Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাল নোট আতঙ্ক

সারাদেশে সক্রিয় ২০০ কারবারি তালিকায় মাদক কারবারি-রাজনৈতিক নেতা-শিক্ষার্থী : কারাগার থেকেই জামিনে বেরিয়ে একই অপরাধে জড়াচ্ছে

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ৫ জুলাই, ২০২২, ১২:০২ এএম

পবিত্র ঈদুল ফিতরের মাত্র দুই মাসের মাথায় ঈদুল আযহাকে সামনে রেখে বাজারে ছাড়া হচ্ছে কোটি কোটি টাকার জাল নোট। সেই সঙ্গে আরো নোট ছাড়তে রাজধানীসহ সারাদেশে সক্রিয় রয়েছে দুই শতাধিক চক্র। যারা ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে এক হাজার টাকার নোট জাল করে বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে। গ্রেফতারের কিছু দিন পর জামিনে বেরিয়ে চক্রের সদস্যরা ফের জাল নোট বাজারে ছড়ানোর জন্য তৎপর হয়ে উঠে। ইদানিং চক্রটি জাল নোটের কারবারে অনলাইন প্ল্যাটফরম ব্যবহার করছে। জাল নোট প্রতিরোধ বা প্রতিকারে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরো সক্রিয় ভূমিকা রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা।

অপরাধ তদন্তে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাল নোটের বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কার্যক্রম এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনিটরিং শক্তিশালী করা প্রয়োজন। জড়িতদের আরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে আইন সংশোধন করা।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, রাজধানীসহ সারাদেশে কোরবানির পশুহাট জমতে শুরু করেছে। শত শত কোটি টাকার কেনাবেচা হবে। এই সুযোগে সক্রিয় হয়ে উঠেছে একশ্রেণীর প্রতারক চক্র। জালনোট ছড়িয়ে সক্রিয় হয়ে উঠছে বেশকিছু চক্রের সদস্যরা। এদের প্রধান টার্গেট পশুহাটের ব্যাপারিরা। দেশব্যাপী এই চক্রের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। জালনোট বাজারে ছড়িয়ে দিতে বেছে নিচ্ছে নানা কৌশল। তবে এসব চক্রের অপতৎপরতা নিস্ক্রিয় করতে ইতোমধ্যেই গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করেছে র‌্যাবের বিভিন্ন ইউনিট।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে জাল টাকার প্রায় দেড় হাজার কারবারি চক্রের বিরুদ্ধে মামলা বিচারাধানীন। গত দশ বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে পাঁচ হাজার দেশি-বিদেশী জাল টাকার কারবারি চক্রের সদস্যকে। এর মধ্যে অনেকেই একাধিকবার গ্রেফতার হওয়ার পর জামিনে বের হয়ে আবারও জাল নোটের কারবারে সক্রিয় হওয়ার নজির অনেক। গ্রেফতারকৃত জাল টাকার কারবারির মধ্যে নারী সদস্যও আছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হাফিজ আক্তার জানান, প্রতি বছরই ঈদকে কেন্দ্র করে সারাদেশেই জালনোট কারবারি চক্রের সদস্যরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। আর তাদের টার্গেট থাকে পশুহাটে আসা ব্যাপারিরা। বর্তমানে নজরদারির পাশাপাশি চক্রের সদস্যদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। বেশকিছু চক্রের মুভমেন্ট পাওয়া যাচ্ছে। কিছু কিছু ঘটনা ঢাকার বাইরে ঘটছে। ঢাকায়ও তারা তৎপরতা চালানোর চেষ্টা করবে। তবে পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, বছর জুড়েই জাল নোট তৈরির কারবারীরা সক্রিয় থাকলেও কোরবানির পশুহাট ঘিরে তাদের তৎপরতা বেড়ে যায়। গত এক মাসে র‌্যাব-পুলিশের হাতে জাল নোট চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্য গ্রেফতারের পর এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। বাসা ভাড়া নিয়ে গোপনে জাল নোট তৈরির সিন্ডিকেটে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, ইয়াবাসহ মাদক কারবারি, হাসপাতালের দালাল, চোরাকারবারীসহ বিভিন্ন শ্রেণির লোকদের নাম এসেছে। মাদক লেনদেন, চোরাই পণ্যের কারবার, সোনা বেচাকেনাসহ বিভিন্ন অবৈধ লেনদেনে জাল নোট চালিয়ে দিচ্ছে ওরা। জাল টাকার সাথে জড়িতদের গ্রেফতার করা হলেও তারা বার বার জামিনে বেরিয়ে আসছে।
সূত্র জানায়, ঢাকার পর চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট, খুলনা ও রংপুরে জাল টাকার কারবারীরা বেশি সক্রিয়। তারা বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে আস্তানা গেড়ে অপরাধমূলক কর্মকান্ড চালাচ্ছে। মাস খানেক আগে জাল টাকার কারবারীদের নিয়ে একটি নতুন তালিকা করা হয়। তালিকায় অন্তত ২০০ জনের নাম এসেছে। তারমধ্যে কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার নামও এসেছে। তদন্তের স্বার্থে নামগুলো গোপন রাখা হচ্ছে। কারবারীদের নিয়ন্ত্রণ করতে রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলার পুলিশ সুপারদের বিশেষ বার্তা দেয়া হয়েছে পুলিশ সদর দফতর থেকে।
জাল টাকা নিয়ে দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন সিআইডির একজন সাবেক কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, ভিড়ের মধ্যে মালামাল কিনতে গিয়ে মূলত ওইসব জাল টাকা ব্যবহার করা হয়। জাল টাকার সাথে আসল টাকার পার্থক্য খুবই সামান্য। চক্রটি বিভিন্ন শপিংমলে জিনিসপত্র কেনার সময় ওইসব জাল টাকা ব্যবহার করত। যাতে ভিড়ের মধ্যে বিক্রেতারা টাকা আসল না নকল তা চেক করার সুযোগ না পায়। এই সুযোগই চক্রটি কাজে লাগাতো। আসল ৩০ হাজার টাকায় এক লাখ জাল টাকা বিক্রি করা হয়।
তিনি আরো বলেন, এ কারবারে জড়িতদের গ্রেফতার করা হলেও প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৮০ জনই জামিনে বেরিয়ে ফের জাল নোটের ব্যবসায় জড়িত হয়। ঈদ এলেই তাদের সিন্ডিকেট সারাদেশে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এরা বাসা ভাড়া নিয়ে জাল নোটের ব্যবসা করে। ধরা পড়ার ভয়ে তারা কয়েক মাস পর বাসা বদলে অন্য এলাকায় চলে যায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জাল নোটা চক্রের সদস্যরা সম্প্রতি ফেসবুকে নানা ধরনের জাল নোট সংক্রান্ত পেজ খুলেছে। সেখানে তারা বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। যোগাযোগের জন্য ইনবক্স এবং মোবাইল নম্বরও (হোয়াটসঅ্যাপ) দিচ্ছে। কারবারিরা বলছে, নির্দিষ্ট জায়গায় গেলেই পাবেন জাল টাকা। তবে সাবধান পুলিশকে জানালে আপনি নিজেই ঝামেলায় পড়বেন।
গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার মনিটরিং টিমের এক কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, বর্তমানে অপরাধীরা নানা ধরনের অনলাইন প্ল্যাটফরম ব্যবহার করছে। এতে পিছিয়ে নেই জাল নোট কারবারিরা। বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আগে দ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাল নোট আতঙ্ক

৫ জুলাই, ২০২২
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ