বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মোহাম্মদ গোলাম হোসেন : কেন্দ্রীয় কারাগারের পরিত্যক্ত স্থানটির সর্বোত্তম ব্যবহার প্রসঙ্গে লেখাটি প্রায় শেষ করছি অমনি ১০০ টাকা প্রবেশ মূল্যের বিনিময় ২ নভেম্বর থেকে ৫ নভেম্বর ২০১৬ আমজনগণের জন্য কারাগার পরিদর্শনের সুযোগ প্রদানের খবরটি নজরে এলো। টাকার অংকটা বেশি হলেও দারুণ পুলকিত বোধ করলাম। লেখা অসম্পূর্ণ রেখেই নির্ধারিত সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় থাকলাম। ২ ও ৩ নভেম্বর সুযোগ হয়ে না উঠলেও ৪ নভেম্বর আর ছাড় দিলাম না। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, বৃষ্টি ও শারীরিক অসুস্থতা সব কিছু উপেক্ষা করে কাদা পানির মধ্যে কাকভেজা অবস্থায় বেলা আড়াইটার দিকে কারাফটকে এসে উপস্থিত হলাম। আজকের লেখার মূল প্রতিপাদ্য সেই পরিদর্শন অভিজ্ঞতা সংশ্লিষ্ট হলেও মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে যে সকল পাঠক আগ্রহ থাকার পরও কারা পরিদর্শনের সুযোগ নিতে পারেনি বলে ‘দিল্লির লাড্ডু’ না খাওয়ার মতো আফসোসে ভোগছেন তাদের ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানিয়ে বাহ্যত কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক বিবেচিত হবে জেনেও ৪৪ বছর পেছনের একটি অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে শিক্ষণীয় হতে পারে বিবেচনায় সংক্ষেপে তুলে ধরছি।
১৯৭২ সাল। ভিয়েতনাম যুদ্ধ তখন চরম পর্যায়ে। এরই মাঝে মি. নিক্সন দ্বিতীয় মেয়াদে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে অভিষিক্ত হলেন। তখনকার পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে তাকে একটি চিঠি লিখতে খুব ইচ্ছে হলো। মতিঝিল আদমজী কোর্ট বিল্ডিংয়ে তখন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের একটি অফিস ছিল। চিঠিটা হাতে করে ওখানে গেলাম। কোনো প্রকার বাধা-প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই রিসেপশনে পৌঁছে গেলাম। একজন তরুণী ডেক্সে বসা। আপনার কি চাই এমন সুন্দর বাংলা শোনতেই চমকে উঠলাম। বললাম ‘আমেরিকায় চিঠি লিখতে পোস্টাল চার্জ কত লাগবে জানতে এসেছি।’ ‘পোস্ট অফিসে না গিয়ে এখানে কেন’ এমন প্রশ্ন অপ্রত্যাশিত না হলেও তিনি সহজভাবে বললেন ‘সাড়ে চার টাকা।’ ‘আমেরিকায় কে থাকেন’ জানতে চাইলে বললাম- ‘না, কেউ না।’ আপনাদের প্রেসিডেন্ট মি. নিক্সনকেই লিখছি’। সহাস্যে বললেন তাই! ‘আপনি বোধকরি ছাত্র। সাড়ে চার টাকা আপনার জন্য কষ্টকর হতে পারে। (তখনকার দিনে এই টাকায় ৮/১০ দিন নাস্তা করা যেত অনায়াসে।) ইচ্ছে করলে আমাকে দিতে পারেন। রাষ্ট্রীয় ডাকে পাঠিয়ে দেবো।’ অপ্রত্যাশিত এই প্রস্তাবে আনন্দিত ও চমৎকৃত হলাম। খামটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘জবাব পাব তো ম্যাডাম?’ ‘আপনার ঠিকানা যদি ভুল না হয়ে থাকে, আর আপনাদের পোস্ট অফিস যদি দায়িত্ব পালনে অবহেলা না করে তবে সাত দিনের মধ্যে জবাব পাবেন অবশ্যই।’ আমি অবাক হচ্ছি ভেবে কৈফিয়তের ভাষায় বলেলন, ‘সপ্তাহে মাত্র দুটি ফ্লাইট। তাই সাত দিনের আগে জবাব পাওয়া সম্ভব নয়। আগামী দিন একটা ফ্লাইট যাবে, সেটাতেই ধরিয়ে দেব।’ ‘ধন্যবাদ আপনাকে, তবে আসি’! ‘ধন্যবাদ আপনাকেও, আমাদের প্রেসিডেন্টকে চিঠি লেখার জন্য!’ সাড়ে চার টাকা সাশ্রয়ের আনন্দে পাশাপাশি একজন আমেরিকানের বিশুদ্ধ বাংলা বলার ধরন, আর ৭ দিনের মধ্যে জবাব পাওয়ার নিশ্চয়তা সব মিলিয়ে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি নিয়ে বাসা অভিমুখে হাঁটছি। শান্তিনগর ডাকঘরের নিকটেই থাকি। তরুণীর আশঙ্কাটাই যেন সত্য না হয় এ জন্য বাসায় ফেরার আগেই পিওনকে বলে রাখলাম। কখন যে সাত দিনের মেয়াদ এসে গেছে খেয়ালই করিনি। বিকালবেলা পিওন এসে উপস্থিত। এই যে আপনার চিঠি। তড়িৎ গতিতে খামটা হাতে নিলাম। হিসাব করে দেখলাম সত্যি সাত দিনেই জবাব এসে গেছে। খাম খুলে দেখলাম হোয়াইট হাউসের প্যাডে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের স্বহস্ত স্বাক্ষরিত জবাব; সহজ ইংরেজিতে সবিস্ময়ে ভাবলাম একজন রিসিপশনিস্ট কেমন করে সাত দিনের মধ্যে প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে জবাব পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারলেন। তাও আবার বাংলাদেশের একজন অখ্যাত ব্যক্তিকে? দুস্তর ব্যবধানের দুজন মানুষের মাঝে আস্থা ও বিশ্বাসের এমন সমন্বয় কেমন করে সম্ভব হলো চুয়াল্লিশ বছর পরও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সরকারের দায়িত্বশীলদের কথায় কাজে বৈপরীত্য ও সমন্বয়হীনতায় আজও তা আমাকে অবাক করে।
এবার কারাগার পরিদর্শনে ফিরে আসি। কারাফটকের সামনে এসে পৌঁছালাম বেলা আড়াইটার দিকে। অবিশ্রান্ত বৃষ্টির মধ্যে কয়েকশ দর্শনীর জটলা। টিকিট কোথায় দেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে একজন মহিলা ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘এই দেখেন বাচ্চাদের নিয়ে এসেছি মিরপুর থেকে। এখন শুনছি বন্ধ।’ বন্ধ কেন?Ñ এ প্রশ্নের জবাবে আর একজন বললেন, ‘আগামীকাল নাকি প্রধানমন্ত্রী আসবেন। তাই এই ভোগান্তি। আর একজনের উক্তি, ‘প্রধানমন্ত্রী আসবেন তো ভোগান্তি বাড়বে কেন? বরং দর্শনার্থীদের সুযোগ-সুবিধাই তো বাড়ার কথা।’ মিডিয়ায় ঘোষণা না দিয়েই এভাবে প্রদর্শনী হঠাৎ করে বন্ধ হতে পারে কথাটা বিশ্বাস হচ্ছিল না। ডানে-বামে কোথাও কারা কর্তৃপক্ষ বা পুলিশের কোনো লোক খুঁজে পেলাম না। কোথাও কোন নোটিশ বা বিজ্ঞপ্তিও নজরে পড়ল না। খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে ‘অনুসন্ধান’ লেখা ভবনটির দিকে নজর পড়তেই এগিয়ে গেলাম। একজন পুলিশ ওখানে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রদর্শনী আজ ও আগামীকাল (অর্থাৎ ৪ ও ৫ তারিখ) বন্ধ থাকবে বলে তিনি জানালেন। কেন বন্ধ, কবে খোলা হবে বা আদৌ আর খোলা হবে কিনা এ সকল কোনো তথ্য জানাতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করলেন। কোনো তথ্যই যদি দিতে না পারেন তাহলে এখানে বসে কেন? এমন প্রশ্নে ভদ্রলোক হেসেই জবাব দিলেন, এর বেশি কিছু তার জানা নেই। প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষকে ফোন করার পরামর্শ দিয়ে দায়িত্ব শেষ করলেন তিনি। এতটা কষ্ট করে এসে ফিরে যেতে মন সায় দিচ্ছিল না। এমন সময় হঠাৎ মাইক বেজে উঠলো। ভাবলাম একটা গতি হলো বুঝি। না, ঘোষক যা বললেন তা হতাশাকেই নিশ্চিত করল শুধু। অনিবার্য কারণবসত আজ ও আগামীকাল ৪ ও ৫ নভেম্বর প্রদর্শনী বন্ধ থাকবে। তৎপরিবর্তে ১১ ও ১২ নভেম্বর প্রদর্শনী খোলা থাকবে। ঘোষণাটি বার কয়েক প্রচারের পর দর্শকদের স্থান ত্যাগে তাগিদ দেয়া হতে থাকল। কারাগার পরিদর্শনের প্রথম পর্ব এভাবে শেষ করার পর দ্বিতীয় পর্বের জন্য অপেক্ষায় থাকলাম। ১১ নভেম্বর নানা কারণে পেরে উঠলাম না। ১২ নভেম্বর সব ঝামেলা এক দিকে রেখে দুপুরের দিকেই রওনা হলাম। কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটকের সামনে পৌঁছাতে সোয়া ৩টা বেজে গেল। ফটকের সামনে ভিড় আজকে অনেক বেশি। টিকিট কোথায় দেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে কেউ একজন বললেন ‘বাসায় যানগা, খুলব না।’ আর একজন একটা ব্যানারের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন পড়ে দেখুন। ব্যানারে লেখা, সংগ্রামী জীবন গাঁথা, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার দুর্লভ আলোক চিত্র নিয়ে কারাগারের ভেতরে প্রথম প্রদর্শনী।
১-৫ নভেম্বর, ২০১৬। সর্বসাধারণের জন্য ২-৫ নভেম্বর ২০১৬। আর একটি ব্যানারে লেখাÑ ‘সংগ্রামী জীবন গাঁথা, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার দুর্লভ আলোকচিত্র নিয়ে কারাগারের ভেতরে প্রথম প্রদর্শনী। স্থান- পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে।’ এরই নিচে লাল কালিতে বড় বড় অক্ষরে লেখা, ‘১১ ও ১২ নভেম্বর ২০১৬ (শুক্র ও শনিবার) প্রদর্শনী বন্ধ।’ অনেকে ব্যানারের ভাষার অর্থ ও তাৎপর্য বোঝতে না পেরে পরস্পরকে জিজ্ঞাসা করতে দেখা গেল। অবশেষে আবার ‘অনুসন্ধান’-এর শরণাপন্ন হলাম। ৪ তারিখে যাকে দেখেছিলাম তিনিই চেয়ারে বসা। বললামÑ ‘৪ তারিখ ফিরিয়ে দিলেন, বললেন ১১-১২ তারিখ খোলা থাকবে। গাজীপুর থেকে এলাম আবারও এভাবে কষ্ট দেয়ার মনে কি’? ভদ্রলোকের ভাষ্য, ‘গাজীপুর কেন, সেই রংপুর-কক্সবাজার থেকেও এসেছেন অনেকে। প্রদর্শনী বন্ধ রাখার ঘোষণা তো দেখতেই পাচ্ছেন, এর বেশি আমি কিছু জানি না।’ ‘তা হলে দর্শনার্থীদের ১১-১২ তারিখ আসতে বলা হলো কেন’Ñ প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, ১১-১২ তারিখের প্রদর্শনী ৬-৭ তারিখেই হয়ে গেছে। ‘দাওয়াতটা পত্রিকায়-টিভিতে প্রচার করলেন, বাতিলের খবরটা জানালেন না কেন’Ñ প্রশ্নের জবাবে তিনি অসহায়ের মতো একটা মোবাইল নম্বর দেখিয়ে দিয়ে ফোন করতে অনুরোধ করলেন। তাকে আর বিরক্ত না করে মোবাইলে বার কয়েক চেষ্টা করলাম, অন্য কয়েকজনকেও করতে দেখলাম কিন্তু কল রিসিভ করলেন না কেউ। দর্শনার্থীদের মধ্যে শিশুদের নিয়ে আসা মহিলাদের উপস্থিতি এবারও ছিল উল্লেখযোগ্য। অনেক মাকেই অবুঝ বাচ্চাদের বোঝাতে ব্যস্ত দেখলাম। কেউ হেন অবস্থার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করছেন নানাভাবে ও ভাষায়। এদিন আর মাইকে ‘অনিবার্য কারণ’ হেতু দুঃখ প্রকাশ করতেও দেখা গেল না। কারা পরিদর্শনের এ লেখা কারো না দেখার আফসোস কিঞ্চিত লাগব হলেও হতে পারে, কিন্তু একটি সরকারি সিদ্ধান্ত ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করার পর এমন নৈরাজ্য ও হেয়ালিপনার শিকার হওয়ার কষ্ট ও গ্লানি উপসমের কোনো উপায় খুঁজে পেলাম না।
অবাক হওয়ার বিষয়, প্রধানমন্ত্রী আসবেন বলেই কর্তৃপক্ষ দুই দিন আগেই সংস্কারের জন্য রাস্তা বন্ধ করে দিলেন, তা হলে লাখো দর্শনার্থীর সুবিধা বিবেচনায় নিয়ে রাস্তা সংস্কারের কাজটা ১ নভেম্বরের আগেই সম্পন্ন করা গেল না কেন? প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চয়ই আমজনতার মতো নয়। তাঁর কোনো প্রোগ্রাম নিশ্চয়ই হঠাৎ করে হয় না। সুতরাং এই প্রোগ্রামটি ১ নভেম্বরের আগেও যেমনি নেয়া যেত, তেমনি নেয়া যেত ৬ তারিখ বা তারপরও। ২-৫ নভেম্বর সাধারণের জন্য প্রদর্শনীর কর্মসূচি নিশ্চয়ই ওপর মহলের এমনকি প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিক্রমেই নেয়া হয়ে থাকবে। তাহলে এমন হেয়ালিপনার শিকার হতে হলো কেন অগণিত দর্শনার্থীদের, যাদের অনেকেই ছিলেন দূর-দূরান্ত থেকে আগত নারী ও শিশু। একান্ত অপরিহার্য কারণটি মিডিয়ায় প্রকাশের বিষয়টি কী কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে পড়ে না, যখন আমন্ত্রণের ঘোষণাটি ঘটা করে মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার করা হলো? ৪ ও ৫ নভেম্বরের প্রদর্শনী ১১ ও ১২ নভেম্বর পুনর্নির্ধারণের সিদ্ধান্তটি ৪ তারিখ মাইকিং করে জানিয়ে দেয়ার পর কোনো প্রকার প্রেসরিলিজ ছাড়াই তা ৬ ও ৭ নভেম্বর এগিয়ে আনার সিদ্ধান্তটি কোনো দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের পক্ষে কেমন করে সম্ভব হতে পারে? আমরা যারা বয়সে প্রবীণ, তাদের না হয় জীবন অভিজ্ঞতার থলেটি এ ধরনের হাজারো ঘটনার রেফারেন্সে ভরপুর, কিন্তু এই যে অগণিত শিশু-কিশোর যারা বৃষ্টি বাদল আর যানজটের কষ্ট উপেক্ষা করে কৌতূহল ও উদ্দীপনা নিয়ে এসে মিথ্যে ও ধোঁকার হাতেখড়ি নিয়ে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ঘরে ফিরে গেল সেই ক্ষতিটা আমাদের চেতনা ও মূল্যবোধের দরজায় একবারও আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে কী? একজন মা তার শিশুদের সাভার বা নারায়ণগঞ্জ থেকে বৃষ্টি মাথায় বন্ধ রাস্তায় কাদা পানি মাড়িয়ে নিয়ে এলেন, কেউ এলেন কক্সবাজার বা রংপুর থেকে। ‘শুক্রবার-শনিবার, ১১-১২ তারিখ প্রদর্শনী বন্ধ’ ব্যানারে এ কথাটা লিখে ঝুলিয়ে দিলেই দাওয়াত দিয়ে আনা মানুষগুলোর প্রতি সত্যিকার ইনসাফ করা হয় কী? সবচেয়ে বড় ভয় ও আতঙ্কের বিষয়টি যা আমাকে বার বার বিচলিত করেছে তা হলো ডেকে আনা বাইরের মানুষগুলোই যদি এমন আচরণের শিকার হোন তা হলে এই প্রাচীরের অভ্যন্তরের বাসিন্দাদের প্রকৃত অবস্থাটা কী? ‘চোর মুক্তি পেয়ে ডাকাত হয়’ প্রবাদ বাক্যটি এ কারণেই সৃষ্টি হয়নি তো?
২২৮ বছরের এক জীবন্ত ইতিহাস ও স্মৃতির অ্যালবাম এই কারাগার। এখানকার বাসিন্দাদের সকলেই অপরাধী ছিলেন তা নয়। জাতির অনেক শ্রেষ্ঠ সন্তান, সৎ ও মহৎ জনকেও অকারণে এখানে শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। যুগে যুগে কত ক্ষমতাধরের জিঘাংসা ও প্রতিহিংসার শিকার হয়ে কত নিরপরাধ মজলুম মানবতা এই কারা প্রাচীরে আর্তনাদ করে মরেছে। জালিমের বিরুদ্ধে অকুতোভয় সত্য উচ্চারণের জন্য আপসহীন বিশ্বাসের জন্য কত মানুষ কতভাবে অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হয়ে আর্তনাদ করে করে জীবনলীলা সাঙ্গ করেছে এই কারাগারে? আজ প্রতিটি ধূলি-কণা এর নীরব সাক্ষী হয়ে আছে। সুতরাং অন্য সকল দাবি এড়িয়ে এই ঐতিহাসিক স্থানটিকে জাদুঘরে রূপান্তরের সিদ্ধান্তের সাথে এক মত পোষণ করেও ভিন্ন আঙ্গিকে কিছু পরামর্শ রাখতে চাই।
১. উদ্যোগটি কোনোমতে ব্যক্তি বা দলীয় দৃষ্টিকোণের আরেক কারা প্রাচীরে যেন বন্দি হয়ে না পড়ে, ইতিহাসের অপমৃত্যু যেন না হয় নাটক আর রূপকথাতে।
২. প্রায় ১৯ একর ভূমির একক একটি প্লট এখন ঢাকা শহরে কল্পনা করাও যায় না। এদিক থেকে এটি একটি দুর্লভ সুযোগ। সুতরাং এ বিশাল চত্বর জুড়ে ফলদ বৃক্ষায়ন (যেহেতু ঢাকা শহরে ফলদ বৃক্ষের দুর্ভিক্ষ এখন সবখানে নজরে পড়ার মতো।)সহ পূর্ব-পশ্চিমে প্রলম্বিত বা বৃত্তাকার জলাধার বা লেক রচনা করা যেতে পারে। এটি ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিক থাকায় সহায়ক হওয়া ছাড়াও মৎস্য ও হাঁস চাষ করা যেতে পারে লাভজনকভাবে। তা ছাড়া ফি প্রদানপূর্বক সাঁতার শেখা, নৌ-বিহার ও বড়শি দিয়ে মাছ শিকারের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। তা ছাড়া ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে এটি হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্রও।
৩. কারাগারের প্রতœতাত্ত্বিক ক্ষতি না করে সম্ভব হলে কারাগারের দেয়াল ভেতরের দিকে সরিয়ে নিয়ে চার দিক ঘিরে অবস্থিত রাস্তাগুলোকে আরো প্রশস্ত করার চেষ্টা করা যেতে পারে। এতদভিন্ন চকবাজার বা উর্দু রোড থেকে কারাগারের ওপর দিয়ে চানখাঁরপুল পর্যন্ত একটি প্রশস্ত ফ্লাইওভার নির্মাণ করা গেলে এই এলাকার দীর্ঘদিনের একটি সমস্যার সহজ সমাধান হতে পারে।
৪. ঘোষণায় বলা হয়েছে, প্রদর্শনী বাবত প্রাপ্ত অর্থ কাশিমপুর কারাগারে মায়েদের সাথে অবস্থানরত ৪০ জন শিশুর জন্য খেলনা ক্রয়ে ব্যয় হবে। এই মহৎ উদ্যোগের জন্য কর্তৃপক্ষকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু কথা হলো, শুধু খেলাধুলা নয় তাদের পড়ালেখা, চিকিৎসা, উত্তম খাবার ও পোশাকের বিষয়টিও এর মধ্যে আনা উচিত। আর এটি শুধু কেন্দ্রীয় কারাগারে অবস্থানরত শিশুদের জন্য না হয়ে সকল কারাগারের জন্যই হওয়া উচিত। তবে ৪০ জন মাত্র শিশুর জন্য কত টাকার খেলনা লাগে সেটিও একটি প্রশ্ন বটে! ৫. আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অথচ সম্পূর্ণ অবহেলিত বিষয় হলো, যে সকল শিশুর পিতা কারা জীবনযাপন করছেন তাদের শিশুরা কীভাবে মানুষ হচ্ছে সেই বিষয়টি। একজন পিতাকে অন্তরীণ রাখার কারণে যদি পাঁচজন শিশু-কিশোর বিপদগামী ও সমাজের বোঝা হয়ে বড় হয় তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্রের নিট লোকশানটা কী দাঁড়াল সেই হিসাবটা কখনো মিলানো হয়েছে কী? এ দায়িত্ব বন্দি পিতার না সমাজ ও রাষ্ট্রের?
৬. পুরান ঢাকায় নাগরিক সুবিধাদি তুলনামূলকভাবে অনেক কম। কারাগারের একাংশে একটি শিশুপার্ক, মিনি চিড়িয়াখানা ও বয়স্কদের জন্য ব্যায়ামাগার করা যেতে পারে, যা নির্ধারিত প্রবেশ মূল্যে সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
৭. পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে পারলে এটি পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হতে পারে। তবে দর্শন ফি ১০০ টাকা থেকে কমিয়ে ২০/৩০ টাকার মধ্যে নির্ধারিত করা উচিত।
কারাগার ব্যবস্থাপনার জন্য যে বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তা হলো কারাগার শুধু অপরাধের শাস্তিবিধান কিংবা জিঘাংসা নিবৃত্তির কেন্দ্র না হয়ে চিন্তার পরিশুদ্ধি ও নৈতিক সংশোধনের কেন্দ্রে পরিণত হওয়া দরকার। সোজা কথায় যা হবে এক ধরনের বিদ্যালয়ের শামিল। কারাগারের বাসিন্দাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির মধ্যে এটিও একটি। এ জন্য ধর্মীয় অনুশাসন পালনে আগ্রহ সৃষ্টি অন্যতম একটি উপায় হতে পারে। এ ছাড়া কারাগার পরিদর্শনে আসা মানুষগুলো যেন এখান থেকে ভালো কিছু নিয়ে যেতে পারেন, পুরো পরিকল্পনাটি সেভাবেই সাজানো দরকার।
য় লেখক : প্রাবন্ধিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।