Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সন্তান কেন ঘাতক হয়

আল ফাতাহ মামুন | প্রকাশের সময় : ২৬ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

গত ২০১৩ সালে ঘুমন্ত বাবা-মাকে নৃসংশভাবে খুন করে তাদেরই সন্তান ঐশী। দেশজুড়ে হৈচৈ ফেলে দেয় এ হত্যাকা-। সংবাদ মাধ্যমগুলোর প্রধান শিরোনাম ছিল ‘সন্তানের হাতে বাবা-মা খুন’। সম্পাদকীয় এবং টকশোর আলোচ্য বিষয়ও ছিল এটি। সাধারণ মানুষের মুখে ছিল একই প্রশ্ন- সন্তান কীভাবে পিতা-মাতাকে খুন করে? এও কী সম্ভব? দেশজুড়ে আলোচিত ওই হত্যাকা-ের পর অভিশপ্ত অনেক সন্তানই নিজ পিতামাতাকে খুন করেছে। তবে এ বছরই এমন ঘৃণ্যতা মাথাচারা দিয়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। আর কোরবানির ঈদের পর যেন বাবা কিংবা মাকে হত্যার ঘটনা আরও বেড়ে গেছে। ঈদের একদিন পর  ১৫ সেপ্টেম্বর ফরিদগঞ্জে মুগ্ধ নামের এক সন্তান নতুন মোটরসাইকেল থাকা সত্ত্বেও আরেকটি মোটরসাইকেলের জন্য বাবা-মার গায়ে আগুন দেয়। ১৬ সেপ্টেম্বর হাটহাজারীতে ঘাতক সাঈফুল ইসলামের কোদালের আঘাতে খুন হয় বাবা। ১৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে মাকে খুন করে ছেলে। এ বছরের এপ্রিল মাসেও সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতাকে হত্যার মতো তিনটি ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটে। ১৭ এপ্রিল মাত্র ৫০০ টাকার জন্য কেরানীগঞ্জের মুনাজাত উদ্দীন নিহত হন ছোট ছেলে তমিজ উদ্দীনের হাতে। বারবার ঐশীর ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়া সত্ত্বেও আমাদের টকশো এবং মিডিয়ায় এ নিয়ে এখন আর আলোচনা-সমালোচানা তেমন একটা হচ্ছে না। সাধারণ মানুষের মাঝেও নেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। হয়ত তারা ‘নিজ সন্তানের হাতে খুন হওয়া’র চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিয়ে ব্যস্ত অথবা সন্তানের হাতে খুন হওয়ার ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ। আমাদের ব্যস্ততা ও ব্যর্থতার ঘোর একদিন ভাঙবেই। কিন্তু ততদিনে খুব দেরি হয়ে যাবে। আদরের সন্তান মৃত্যুর কারণ হওয়ার আগেই সতর্ক হতে হবে আপনাকে আমাকে।
সন্তান প্রতিপালনে আমরা যেসব ভুল করছি এবং আমাদের দৈনিন্দন আচরণের ‘বর্জ্য’ থেকে সন্তান যা শিখছে তাই সন্তানকে তিলে তিলে ঘাতকে পরিণত করছে। ‘সন্তান কেন ঘাতক হয়’- এ প্রশ্নের উত্তরে মনোবিদরা বলেন, সন্তান প্রতিপালনে অভিভাবকদের কিছু ত্রুটি রয়েছে, যা পরবর্তীতে সন্তানকে ঘাতক বানিয়ে ফেলছে। আমরা সন্তানের চাহিদাকে সর্ব্বোচ্চ গুরুত্ব দিই। সে যা চায় বা তার যা প্রয়োজন অথবা প্রয়োজন নয় এমন অনেক চাওয়াই খুব সহজে পূরণ করছি। ফলে সে সামাজিক নিয়মনীতি, শৃঙ্খলা ও বিধিনিষেধ উপলব্ধি করতে পারছে না। সে শুধু বোঝে- আমার এটা প্রয়োজন- আমাকে দিতে হবে। এক সময় যখন সে চাওয়া মাত্রই পায় না, তখনই সে বাবা-মাকে খুন করে বসে। আপনি দেখবেন, অধিকাংশ শিশুর নিজস্ব ট্যাব ও মোবাইল আছে। বাবা-মা তাদেরকে গেম খেলার জন্য এটি হাতে তুলে দিচ্ছে। কিন্তু এই বয়সে কি তার এটি প্রয়োজন? গেমসে সে খুব সহজে কাউকে মেরে ফেলছে এবং জয়ের স্বাদ অনুভব করছে। এ থেকেও শিশু মনে জয়ের জন্য খুনের মানসিকতা গড়ে ওঠে। সন্তানের প্রতি অভিভাবকের অতি¯েœহ এবং প্রশ্রয় পাশাপাশি শিশুর বিকাশ সম্পর্কে স্পষ্ট জ্ঞান না থাকার কারণেই আজকের এ ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
সন্তান ঘাতক হওয়ার পেছনে বৈশ্বায়নের প্রভাবও অনেকাংশে দায়ী। অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৈশ্বায়নের প্রভাব এবং অপসংস্কৃতির কারণেই সন্তান কর্তৃক বাবা-মাকে হত্যার মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে বারবার। বাঙ্গালী মুসলিম সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো পিতামাতা ও বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করা। আমি যখন আমার বাবামাকে শ্রদ্ধা করব, ভালোবাসবো, কোন কাজের জন্য অনুমতি চাইব, নিজে না খেয়ে তাদেরকে খাওয়াবো, তাদের পায়ে হাত রেখে সালাম করব; তখন আমার সন্তান নিজ থেকেই এসবের চর্চা শুরু করবে। কিন্তু আজকে আমরা বাবা-মাকে আলাদা করে দিচ্ছি, ভাই-বোনদের ভালোবাসছি না, কারো বিপদে পাশে দাঁড়াচ্ছি না, স্ত্রী ও সন্তানদের সর্ব্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। এর অনিবার্য ফল হলো- আমাদের সন্তানও আমাদের গুরুত্ব দেবে না। আমরা সন্তানদের সঙ্গে বসে বিভিন্ন সিরিয়াল ও চলচ্চিত্র দেখছি। যেখানে অশ্লীলতা, অনৈতিকতা ও স্বার্থপরতা হাতে-কলমে শেখানো হয়। শেখানো হয় কীভাবে বড়দের অসম্মান করতে হয়, স্বার্থে আঘাত লাগলে কীভাবে বাধাদানকারীকে সহজেই খুন করতে হয়। বাস্তব জীবনে সন্তান যখন ওই সমস্যার সম্মুখীন হয় আর বাবা-মা তার প্রতিবাদ করে তখনই সে ঘাতক হয়ে যায়।
অভিভাবকদের মনে রাখতে হবে-সন্তানের সঙ্গে পিতামাতার সম্পর্ক প্রেম-ভালোবাসা ও আবেগের। এই বিষয়গুলোর ঘাটতি হলেই সম্পর্কের মাঝে দ্বান্দ্বিকতা প্রকট হয়ে দেখা দেয়। এক পর্যায়ে সন্তান পিতামাকে খুনও করে ফেলে। তাই কোনভাবেই যেন পারস্পকির সম্পর্কে ঘাটতি সৃষ্টি না হয় এ বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে অভিভাকদের। দুঃখজনক হলেও সত্য! এখনকার অভিভাকরা এতই ব্যস্ত যে, সন্তানকে প্রাপ্য সময়টুকুও দিচ্ছে না তারা। সন্তান কোথায় যায়? কী করে? কাদের সঙ্গে মেশে? এসব বিষয়ও জানেন না অনেক অভিভাবক। জানার চেষ্টাও করেন না তারা। সন্তান যখন লাগামহীন জীবনের শেষ পর্যায়ে উপনীত হয়, তখন ঘুম ভাঙে ব্যস্ত অভিভাবকের। ঘুম আর ব্যস্ততার ঘোর কাটিয়ে আফসোসের ‘হাই’ তুলতে তুলতে বলেন, ‘যে সন্তানের জন্য জীবন শেষ করলাম সেই সন্তানই এখন বখে গেছে।’ অনেক অভিভাবকের তো আফসোস করার সৌভাগ্যও (!) হয় না। এর আগেই তারা খবরের ‘শিরোনামে’ পরিণত হন। অবাক করা ব্যাপার হলো! এসব ‘শিরোনাম’ অন্যসব অভিভাবকদের চিন্তা জগতে আলোড়ন সৃষ্টি তো দূরের কথা কপালে ভাঁজও ফেলছে না। তাই তো ‘ঘাতক সন্তান’ জাতীয় শিরোনাম দিন দিন বেড়েই চলছে।  
‘বখে যাওয়া সন্তানকে সুপথে ফেরাতে হলে সর্ব প্রথম ধর্মীয় এবং নৈতিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। শৈশব থেকেই সন্তানকে মানব প্রেম এবং আত্মজ্ঞান শেখাতে হবে। নিজেকে চিনতে-জানতে এবং ভালোবাসতে পারলেই তার প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। অভিভাবক যদি সন্তানকে এসব শেখাতে না পারে তবে সে বখে যেতে বাধ্য। সুন্দরভাবে বাঁচা এবং জীবনের স্বার্থকতা কীসেÑ এ প্রশ্নের উত্তর জানে না অনেক সন্তানই। ফলে সে বিলাসবহুল ও অপরাধের জীবনকেই সুন্দর জীবন ভাবতে থাকে। তাই এ বিষয়টিও সন্তানকে ছোট থেকেই হাতে-কলমে শেখাতে-জানাতে ও বোঝাতে হবে। সর্বোপরি পারিবারিক সুদৃঢ় বন্ধনই সন্তানকে অপরাধ প্রবণ হতে ফিরিয়ে রাখতে পারে।’ উপরের কথাগুলো একজন সমাজ বিজ্ঞানীর। শেষ করছি এ প্রত্যাশায়- ‘আর কোন সন্তানই যেন নাড়িছেড়া মা আর রক্ত পানি করা বাবার ঘাতকে পরিণত না হয়’।
লেখক : শিক্ষার্থী, ডিপ্লোমা ইন এ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ধষভধঃধযসধসঁহ@মসধরষ.পড়স



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ