পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
মানুষ দেখলেই আঁতকে ওঠে শিশুটি। শুরু করে চিৎকার। ঘুমের ঘোরেও সে কেঁদে উঠছে। দিনাজপুরের পার্বতীপুরের পাশবিক নির্যাতনের শিকার পাঁচ বছরের শিশু সম্পর্কে একথা বলেন চিকিৎসকরা। শিশুটি চিকিৎসা চলছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে। একই ধরনের ঘটনায় সেখানে চিকিৎসাধীন অনেক শিশুরই একই পরিস্থিতি বলে উল্লেখ করেছেন তাদের স্বজনরা।
অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, পার্বতীপুরে পাঁচ বছরের শিশুর ওপর পৈশাচিকতা যে কোন ধরনের বর্বরতাকেও হার মানায়। ওই ঘটনায় নির্বাক পুরো জাতি। তার পরেও থেমে নেই একই ধরনের নির্মমতা। দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ধর্ষণের ঘটনা। থেমে নেই গণধর্ষণ। রেহাই পাচ্ছে না অবুঝ শিশুও। তাদের মতে, নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেই একের পর অবুঝ শিশুদের ওপর পাশবিক নির্যাতন ও নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে।
একটি বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থার জরীপমতে, গত দুই বছরে নারী ও শিশুর প্রতিসহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে ৫ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রয়োজনে নতুনভাবে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে শিশু ধর্ষকদের শাস্তির আওতায় আনা জরুরী। জাতীয় পর্যায়ে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন।
অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, ২০১৫ সালের তুলনায় চলতি বছর নারী-শিশু নির্যাতন, অপহরণ, ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য মতে, গত ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত দেশে ধর্ষিত হয়েছে ৪৫৩ জন। সেপ্টেম্বরেও ধর্ষিত হয়েছে কমপক্ষে ১০ জন। ধর্ষণের পর ৩৩ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষিত ৪৫০ নারীর মধ্যে ৭৯ জনের বয়স ৭ থেকে ১২ বছর। আর ৩৫ জনের বয়স ৬ বছরের নিচে।
শিশু ধর্ষণের ঘটনা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর মাসুদা এম রশীদ চৌধুরী বলেন, আমাদের বিবেক মরে গেছে। দিনে দিনে মানুষ কেমন যেন হিংস্র হয়ে উঠেছে। সমাজ থেকে নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধ উঠে গেছে। ধর্মীয় এবং পারিবারিক শিক্ষা ও শাসনের অনুপস্থিতির কারণে সকল ধরনের অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে। পরিবার থেকেই ধর্মীয় ও নৈতিকতার শিক্ষা দিতে হবে। তার মতে, শিশুদের ধর্ষণের ক্ষেত্রে কুরুচি সম্পন্ন পুরুষরাই দায়ী। সবার আগে মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। আইনের প্রয়োগকে আরো বেগবান করতে হবে। প্রয়োজনে নতুনভাবে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে শিশু ধর্ষকদের শাস্তির আনার পরামর্শ দেন তিনি। এ ধরনের মামলার বিচারকার্যও দ্রুত শেষ করতে হবে। একমাত্র কঠোর শাস্তিই পারে ধর্ষণ ঠেকাতে।
গত ১৮ অক্টোবর দিনাজপুরের পার্বতীপুরে পাঁচ বছর বয়সী এক শিশু নিখোঁজ হয়। পর দিন অচেতন অবস্থায় তাকে পাওয়া যায় বাড়ির পাশের হলুদ ক্ষেতে। অবুঝ শিশুটি যাকে কাকু বলে জানতো সেই নরপিচাস সাইফুল শিশুটির ওপর হায়েনার মতো ঝাপিয়ে পড়ে। সঙ্গে তার সহযোগী। শিশুটিকে বাঁচিয়ে রাখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গঠিত বোর্ডের সদস্যরা বলেছেন, তাদের চিকিৎসা জীবনে এমন নিষ্ঠুরতা দেখেননি। পাষ-ের পাশবিকতায় ভেঙ্গে গেছে শিশুটির প্রজনন হাঁড়। ব্লেড দিয়ে কাটা হয়েছে বিশেষ অঙ্গ। রয়েছে অসংখ্য সিগারেটের ছ্যাকা। শিশুটি এখনও মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। শিশুটির চিকিৎসা বোর্ডের সদস্যরা বলছেন, নির্মম নির্যাতনের শিকার শিশুটি শুধু শারীরিকভাবেই নয় মানসিকভাবেও বড় ধরনের আঘাত (ট্রমা) পেয়েছে। কাউকে দেখলেই শিশুটি ভয়ে কেঁপে উঠে। তাই তার বেডের মাঝে পর্দা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
ওই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত ১৯ নভেম্বর খোদ রাজধানীর লালবাগের একটি বাসায় ছয় বছরের শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। কিস্তির টাকা তুলতে আসা ফুয়াদ নামে এক এনজিও কর্মী দরিদ্র পরিবারের এ শিশুটিকে একা পেয়ে ধর্ষণ করে। গত রোববার রাজধানীর পশ্চিম আগারগাঁও এলাকায় খেলতে যাওয়া ৫ বছরের শিশুকে নিজের ঘরে নিয়ে ধর্ষণ করে পঞ্চাশোর্ধ প্রতিবেশি দেলোয়ার হোসেন। একই দিনে বংশালে এবং মুগদায় ৪ বছরের এক শিশুর ওপর নিষ্ঠুরতা চালায় বখাটেরা।
গত ২০ সেপ্টেম্বর মিরপুরের পাইকপাড়ায় ৬ বছরের এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। রক্তাক্ত অবস্থায় শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত শিশুটির প্রতিবেশি বখাটে সুমন। যাকে ওই শিশুটি ভাইয়া বলে জানতো। এ সব ঘটনায় ভুক্তভোগীরা এখনো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাদের বেঁচে থাকা শঙ্কা কেটে গেলেও আতঙ্ক কাটছে না।
গত মাসে বাড্ডায় এক গারো তরুণীকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ করেছে এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী রাফসান হোসেন রুবেল ও তার সহযোগিরা। র্যাব রুবেলকে গ্রেফতার করে থানা পুলিশে দেয়। আদালত থেকে হাতকড়া নিয়ে পালিয়ে যায় সে। দু’দিন পরে পুলিশ ফের তাকে গ্রেফতার করে।
গত ২০ নভেম্বর সাভারে বিজয় মেলায় বেড়াতে গিয়ে গণধর্ষণের শিকার হয় দুই স্কুলছাত্রী। এ ঘটনায় মঙ্গলবার সকালে ধামরাই থানায় মামলা দায়েরের পর চার বখাটেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ১৮ নভেম্বর ঢাকার কাফরুলে স্ত্রীর গোপনাঙ্গে এসিড ঢেলে দেয় পাষ- স্বামী।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্য মতে, ২০১৩ এবং ২০১৪ সালের তুলনায় গত দুই বছরে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে ৫ শতাংশ। সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় বেডেছে খুন, ধর্ষণ এবং ধর্ষণ পরবর্তী হত্যাকা-, নারীর অসতর্কতা কাজে লাগিয়ে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমেও নারীদের হয়রানি করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি-অক্টোবর পর্যন্ত মোট ৪১৪৪ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮৭৫ জন। গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৩৪ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩১ জনকে। এছাড়া, ১৪০ জন নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। উত্ত্যক্ত ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ৩৩১ জন। তার মধ্যে উত্ত্যক্ত করা হয় ২৪০ জনকে। উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করেন ৮ জন। প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১২ জন। এছাড়া যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৭১ জন নারী।
পুলিশ সদর দপ্তরসূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে দেশে নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ২১ হাজার ২২০টি। অন্যদিকে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনায় মামলার সংখ্যা ১৫ হাজার ৯৮৭টি। ডিএমপি সূত্র জানায়, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজধানীতে নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১ হাজার ৩৯৫টি। জিডি হয়েছে ৭শ’র বেশি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নারী নির্যাতনের ঘটনা এমনভাবে সাজান যে, সেটা আদালতে গেলেও আরেকটা সমস্যার জন্ম দেয়। তাই আইনের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার সঙ্গে রাজনৈতিক অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের দেশে যে হারে নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে সেটা আমাদের সংক্ষুব্ধ করে। অপরাধীদের পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি নতুন নতুন ঘটনার জন্ম দিচ্ছে।
সুষ্ঠু বিচার না হওয়ায় দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা প্রতিনিয়তই বাড়ছে বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্রের সহ-সাধারণ সম্পাদক মনি দিপা ভট্টাচার্য। তার মতে শিশু থেকে বয়স্ক নারী কেউ আজ নিরাপদ নয়। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে আমাদের সবাইকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। সবার আগে আমাদের নিজের পরিবার থেকে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। কারণ নিজের পরিবারও এখন অনেক শিশুদের জন্য নিরাপদ নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিচারে দীর্ঘসূত্রতা, রাজনৈতিক প্রভাব ও নেতিবাচক সামাজিক মনোভাবের কারণে একের পর এক নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এ ধরনের নির্যাতন ও অপরাধ দূর করতে পরিবার থেকে শুরু করে কমিউনিটি ও জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।