Inqilab Logo

বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি সবকিছু ওপর প্রভাব ফেলবে

আর্থিকখাতের বিশ্লেষকরা পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে কয়েকগুণ, দেশের মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে : এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম :: জ্বালানির এত মূল্যবৃদ্ধি কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়, সরকারের ভ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৭ আগস্ট, ২০২২, ১২:০০ এএম

জ্বালানির মূল্য রেকর্ড পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে। এর আগে একবারে জ্বালানির এমন মূল্যবৃদ্ধি দেখেনি বাংলাদেশ। ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে লিটারপ্রতি ৩৪ টাকা, অকটেন ৪৬ টাকা এবং পেট্রল ৪৪ টাকা। সরকার বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয়, বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা ও তেলপাচার রোধে জ্বালানির মৃল্যবৃদ্ধি ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। চলমান অস্থিরতা মোকাবিলায় এই সিদ্ধান্ত সহায়ক হবে বলেও মনে করছেন সরকার সংশ্লিষ্টরা। অবশ্য আর্থিকখাতের বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ সিদ্ধান্ত যুক্তিসঙ্গত হয়নি। এটাকে কোনোভাবেই সমন্বয় বলে না। একতরফাভাবে চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষের কষ্ট আরও বেড়ে যাবে। তাদের মতে, একজন ভোক্তার অধিকারের কথা বিবেচনা করলে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর আগে অবশ্যই গণশুনানির প্রয়োজন ছিলো। জ্বালানির এমন মূল্যবৃদ্ধি একেবারেই অপ্রত্যাশিত। এখনো জ্বালানির মূল্য সমন্বয় করার সুযোগ আছে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, জ্বালানির এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে প্রথমেই ধাক্কা খাবে পরিবহন সেক্টর। পরিবহন সেক্টরের সঙ্গে সবই সম্পৃক্ত। পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। দেশের মূল্যস্ফীতি এমনিতেই নাগালের বাইরে। যদিও জুলাই মাসে কিছুটা কমেছে। এর কারণ হচ্ছে কোরবানির মাসে প্রবাসীরা অধিক পরিমাণে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন। এখন মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, ডিজেলের দাম বাড়ায় কৃষির ওপর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে। এবার বৃষ্টি কম হচ্ছে। আমন মৌসুমেও দরকার হচ্ছে সেচের। সেচ দিতে না পারলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। এ বিষয়গুলো একটি আরেকটির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ডিজেলের এমন দাম বাড়ানোর আগে অবশ্যই কৃষির কথা ভাবা দরকার ছিল। আর কৃষির উৎপাদন না হলে খাদ্য আমদানি বাড়বে। আমদানি-রফতানির মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এই ঘাটতি আরও বেসামাল হয়ে পড়বে।

এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সরকার আন্তর্জাতিক বাজারের দামের সঙ্গে সমন্বয় করার কথা বলছে। ভালো কথা। কিন্তু এখন কেন? বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম তো আরও আগেই বেড়েছিল। তখন সরকার কেন সিদ্ধান্ত নেয়নি। এখন তো বিশ্ববাজারে দাম কমেছে। সময়ক্ষেপণ করে অস্থিরতা তৈরি করার কোনো মানে হয় না। অনেক দেরিতে আমরা দাম বাড়াই। আবার দাম কমলে আমরা আর সমন্বয় করি না। এই প্রবণতা থেকে তো বেরিয়ে আসা দরকার। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা বলেন, সাধারণ মানুষের কষ্ট আরও বেড়ে যাবে। মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ এমনিতেই বাজারে যেতে পারছে না। এমন কোনো পণ্য নেই, যার দাম বাড়েনি। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এই দাম আরও অসহনীয় করে তুলবে। মধ্যবিত্তরা দিশেহারা হয়ে পড়বে। ক্রয়ক্ষমতা কমে গেলে মানুষ আর ভালো থাকতে পারে না।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবীদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জ্বালানির এত মূল্যবৃদ্ধি কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়। এই মূল্যবৃদ্ধিকে কোনোভাবেই সমন্বয় বলে না। একে একতরফাভাবে চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত বলে। সরকার আগে থেকেই পর্যায়ক্রমে সিদ্ধান্ত নিতে পারতো। আমাদের সবচেয়ে দুঃখজনক কথা হচ্ছে, বিশ্ববাজারে দাম কমলে এখানে দাম কমানো হয় না। বিশ্ববাজারে দাম বাড়ানোর কথা বলে আপনি যদি দাম বাড়ান, তাহলে বিশ্ববাজারে দাম কমলে কমানোরও দাবি রাখে। এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই গণশুনানি করা জরুরি ছিল। আগে অন্তত গণশুনানি হতো। মধ্যরাতে এমন সিদ্ধান্তকে আপনি জনবান্ধব সিদ্ধান্ত বলতে পারবেন না। আপনি মানুষকে কিছু জানতেই দিলেন না। ভোক্তার জানার অধিকার আছে।

জ্বালানির দাম বাড়লে সব কিছু ওপর প্রভাব পড়বে। জ্বালানি ছাড়া তো পরিবহন চলবে না। পরিবহন ব্যয় বাড়লে সবকিছুতেই ব্যয় বাড়বে। মানুষের সেবা পাওয়া কমে যাবে। সেবার মূল্য বেড়ে যাবে। এমনকি হাসপাতালের ব্যয় পর্যন্ত বেড়ে যাবে।

তিনি বলেন, সরকার পাশের দেশ ভারতের তুলনা দিচ্ছে। ভারত কী এভাবে কখনও তেলের দাম বাড়িয়েছে? ভারতে তেলের দাম কমানোরও রেকর্ড আছে। বাংলাদেশে কি কখনও কমেছে? কেউ কেউ আবার শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করে বলছে, সরকার আগাম ব্যবস্থা নিয়ে ঠিক করেছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি শ্রীলঙ্কার মতো খারাপ অবস্থায় পড়ে গেছি? আমরা এত খারাপ অবস্থায় যাইনি। শ্রীলঙ্কায় তো কিছুই ছিল না। ঠুনকোর ওপর চলছিল। আমাদের তো ভিত্তি আছে।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকার ভর্তুকির কথা বলছে। ভর্তুকি তো দিতেই হবে। অর্থনীতি ঠিক রাখতে গেলে আপনাকে কোথাও না কোথাও ভর্তুকি দিতেই হবে। আপনি অর্থের অপচয় বন্ধ করেন। টাকা পাচার বন্ধ করেন। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বন্ধ করেন। এসব বন্ধ করলে আপনি জ্বালানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, সারে আরও ভর্তুকি দিতে পারবেন। এতে অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে। খাদ্য নিরাপত্তা টেকসই হবে। এই সরকার ক্ষমতায় এসেই বিদ্যুতের জোগান দিতে গিয়ে একের পর এক ভ্রান্ত নীতি প্রণয়ন করেছে। রেন্টাল-কুইকরেন্টাল নিয়ে সরকার যে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল তা এখন বুমেরাং হয়েছে। ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তাহলে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে এসব বানানোর দরকার কী ছিল? এই অর্থ অপচয়ের তো মূল্য দিতেই হবে। সরকারের ভ্রান্ত নীতিই জ্বালানির ওপর চাপ ফেলেছে, যা অর্থনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। একই সঙ্গে নীতি গ্রহণ করতে গেলে সময়কে তিনভাবে ভাগ করতে হয়। স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি। এমন চিন্তা না করে হুট করে অস্থায়ী ভিত্তিতে জোড়াতালির সিদ্ধান্ত কোনো কাজে কল্যাণ আসে না। এখন সেই অকল্যাণই দেখতে পাচ্ছি।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, একজন ভোক্তার অধিকারের কথা বিবেচনা করলে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর আগে অবশ্যই গণশুনানির আয়োজন করতো। জ্বালানির এমন মূল্যবৃদ্ধি একেবারেই অপ্রত্যাশিত। জ্বালানির দাম বাড়তে পারে, তা আমরা ধারণা করছিলাম। সরকার লোডশেডিং বা অন্যান্য ব্যবস্থা নিচ্ছে। কিছুটা সাশ্রয়ী হওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা এটি সয়ে নিচ্ছি। কিন্তু এমনভাবে জ্বালানির দাম বাড়ানো হলো যে তা মানুষের ধারণার বাইরে। তিনি বলেন, সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে অর্থনীতি, রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে। জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। করোনার পর থেকে মানুষ এমনিতেই দিশেহারা। সরকার বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে এই মূল্যবৃদ্ধির কথা বলছে। আমি যদি খাবারই না পাই, তাহলে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার কী ফল আসবে! মানুষ যদি না খেয়ে মরে, তাহলে সরকারের নীতি তো জনবিরোধী নীতি বলেই বিবেচ্য হবে। সাধারণ মানুষ তো এত রাজনীতি বোঝে না। মানুষ চালের মূল্য কত বাড়লো বা কমলো তা ভালো বোঝে।

গোলাম রহমান বলেন, জ্বালানির এই মূল্য প্রত্যেকটা জিনিসের দাম বাড়াবে। আমি আশঙ্কা করছি, মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিটে চলে যাবে। এখন পর্যন্ত সিঙ্গেল ডিজিটে আছে বলে মনে করা হয়। সরকারের লোকজন শ্রীলঙ্কার উদাহরণ দিচ্ছে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কেন? এশিয়ার আরও দেশ আছে। তাদের সঙ্গেও তো তুলনা করা যায়। সরকারের লোকজন সিঙ্গাপুরের সঙ্গেও তুলনা করে। এত দ্রুত শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করবে কেন?

তিনি বলেন, চরম অব্যস্থাপনা আর ঘাটতি নিয়ে সরকার বড় বড় চিন্তা করতে অভ্যস্ত। এই বড় বড় চিন্তা বন্ধ করতে হবে। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার জন্য যা যা করার তাই করা দরকার। জ্বালানির মূল্য সমন্বয় করার সুযোগ আছে বলে মনে করি। ক্রয়ক্ষমতা সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখতে হবে। মানুষের জীবনমানের দিক বিবেচনা করে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে এমনটাই প্রত্যাশা করছি।##



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ