Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জ্বালানির দাম ফের বাড়ছে

সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লোডশেডিং : ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী লোডশেডিংয়ে আলোকসজ্জায় নিষেধাজ্ঞা জারি ডিসি-ইউএনওদের নির্দেশনার চিঠি সন্ধ্যা ৭টার পর বিয়ের অনুষ্ঠান বন্ধ

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ৮ জুলাই, ২০২২, ১২:০১ এএম

করোনা মহামারির সময়ের মতো আবার চালু হতে পারে হোম অফিস (বাসায় থেকে অফিস করা)। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের (এসি) ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনা হতে পারে। বন্ধ করা হচ্ছে আলোকসজ্জা। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে অফিস-আদালতের সময় হতে পারে ৯টা থেকে ৩টা। অবৈধ গ্যাস-সংযোগের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে যাচ্ছে সরকার। সন্ধ্যার পর বিয়ের অনুষ্ঠান বন্ধ, যাদের বিল বকেয়া আছে, সে টাকা আদায়ে কঠোর হবে। সারাদেশের চলমান লোডশেডিং নিয়ন্ত্রণে বিদ্যুতের চাহিদা কমাতে চায় সরকার আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। অনুষ্ঠান উপলক্ষে কোনো স্থাপনায় আলোকসজ্জা না করার নির্দেশ দিয়ে তা বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্টদের চিঠি দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। গতকাল বৃহস্পতিবার এ চিঠি দেয়া হয়েছে। সব মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, সচিব, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার এবং বিভাগীয় কমিশনারদের এই নির্দেশনার চিঠি দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে বিশ্ববাজারে তেল ও গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের জ্বালানি পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরেছেন জ্বালানি ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোরও ইঙ্গিত দিয়েছেন। তবে বর্তমান সঙ্কট সাময়িক বলে মন্তব্য করে তিনি গ্যাস ব্যবহারে মিতব্যয়ী হতে জনগণের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন।
সম্প্রতি চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হওয়ায় গ্রাম-শহরে সবখানেই লোডশেডিংয়ের তীব্রতা বেড়ে নাকাল মানুষ। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার লোডশেডিং হওয়ার নানা যৌক্তিকতা তুলে ধরা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বলা হচ্ছে, আমদানিনির্ভর জ্বালানি খাত হওয়ায় সঙ্কট প্রকট হয়েছে। বিশেষ করে মহামারি করোনার ধকল শেষ না হতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বে জ্বালানির বাজার অস্থির করে তুলছে। স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে প্রায় তিন গুণ দাম বেড়েছে আমদানিনির্ভর জ্বালানি তেল ও এলএনজি গ্যাসের। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার সাশ্রয়ী হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গ্যাস ও বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিতরণ সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী এসব কথা বলেন। উপদেষ্টা বলেন, লোডশেডিং স্বাভাবিক হতে আরো আড়াই মাস সময় লাগবে। সেপ্টেম্বর নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে। ওই সময় বেশ কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হবে। কোথায় কত ঘণ্টা লোডশেডিং করা হবে, সেটি আগাম জানানোর যে দাবি উঠেছে, তা বাস্তবায়ন কঠিন।
সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টার দুই পাশে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন ও বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হাবিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। পর্যালোচনা বৈঠকে পেট্রোবাংলা, বাপেক্স, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে সারাদেশে অনুষ্ঠান উপলক্ষে কোনো স্থাপনায় আলোকসজ্জা না করার নির্দেশ দিয়ে তা বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্টদের চিঠি দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। নির্দেশনায় বলা হয়, বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত সারাদেশে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, কমিউনিটি সেন্টার, শপিংমল, দোকানপাট, অফিস ও বাসাবাড়িতে আলোকসজ্জা না করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শক, প্রধান তথ্য অফিসার, সব জেলা প্রশাসক (ডিসি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) কাছেও নির্দেশনার চিঠির অনুলিপি দেয়া হয়েছে।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, এ সঙ্কটের সমাধান চটজলদি হবে না। কেবল আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম কমলে এবং জ্বালানি তেলের দাম কমলে এবং এগুলো দেশের বাজারে সরবরাহ পর্যাপ্ত হলেই বিদ্যুৎ উৎপাদন নিরবচ্ছিন্ন হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় স্পট মার্কেট (খোলাবাজার) থেকে এলএনজি কিনছে না বাংলাদেশ। জুন মাসে স্পট মার্কেট থেকে তিনটি এলএনজি কার্গো কেনা হয়েছিল। জুলাই মাসে কোনো কার্গো কেনার উদ্যোগ নেই। বিশ্বব্যাপী চলমান জ্বালানির ঊর্ধ্বমুখী বাজারে ব্যয় নিয়ন্ত্রণে সরকারের সাশ্রয়ী নীতির কারণে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ রয়েছে। গ্যাসের অভাবে নানামুখী সঙ্কটে পড়েছে গ্রাহক। নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরসহ শিল্পাঞ্চলগুলোতে ঠিকমতো গ্যাসের সরবরাহ না থাকার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় আবাসিক গ্রাহকরাও গ্যাস পাচ্ছে না নিয়মিত।
তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, জ্বালানি সাশ্রয়ে আজকের বৈঠকে বেশ কিছু পরামর্শ উঠে এসেছে। এসব পরামর্শ আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরব। এর মধ্যে রয়েছে সরকারি অফিসের সময় সকাল নয়টা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত করা, বিয়ের অনুষ্ঠান সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে শেষ করা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের (এসি) তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার ওপরে রাখা। আলোকসজ্জা করা যাবে না। রাত আটটার মধ্যে শপিংমল বন্ধ করা। ঘরে বসে কাজ করা যায় কি না, সে বিষয়টিও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। মসজিদ-মন্দিরে বিদ্যুৎ ও এসি ব্যবহার কমিয়ে আনা। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারলে বিদ্যুতের চাহিদা ৫০০ মেগাওয়াট কমে আসবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয় হবে। লোডশেডিং হবে না। সেপ্টেম্বরের মধ্যে কিভাবে জ্বালানি –সঙ্কট কমে আসবে, তার ব্যাখ্যা দিয়ে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, ওই সময়ের মধ্যে আমদানি থেকে কয়লাভিত্তিক ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট এবং পায়রা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট থেকে ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। তখন লোডশেডিং কমে আসবে।
জ্বালানি খাতে সরকারের আমদানিনির্ভরতার কারণেই চলমান সঙ্কট কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, যারা এ কথা বলছেন, তারা ঠিক বলছেন না। কারণ, স্থানীয়ভাবে গ্যাস উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে যখন ক্ষমতায় আসে, তখন গ্যাসের দৈনিক উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৮০০ এমএমসি। সেটি ১ হাজার ৬৪৪ এমএমসি বেড়েছে। গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে আরো নতুন কার্যক্রম নেয়া হচ্ছে। পেট্রোবাংলা গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেন, জাপানের মতো দেশে লোডশেডিং হচ্ছে। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর সব উন্নত দেশে জ্বালানি সয্কটের অভিঘাত পড়েছে। তাদের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশ বেশ ভালো অবস্থানে আছে। তবু আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই। কোন এলাকায় কত ঘণ্টা লোডশেডিং হবে, তা আগাম জানানো যাবে কি না, সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, কোন এলাকায় কত ঘণ্টা লোডশেডিং করা হবে, তার জন্য ডিপিডিসি একটি অ্যাপস তৈরি করছে। এটা এক সপ্তাহের মধ্যে চূড়ান্ত হবে। অ্যাপসটি হয়ে গেলে কর্মকর্তারা সেখানে ঢুকে জানতে পারবেন। তবে সাধারণ মানুষকে তাৎক্ষণিক এ তথ্য জানানো কঠিন হবে। জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, বিভিন্ন স্থানে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার অনেকের বকেয়া বিল পড়ে আছে। অবৈধ গ্যাস সংযোগের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে যাচ্ছে সরকার। যাদের বিল বকেয়া আছে, সে টাকা আদায়ে কঠোর হবে সরকার।
জ্বালানি সাশ্রয় করলে চাহিদা কত কমে আসবে এমন প্রশ্নের জবাবে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জাতীয় গ্রিডে ১৪ হাজার মেগাওয়াট চাহিদা থাকতে পারে। অফিস-আদালতের সময় কমিয়ে আনলে, আলোকসজ্জা বন্ধ হলে চাহিদা কমে ১২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটে নেমে আসবে। সবাই সাশ্রয়ী হলে লোডশেডিং কমে আসবে। দোকানপাটগুলো নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বন্ধ করা, অফিসের সময় কমিয়ে আনা যায় কি না (৯টা-৩টা), সেই চিন্তা করা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতিদিন অফিসে না গিয়ে ওয়ার্ক ফ্রম হোমের কথাও ভাবা হচ্ছে।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ইঙ্গিত দিলেন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল বৃহস্পতিবার এক অডিও বার্তায় বলেন, আমরা ছয়–-সাত মাস ধরে তেলের মূল্য ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করছি। যে তেল আমরা ৭০ থেকে ৭১ ডলারে কিনতাম, এখন তা ১৭১ ডলার হয়ে গেছে। এবং সেটা সব সময় বাড়তির দিকেই যাচ্ছে। আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি যে, আমরা তেলের প্রাইসটাকে অ্যাডজাস্টমেন্টে যাব। কিন্তু আমাদের নিজস্ব অর্থে আমরা এই ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু তারপরও আমাদের মনে হয়, আমাদের একটা সময়ে প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্টে (মূল্য সমন্বয়) যেতে হবে। প্রতিমন্ত্রী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি তুলে ধরেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জ্বালানির দাম ফের বাড়ছে
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ