতি বন্ধ, দেশি সংস্কৃতি তুলে ধরা এবং বাংলাদেশের দর্শকদের চাহিদা বিবেচনা করে ইসলামী ইতিহাস-ঐতিহ্যনির্ভর নাটক সিরিয়াল নির্মাণ হলে একদিকে দর্শকরা কলকাতার টিভির বদলে ঢাকার টিভি দেখবে; অন্যদিকে ব্যবসায়িক স্বার্থে ব্যবসায়ীরা বিজ্ঞাপন বিদেশমুখী না করে দেশের চ্যানেলগুলোতেই দিতে উৎসাহী হবেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।