দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
এ, কে, এম, ফজলুর রহমান মুন্্শী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ইঞ্জিলে বর্ণিত নামাজের দোয়া :
হযরত ঈসা (আ.) হাওয়ারীদেরকে দোয়া এবং নামাজের আদব শিক্ষা দেয়ার প্রাক্কালে এই দোয়াটি শিক্ষা দিয়েছিলেন। “হে আমার পিতা! যিনি আকাশে আছেন, তোমার নাম পবিত্র, তোমার বাদশাহী বিস্তৃত, তোমার ইচ্ছা জমিন ও আসমানে তোমারই মর্জি মোতাবেক পরিপূর্ণ হোক, আমাদের দৈনিক রুজি-রুটি আজই আমাদেরকে দান করুন। আমাদের ঋণ ক্ষমা কর, যেভাবে আমরা অন্যদের ঋণ ক্ষমা করে থাকি। আমাদেরকে পরীক্ষায় নিপতিত কর না; বরং অমঙ্গল হতে বাঁচিয়ে রাখ, কেননা বাদশাহী, কুদরত ও জালাল সর্বদা কেবল তোমরাই, আমিন।”
নামের পবিত্রতা বর্ণনাই হচ্ছে আল্লাহর হামদ। বিস্তৃত বাদশাহী আগমনের অর্থ হচ্ছে কিয়ামত অথবা কাজের পরিণাম দিন। যা কোরআনের দোয়া ‘মালিকি ইয়াউমিদ্দীন’ শব্দ দ্বারা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তদুপরি দৈনিক রুটি-রুজি বলতে পরোক্ষভাবে দুনিয়াবি রুটি-রুজি বুঝায় না, বরং এর অর্থ হচ্ছে রূহের খাদ্য অথবা সিরাতে মোস্তাকিম। আর কর্জ ও ঋণ-এর মর্ম হচ্ছে দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ। যা আল্লাহর তরফ হতে বান্দাহদের ওপর আরোপিত আছে। পরীক্ষায় নিপতিত না হওয়া এবং অমঙ্গল হতে বেঁচে থাকার অর্থ হচ্ছে এই যে, যা ইসলামী দোয়ার শেষাংশে উক্ত হয়েছে। “না তাদের পথ যাদের ওপর তোমার অভিশাপ পতিত এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।”
এই বিশ্লেষণের উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, উপরোক্ত চারটি দোয়া যা চারজন মর্যাদাশীল পয়গাম্বরের জবান হতে ব্যক্ত হয়েছে; কোনও প্রকার অভ্যন্তরীণ সম্পৃক্ততার কারণে এগুলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত যা দ্বীনের পরিপূর্ণতার বিভিন্ন পর্যায়ে পরিলক্ষিত হয়। দোয়ায়ে মোহাম্মদী (সা.) সার্বিক পরিপূর্ণতার দর্পণস্বরূপ। এই দোয়া যদিও সংক্ষিপ্ত কিন্তু তার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী। আহকামে শরীয়তের পূর্ণতার প্রতীক। এর শব্দাবলী এমন বিশ্ব পরিব্যাপ্তকারী যা প্রত্যেক সময়, প্রত্যেক অবস্থায় প্রতিটি মানুষের অন্তরে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তা এমন সব উদাহরণ হতে মুক্ত যা বাহ্যিক দৃষ্টিশক্তিসম্পন্নদের পদস্খলনের কারণ হতে পারে। এমন কি মানুষের প্রতি আল্লাহর রহম ও করম গুণের ঋণ গ্রহণ করার অনুপ্রেরণা দান করে। যার মাঝে সৃষ্টিকূলের প্রতিটি বালুকণা পর্যন্ত দাখিল করেছে।
আল্লাহর সেই তিনটি গুণ, যার ধারণালব্ধ জ্ঞান ছাড়া আল্লাহর প্রতি ধারণা পূর্ণতা লাভ করতে পারে না (অর্থাৎ প্রতিপালন রহমত এবং আধিপত্য)। মোটকথা সূরা ফাতিহা এসবগুলোর সমাহার। রাবুবিয়াত ও প্রতিপালনের মাঝে ঐ সকল গুণাবলী সম্পৃক্ত আছে, যেগুলোর সম্পর্ক জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি মাখলুকের সাথে কায়েম থাকে। রহমত তাঁর সেই সর্বব্যাপী গুণ যার মাঝে তার যাবতীয় জামালী গুণাবলীর বৈচিত্র্য বিকশিত হয়ে ওঠে। আধিপত্য তাঁর সকল জালালী গুণাবলীর প্রচ্ছন্ন রূপ। সুতরাং সূরা ফাতিহা এই তিন প্রকার উদ্দেশ্যাবলীর সমাহার। অর্থাৎ হামদ, মঙ্গল কাজের জন্য নিবেদন এবং অমঙ্গল হতে নাজাত লাভের উপকরণ এতে আছে। বর্ণনা বিন্যাসের পারিপাট্যতা আল্লাহ ও তাঁর বান্দাহদের উত্তম গুণাবলীর বিকাশ। এই দোয়াতে তাও আছে। এর নিবেদনগুলো খুবই শিষ্টাচারপূর্ণ। একটি দোয়ার মাঝে আল্লাহর গুণাবলী তুলে ধরার কৌশল সূরা ফাতিহায় আছে এবং তা সাধারণ দোয়ার অন্তর্ভুক্ত। এই সূরায় দোয়ার মর্মকথা শুধু কেবল ব্যক্তিসত্তার সাথেই সম্পৃক্ত নয়, বরং আল্লাহর প্রতি আত্মনিবেদন এবং আত্মিক একাগ্রতার পরিপূর্ণতা ও শীর্ষতম পর্যায় এই দোয়ার মাঝে বিধৃত আছে। এ কারণেই এই দোয়ার মাঝে জাগতিক বস্তু নিচয়ের উল্লেখ করা হয়নি। আল্লাহর গুণাবলী এবং বান্দাহর কামনা-বাসনার প্রকৃতি ও পরিমাণ উভয় দিকের যথার্থ প্রতিফলন এতে রয়েছে। অর্থাৎ উভয় অংশের সুসামঞ্জস্যস্বরূপে স্থান দেয়া হয়েছে। অথচ এই দুটি অংশের বিষয়াবলীর মাঝে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে। আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও জালাল, রহম ও করম, কুদরত ও শওকত, ¯েœহ ও অনুকম্পা এবং বান্দাহর আনুগত্য ও দীনতা, উচ্চাশা, সত্য প্রত্যাশার এমন এক পরিপূর্ণ সমাহার, যা সংক্ষিপ্ত এবং প্রাণস্পর্শী বর্ণনাসমৃদ্ধ সূরা ফাতিহা ছাড়া আর কোথায় পাওয়া যাবে?
নামাজের সময় নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা :
নামাজের পরিক্রমার মাঝে ইসলামের একটি পরিপূর্ণ স্মৃতি হচ্ছে নামাজের সময় নির্ধারণ করা। একথা সুস্পষ্ট যে, দুনিয়ার কোন কাজ সময় এবং কালের সংশ্লিষ্টতা হতে বিমুক্ত হতে পারে না। এ জন্য কোন কাজ সম্পাদনের সময় হতে বেনেয়াজ হওয়া সম্ভব নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, নামাজের জন্য সময় নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা ছিল কি? মূল ঘটনা হলো এই রাসূলুল্লাহ (সা.) যে পরিপূর্ণ দ্বীন ও জীবনব্যবস্থা নিয়ে প্রেরিত হয়েছিলেন, এর বড় বৈশিষ্ট্য হলো, তা আমলী বা ব্যবহারিক। শুধু স্মৃতি বা দৃশ্যপট নয়। তিনি যে নামাজের শিক্ষা দিয়েছেন, তা শুধু নিয়মতান্ত্রিকতা ও স্মৃতি স্থাপনের জন্যই নয়; বরং এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, মানুষ প্রত্যহ বিভিন্ন সময়ে এই ফরজকে আদায় করবে। মানুষের মনোবিজ্ঞানভিত্তিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যে কাজ তাকে সদা-সর্বদা করতে হতো যতক্ষণ পর্যন্ত এর জন্য সময় নির্ধারণ করা না হয়, ততক্ষণ সে তা সচেতনতার সাথে ক্রমাগতভাবে আঞ্জাম দিতে পারে না। এ জন্য প্রতিটি সুবিন্যস্ত, নিয়মতান্ত্রিক এবং সার্বক্ষণিক কাজের জন্য সময় নির্ধারণ করা একান্ত প্রয়োজন। আর এই তরিকাটি সারা দুনিয়া স্বীয় সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক কাজগুলোর জন্য অবলম্বন করেছে। এর মাঝে মূল রহস্য হলো, যখন মানুষ বুঝতে পারে যে, তাকে কোনো কাজ করার জন্য ২৪ ঘণ্টার অবসর আছে, তবে সে সর্বদাই আলস্য ও দুর্বলতা হেতু এই কাজকে অপর বা অন্য সময়ের দিকে ঠেলে দিতে চাইবে। এমনি করে দিন কেটে যাবে। শেষ লগ্নটিও এসে যাবে, কিন্তু সে সেই কাজ আঞ্জাম দিতে পারবে না। তবে কাজগুলোর জন্য যদি সময় নির্ধারিত থাকে, তাহলে প্রত্যেক নির্দিষ্ট সময় আগমনের সাথে সাথে সে কাজের কথা তার স্মরণ হবে এবং সে মনে করবে নির্দিষ্ট সময় চলে গেলে অপর একটি কাজ এসে হাজির হয়ে যাবে। এভাবেই সময় নিয়ন্ত্রক ফেরেশতা সবসময় মানুষকে ফরজগুলো স্মরণ করিয়ে দেয়। এমন করেই সকল কাজ নিয়ম-শৃঙ্খলাসহ আঞ্জাম পায়।
নামাজের সময় নির্ধারণের ক্ষেত্রে সে জিনিসটিও লক্ষ্য রাখা দরকার, যার উল্লেখ পূর্বেই করা হয়েছে। অর্থাৎ অংশীবাদহীনতার নিয়মকানুন যা ইসলামের মূল পরিচয়। মুসলমান বিভিন্ন শহরে, দেশে মহাদেশে লক্ষ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে বসবাস করছে। কিন্তু বৃহত্তর জনগোষ্ঠী একটি নির্দিষ্ট সময়ের এবং একটি নির্দিষ্ট অবস্থায় এক ও অভিন্ন রূপ ধারণ করে।
নভোম-লে স্থাপিত কোনও দূরবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা যদি জমিনের প্রতি লক্ষ্য কর তাহলে দেখবে একটি নির্দিষ্ট সময়ে লক্ষ কোটি মানুষ একই অবস্থায় একই আকৃতিতে বিশ্ব¯্রষ্টার সামনে অবনত মস্তকে রয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত উদয় ও অস্তের দিগন্ত পরিষ্কার থাকবে, এই চিত্রের মাঝে কোনই পার্থক্য পরিলক্ষিত হবে না। সর্বত্র একই চিত্র পরিলক্ষিত হবে। বিভিন্ন দেশের উদয়াস্তের পার্থক্য যদিও এই অভিন্ন ও একক চিত্রকে এক সাথে হতে দেয় না। তবুও কমসে কম এই একাকীত্ব তো অবশ্যই আছে যে, যখন যে ...
অবস্থায় একস্থানে সূর্য থাকে, সে অবস্থাটি যখন দ্বিতীয় স্থানে উপনীত হয়, তখন নামাজের অপরিহার্যতা সেখানে উপস্থিত হয় এবং নামাজ আদায় করা হয়। এই একতা ও অভিজ্ঞতা সময় নির্ধারিত না হলে সম্ভব ছিল না। যদি এমনটি না হতো তাহলে এই বিশ্বরাচকে কেন, একটি মহল্লা এবং একটি গৃহের মুসলমানও এক স্থানে এবং এক অবস্থায় পরিদৃষ্ট হতো না।
অন্যান্য ধর্মে নামাজের নির্ধারিত সময় :
এ কারণেই সময় নির্ধারণের এই উপকারিতা ও মুসলেহাতকে অন্যান্য ধর্মেও সমানভাবে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে এবং নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি ও নিয়মকানুন মোতাবেক এবাদতসমূহের জন্য সময় নির্ধারিত করেছে। হিন্দুরা সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় পূজা করে। জবরদস্তি সম্প্রদায়ে শুধুমাত্র সূর্যোদয়ের সময় নিজেদের জমজমা পাঠ করে। আর রোমান ক্যাথলিক খৃস্টানরা প্রত্যুষে সূর্যোদয়ের পূর্বে, তারপর সন্ধ্যায়, তারপর রাতে শয়নকালে প্রার্থনা করে, ইহুদিরা তিন ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে, যাকে ‘দিগিল্লা’ বলা হয়। দানিয়াল নবীর কিতাবে আছে, “যখন দানিয়াল জানতে পারলেন যে, লিখিত দলিলের ওপর স্বাক্ষর হয়ে গেছে, তখন তিনি গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং ধায়তুল মুকাদ্দাসমুখী স্বীয় গৃহের দরজা খুলে দিয়ে দিনভর তিনবার হাঁটু গেড়ে আল্লাহর সামনে পূর্বে যেভাবে প্রণিপাত করতেন, সেভাবে প্রশংসাসুলভ হামদ ও দোয়া করলেন...” এভাবে প্রত্যহ তিনবার তিনি এবাদত করতেন (৬-১০ হতে ১৩ পর্যন্ত)। হযরত দাউদ (আ.)-এর কিতাব যাবুরে এই তিন ওয়াক্তের নির্ধারণ এভাবে করা হয়েছে, “সুতরাং আমি আল্লাহকে ডাকব তখন আল্লাহ আমাকে রক্ষা করবেন। সন্ধ্যায়, সকালে এবং দুপুরে আমি ফরিয়াদ করব এবং রোনাজারী করব, সুতরাং তিনি আমার ডাক শুনবেন (৫৫-১৬-১৭)। ইসলামী পরিভাষায় আমরা একে ফজর, জোহর এবং মাগরিবের নামাজ বলতে পারি।”
হযরত ঈসা (আ.) দোয়া এবং নামাজের গুরুত্ব আরও বর্ধিত করেন। লুক সঙ্কলিত ইঞ্জিলে আছে, “তারপর তিনি (হযরত ঈসা আ.) এ জন্য যে তাকে সর্বদা দোয়ায় মগ্ন থাকা এবং অবহেলা না করা আবশ্যক, একটি উদাহরণ পেশ করলেন।” (১৮-১) আর হাওয়ারীদের কর্মকা- হতে জানা যায় হযরত ঈসা (আ.)-এর শরীয়তেও নামাজের ঐ সময়ই নির্ধারিত ছিল, যার প্রচলন ইহুদিদের মাঝেও ছিল। এমন কি তার চেয়ে বেশি ছিল। জোহরের নামাজ তাদের ওপরও ছিল। সুতরাং ‘কর্মাবলীকা-ে’ আছে, পিটয়াছ ‘দুপুরের কাছাকাছি সময়ে কুঠিতে দোয়া করতে গেলেন’ (আমাল ১০-৯)। তাছাড়া আরো কিছু সময় বর্ণিত করা হয়েছিল। অপর এক স্থানে আছে, সুতরাং পিটয়াছ এবং ইউহান্না একসঙ্গে প্রার্থনার সময় তৃতীয় হায়কালের দিকে গমন করলো (আমাল ৩-১)। গ্রিক ভাষায় তৃতীয় প্রস্তাবের স্থলে নবম ঘড়ির কথা লেখা আছে, যাকে আমরা আসর বলে থাকি। তারপর এ সময়ের নামাজের কথা ‘আমাল’ ১০-৩০ শ্লোকেও উল্লেখ আছে। একবার হযরত ঈসা (আ.)-এর কোনও শাগরেদ নামাজের খাস দোয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো। তিনি প্রত্যুত্তরে বললেন, “দোয়ার উত্তম সময় হচ্ছে অর্ধ রাত্রি।” এবং এমন হলো যে, তিনি একস্থানে দোয়া করছিলেন। যখন তিনি দোয়া শেষ করলেন, তখন তার শাগরেদদের মাঝে একজন তাকে জিজ্ঞেস করলো, হে প্রভু! আমাদেরকে দোয়া করতে শিক্ষা দিন যেমন হযরত ইউহান্না (হযরত ইয়াহইয়া (আ.) স্বীয় শাগরিদগণকে শিক্ষা দিয়েছেন)। তখন তিনি তাকে লক্ষ্য করে বললেন, যখন তুমি দোয়া করবে, তখন বলবে তোমাদের মাঝে কে আছে, যার এক বন্ধু হবে, অর্ধেক রাতে তার কাছে এসে বলবে, হে বন্ধু! আমাকে তিনটি রুটি ধার দাও! (লুক : ১১) এই উদাহরণের মাঝে হযরত ঈসা (আ.) রাতের নামাজের শিক্ষা দিয়েছেন। সুতরাং যে রাতে তাকে বন্দী করা হয়, তখন তিনি একটি জামাতের সাথে এই তাহাজ্জুদ নামাজে নিমগ্ন ছিলেন। (লুক : ২২-৩৯)
ফজরের নামাজের কথাও ইঞ্জিলে আছে। মার্কস-এর সংকলিত বাইবেলের প্রথম অধ্যায়ের ৩৫তম শ্লোকে আছে, “বড় তারকার উদয়ের পূর্বেই তিনি উঠে গেলেন এবং একটি জনশূন্য বিরাণ স্থানে গমন করলেন এবং সেখানে দোয়া করলেন।” (লন্ডনে মুদ্রিত : ১৮৬৫ ইং) বরং এর আরবি তরজমা যা সরাসরি গ্রিক ভাষা হতে অনূদিত (আদবিয়া প্রেস, বৈরুত, ১৮৮৬ ইং এবং অক্সফোর্ড প্রেস ১৮৯০ ইং) এর দ্বারা এ কথা বোঝা যায় যে, হযরত ঈসা (আ.) সর্বদা এ সময়ে নামাজ আদায় করতেন। সুতরাং এই আয়াতের তরজমা এভাবে করা হয়েছে :
অর্থাৎ অতি প্রত্যুষে উঠে, তিনি একটি শূন্য ময়দানে চলে যেতেন এবং সেখানে নামাজ পড়তেন। সুতরাং এই সময়গুলোর কথা যা ইহুদি খৃস্টানদের পবিত্র কিতাবসমূহে উল্লেখ আছে, এগুলোকে যদি আমরা একত্র করি তাহলে ইসলামে প্রবর্তিত নামাজের সময় নির্ধারণ হয়ে যাবে। যার মাঝে প্রত্যুষের ফরজ, দ্বিপ্রহরের জোহর, সন্ধ্যার মাগরিবের উল্লেখ যাবুরের (৫৫-১৬ ও ১৭) মাঝে; ফজরের উল্লেখ মার্কস : (১-৩৫)-এ; এবং আসরের ‘আমালে’ (৩-১০=৩-৩০); এবং এশা রাতে নামাজের কথা লুক (১১ ও ২৩-৩৯)-এ আছে।
নামাজের জন্য উপযুক্ত প্রাকৃতিক সময় :
আসল কথা হচ্ছে এই যে, মানুষ ও ফেরেশতাদের মতো রাত ও দিনে কেবল দোয়া ও নামাজে নিরত থাকারই কথা ছিল। কিন্তু মানুষের প্রাকৃতিক ও শ্রেণিভিত্তিক প্রয়োজনসমূহের দরুন এমনটি হওয়া সম্ভব ও উপযোগী ছিল না। এ জন্য শরীয়তে এর পরিপূরণ এভাবে করা হয়েছে যে, এর জন্য কতিপর উপযুক্ত সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিটি মানুষ প্রত্যহ বিভিন্ন প্রকার কাজের মাঝে স্বীয় জীবনের চব্বিশটি ঘণ্টা অতিবাহিত করে। সকালে সে জাগ্রত হয়, দ্বি-প্রহর পর্যন্ত কাজ করে সামান্য সময় শ্রান্তি লাঘব করে। তারপর তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত সে অবশিষ্ট কাজ আঞ্জাম দেয় এবং এসকল কাজ সমাধা করে ভ্রমণ ও বিচরণ এবং প্রাণপ্রিয় অনুষ্ঠানে নিজের মনকে ব্যাপৃত রাখে। সন্ধ্যা হয়ে গেলে গৃহে প্রত্যাবর্তন করে পারিবারিক জীবন শুরু করে। তারপর পানাহার সমাপ্ত করে সামান্য অবসর নিয়ে দীর্ঘ শান্তি এবং সুখ নিদ্রার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। সুতরাং ইসলামী নামাজসমূহের প্রতি একনজর দেখলে বোঝা যাবে যে, ইসলাম প্রাত্যহিক এসকল বিভিন্নমুখী কর্মব্যস্ততার প্রত্যেকটির শুরুতে এক ওয়াক্তের নামাজ স্থিরীকৃত করেছে। যাতে করে সকল সময় আল্লাহর স্মরণের মাঝেই পরিগণিত হতে পারে। আলোর কিরণ বিকাশের সময় যখন প্রভাতের শান্ত সমীরণ ‘হইয়্যা আলাস্ সালাহ’-এর প্রাণস্পর্শী সূর লহরী বয়ে আনে এবং প্রতিটি বস্তুর জবান হতে বিশ্ব¯্রষ্টার তাসবীহ ও তাহমীদের স্বর বুলন্দ হতে থাকে, সে সময়টি গাফেল মানুষের মাথা অবনত করার জন্যও অধিক উপযোগী হবে। কেননা জীবনের কিতাবে দৈনন্দিন কর্মকা-ের একটি নয়া পাতা সে সময় উন্মোচিত হয়। এ জন্য এটাই উপযোগী যে, এদিনের কর্মকা-ের ফলকের ওপর সর্বপ্রথম আনুগত্যের সেজদাহর মোহর অঙ্কিত হোক। যার পরে মানুষ স্বীয় মেহনত ও পরিশ্রমের কাজ শুরু করে এবং দ্বিপ্রহর পর্যন্ত এ কাজে ব্যাপৃত থাকে। নিষ্প্রহারে দৈনিক কাজের অর্ধাংশ শেষ করে মানুষ সামান্য সময়ের জন্য আরাম করে। এ অবস্থায়ও তাকে আল্লাহর শোকর আদায় করা উচিত। কেননা, দিনের অর্ধেক কাজ সুষ্ঠু ও মঙ্গলজনকভাবে শেষ হয়েছে। তারপর তৃতীয় প্রহরের পর যখন স্বীয় কাজ শেষ করে ভ্রমণ ও বিনোদন এবং ব্যক্তিগত আরামের কাজ শুরু হয়, তখন এ সময়টিও আল্লাহর নাম স্মরণের জন্য। তারপর সন্ধ্যা হয়ে আসলে দুনিয়ার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দ্বিতীয় দৃশ্য ফুটে উঠে। দিনভর কাজকর্মের পর এখন হতে শান্তি ও আরামের প্রবাহ শুরু হয়। এ জন্য প্রয়োজন যে, এর প্রারন্তও যেন আনুগত্যের সেজদাহ দ্বারা শুরু হয়। তারপর নিদ্রার সময় যখন মানুষ স্বীয় অনুভূতিপূর্ণ জিন্দেগী হতে সামান্য সময়ের জন্য বেখবর হতে শুরু করে তখন এটাও প্রয়োজন যে, আল্লাহর নাম নিয়েই যেন সে বেখবর হয়। কেননা, সে কি জানে যে, এ সময়ে বুঝে আসা চোখ দুটো কখনো উন্মিলিত হওয়ার সুযোগ লাভ করবে কি? এভাবে শেষ জীবন পর্যন্ত দৈনন্দিন কাজের এই প্রস্তুতি নিজ নিজ স্থানে প্রত্যাবৃত হতে থাকে।
সকাল হতে দ্বিপ্রহর পর্যন্তই মানুষের আসল ব্যস্ততার সময়। এ জন্য সকাল হতে সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়া পর্যন্ত কোনো ফরজ নামাজ নেই। অনুরূপভাবে এশা হতে সুবেহ সাদেক পর্যন্তও কোনো ফরজ নামাজ নেই। এ সময়টি শুধুমাত্র শান্তিদায়িনী নিদ্রার জন্যই উপযুক্ত। এই নির্দিষ্ট সময়গুলো ছাড়া বাকি সময় সবই হচ্ছে মানুষের কাজ করার সময়। এ জন্য প্রতিটি কাজের পূর্বেই ফরজ নামাজগুলোকে বিন্যাস করা হয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।