Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চাল নিয়ে গোলকধাঁধা

খাদ্য মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ খাদ্য ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করতে সংসদে আইন পাস করবো : খাদ্যমন্ত্রী

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৮ জুন, ২০২২, ১২:০০ এএম

‘দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ’ দাবি করা হলেও প্রতি বছর চাল-গমসহ খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হয়। এখন চলছে চালের ভরা মৌসুম; অথচ হু হু করে বাড়ছে চালের দাম। মিলার, আড়তদার, পাইকারি ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এবার সেই সিন্ডিকেটকে ডিঙিয়ে ধান-চালের বাজারে করপোরেট হাউজ ঢুকে পড়েছে। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার নিজেই বলেছেন, বড় বড় ব্যবসায়ীরা মোটা চাল মেশিনে ছেঁটে প্যাকেটজাত করে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি করে বিক্রি করছে। মে মাসে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি দাবি করেছেন, ‘দেশে চালের কোনো সঙ্কট হবে না’। মন্ত্রীদের বক্তব্যে পরিষ্কার ‘সয়াবিন তেলে’ সাফল্যের পর ধান-চালের বাজারে করপোরেট হাউজের ব্যবসায়ীর চোখ পড়েছে। আগে মিলাররা চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করলেও এখন মূলত তারাই কলকাঠি নাড়ছে। সেই সঙ্গে অতিমুনাফার লোভে মিলার ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা কৃষকের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে গোডাউনে মজুত করছেন। ভরা মৌসুমে চালের দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বাজার স্থিতিশীল রাখতে বেসরকারিভাবে ফের চাল আমদানির অনুমতি দিচ্ছে সরকার। গত সোমবার খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের সভাপতিত্বে খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির (এফপিএমসি) সভায় এ সিদ্ধান্ত হয় বলে মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। প্রশ্ন হচ্ছে বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি হলেই কি চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে? নাকি মুনাফাখোরদের নতুন করে ফায়দা লোটার পথ করে দেয়া হচ্ছে? আর সরকার কয়েক বছর ধরে যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণের ঢোল বাজাচ্ছে সেটা কি শুধুই প্রচারণা?

সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ পরিবেশিত তথ্য অনুসারে চলতি অর্থবছরে প্রায় ৪০০ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে। ২০২০-২১ সালে উৎপাদিত হয়েছে ৩৮৬ লাখ টন। এর আগের বছর উৎপাদিত হয়েছিল ৩৬৬ লাখ টন। প্রশ্ন হচ্ছে দেশের চাহিদা মেটাতে কত লাখ মেট্রিক টন চালের প্রয়োজন পড়ে? বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বিভাগের হিসাব অনুসারে একজন মানুষ গড়ে ১৫২ কেজি চালের ভাত খান। বর্তমানে দেশে ১৭ কোটির কিছু বেশি মানুষ। তাতে বার্ষিক খাদ্যচাহিদা দাঁড়ায় ২ কোটি ৫৮ লাখ মেট্রিক টন চাল। এর সঙ্গে বীজ ও অপচয় এবং পশুখাদ্য বাবদ ১৫ শতাংশ যোগ করে মোট চালের প্রয়োজন দাঁড়ায় ২ কোটি ৯৬ লাখ টন বা প্রায় ৩ কোটি টন। দৈনিক চালের চাহিদা আরো বেশি বিবেচনায় নিয়ে মাথাপিছু দৈনিক আধা কেজি বা বার্ষিক জনপ্রতি ১৮২.৫০ কেজি হিসেবে চালের চাহিদা দাঁড়ায় ৩ কোটি ১০ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন। বীজ, অপচয় ও পশুখাদ্য হিসেবে আরো ১৫ শতাংশ যোগ করা হলে মোট চাহিদা দাঁড়ায় ৩ কোটি ৫৬ লাখ ৭৮ হাজার মেট্রিক টন। এ পরিমাণ চাল প্রতি বছরই উৎপাদন হচ্ছে। এর পরও বাজারে রয়েছে আমদানিকৃত চাল। তারপরও মূল্য বৃদ্ধির হেতু কী?

সোমবারের চাল আমদানি সংক্রান্ত বৈঠকের পর খাদ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘চাল শুল্কমুক্তভাবে যাতে আনা (আমদানি করা) যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এতে করে কৃষক, বাজার ও সংশ্লিষ্ট অন্যরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটা নিশ্চিত করা হবে।’ ভরা মৌসুমে চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, মিটিংয়ের রেজ্যুলেশনসহ সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর কাছে দ্রুতই পাঠানো হবে। তিনি আবার এনবিআরের কাছে পাঠাবেন। আমরা চাল আমদানি শুল্কমুক্ত করার প্রস্তাব দেবো। তারপর তারা (এনবিআর) যেভাবে করেন। এরপর আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিং (পরীক্ষা-নিরীক্ষা) হয়ে সরকারি আদেশ (জিও) জারি হবে। পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সপ্তাহখানেক লাগতে পারে। আমরা তো আমাদের দিক থেকে তাড়াতাড়ি করার চেষ্টা করব। তবে এটা (চাল আমদানি) সীমিত পরিসরে, সীমিত সময়ের জন্য হবে। আগামী মৌসুমে যাতে কৃষকের ক্ষতি না হয় সেটা বিবেচনা করেই এটা হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গত মওসুমে চাল আমদানির যে অনুমোদন দেয়া হয়েছিল, তার মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর। ওই সময়ের মধ্যে যারা এলসি খুলতে পেরেছিলেন, তারাই পরে চাল আমদানি করতে পেরেছেন। চাল আমদানির সুযোগ বাড়াতে সে সময় সাময়িকভাবে বিদ্যমান শুল্ক সাড়ে ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছিল। অনেক আমদানিকারক খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়েও পরে চাল আমদানি করেননি। ফলে ১৭ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হলেও দেশে আসে ৮ লাখ টনের মতো।

বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভরা মৌসুমে চালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য খোদ সরকারের খাদ্য ব্যবস্থাপনা দায়ী। তাদের মতে, ভরা মৌসুমে কোনো অবস্থাতেই চালের দাম বাড়তে পারে না। বাজার নিয়ন্ত্রণে সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। প্রথমত, মজুদের হিসেবে ভুল দেখানো হয়। আবার দেখভালেও অনিময়। বাজারে টান পড়লে খুচরা বাজারে অভিযান চালিয়ে লোক দেখানো জরিমানা করা হয়। কারা চারের মজুদ গড়ছে সরকার জানে অথচ তাদের ধারেকাছেও যায় না। এমন পরিস্থিতিতে সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রে হয়েছিল। শুল্ক কমিয়ে ভোজ্যতেল আনার সুবিধা দেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত একদিন কেজিতে ৩৮ টাকা সয়াবিনের দাম বাড়াতে হয়েছে। এখন চাল আমদানি করবে বেসরকারি পর্যায়ে। তারা যাবতীয় খরচ মিটিয়ে লাভ ছাড়া বিক্রি করবে না। ফলে টিসিটির মাধ্যমে হোক বা অন্য কোনো চ্যানেলে হোক সরকারকে চাল আমদানি করতে হবে।

গত সাপ্তাহে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘দেশের ৬টি বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান বাজার থেকে চাল কিনে সেটা প্যাকেট করে বিক্রি করায় বাজারে প্রভাব পড়ছে। এসিআই, আকিজ, বসুন্ধরা, প্রাণ, সিটি ও স্কয়ার গ্রুপ দেশের বিভিন্ন মিল থেকে বেশি দামে চাল কিনে আরো বেশি দামে বাজারে বিক্রি করছে। অন্যদিকে স্থানীয়ভাবে অন্য ব্যবসায়ীরা হঠাৎ ধান-চাল মজুদের ব্যবসায় নেমেছেন। একই সঙ্গে সাধারণ ভোক্তাদের অনেকে চালের বাজার অস্থির দেখে কয়েক মাসের চাল একসঙ্গে কিনে রাখছেন। এভাবে চালের দাম বেড়ে যাচ্ছে। বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ ও অবৈধভাবে মজুদ ঠেকাতে গত সোমবার মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন। অতঃপর রাজধানীর কাওরান বাজার, মৌলভীবাজারসহ বেশ কিছু বাজারে চালের আড়তে পরিদর্শন এবং অভিযান পরিচালনা করেছে। দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায়ও অভিযান চালানো হচ্ছে। বড় মিল মালিকদের দিকেও নজর রাখা হচ্ছে জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, যারা একেবারেই ধান ব্যবসায়ী নন, তারাও মজুদ করছে, ইটভাটাওয়ালাও মজুদ করছে। এটাও আমরা খুঁজে পেয়েছি। এমনকি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকও চাল কিনে মজুদ করছেন। ৬ প্রতিষ্ঠান ব্যাগিং করে একই চাল যেটা ৬০ থেকে ৬৫ টাকা পড়ছে, সেটা প্যাকেটজাত করে ৮০ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি করছে। একই সঙ্গে আগাম টাকা ও প্যাকেট মিলারদের দিয়ে আসছে নওগাঁ, দিনাজপুর, বগুড়া প্রভৃতি স্থানে। আমরা সেগুলোও বন্ধ করেছি। জানতে চাইলে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বোরো ধান উৎপাদন মৌসুমে চালের বাজার অস্থির। কেউ যদি ধান-চাল মজুদ করে, তাহলে তা বাজারে ছেড়ে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পাশাপাশি সরকারের যেসব বিদ্যমান আইন আছে, এর যথাযথ প্রয়োগের সঙ্গে মজুদদারি আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। অসাধুদের ধরে শুধু অল্প পরিমাণে জরিমানা করলে হবে না, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

গতকাল বিশ্ব নিরাপদ খাদ্য দিবস ২০২২ উপলক্ষে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ‘উন্নত অর্থনীতির জন্য নিরাপদ খাদ্য’ শীর্ষক সেমিনারে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, চালের দাম স্থিতিশীল রাখার জন্য জনসচেতনতাও দরকার। আমরা বস্তায় চাল কিনি না। কিন্তু সেটা যখন পালিশ করে প্যাকেটে ভরে সেটা ১০ টাকা বেশি দিয়ে কিনি। তিনি আরো বলেন, চাল নিরাপদ করতে আমরা সেটা কতটুকু ছাঁটাই করা যাবে, কি মেশানো যাবে, কোনটা যাবে না, সে আইন করছি। খসড়া আইনটি কেবিনেটে পাস হয়ে এখন ভেটিংয়ে রয়েছে। আশা করছি আগামী অধিবেশনে সেটি পাস হবে। তখন চাল ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে।

গত কয়েকদিন রাজধানীর বাবুবাজার, মৌলভীবাজার, বাদামতলী, কাওরান বাজারের চালের পাইকারি আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। প্রতি কেজি মিনিকেট ৬৬-৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা এক মাস আগে ৬০-৬৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে। নাজিরশাইল চাল কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৭৮ থেকে ৮০ টাকা। এক মাস আগে ৭০ থেকে ৭২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি প্রতি কেজি বিআর-২৮ জাতের চাল বিক্রি হয়েছে ৫৫ থেকে ৫৭ টাকা, যা আগে ৫০ টাকা ছিল। এছাড়া মোটা চালের মধ্যে প্রতি কেজি স্বর্ণা জাতের চাল এক মাস আগে ছিল ৪৫ টাকা কেজি এখন বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকা দরে।

বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির ভবিষ্যৎ নিয়ে সাবেক খাদ্য সচিব আবদুল লতিফ মণ্ডল বলেন, ‘২০২১ সালে বাজার নিয়ন্ত্রণে সাড়ে ১৬ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু টার্গেটের ধারেকাছেও যেতে পারেনি তারা। এবারও তারা ওই পথেই হাঁটছে। এবারের অবস্থা আরো কঠিন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ মানুষকে আতঙ্কিত করেছে। ইতোমধ্যে গম রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে উৎপাদনকারী দেশগুলো। এর প্রভাব পড়েছে চালের ওপর। কোনো কারণে বেসরকারি পর্যায়ে কাক্সিক্ষত চাল না পাওয়া গেলে সরকারিভাবে চাল আনতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চাল

১১ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ