Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জনমনে হতাশা ও ক্ষোভ

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি বিভিন্ন দলের প্রতিবাদ অব্যাহত মানুষের বাজেটে চাপ সৃষ্টির শঙ্কা

মো. জাহিদুল ইসলাম : | প্রকাশের সময় : ৭ জুন, ২০২২, ১২:০৮ এএম

চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ যাবতীয় নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের আকাশ ছোঁয়া দামে দিশেহারা সল্প আয়ের মানুষেরা। সংসার চালাতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে তাদের। এরই মধ্যে নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর জেরে বিভিন্ন পণ্যের দাম আরও বেড়ে যেতে পারে। এরই ফলশ্রুতিতে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিকে সাধারণ মানুষের কাছে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষজন তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। প্রত্যেকেরই কণ্ঠে ঝড়েছে হতাশা ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করে জনস্বার্থে আগের দামে সেবা প্রদানের আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

তারা জানান, রাশিয়া-ইউক্রেন পরিস্থিতির জেরে প্রতিদিনই বাড়ছে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা, ময়দা থেকে শুরু করে সব জিনিসের বাড়তি দামের কারণে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এর সঙ্গে বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রী, বেকারি পণ্যের দামও বেড়ে গেছে। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি এই চাপ আরও বাড়াবে।
অন্যদিকে অর্থনীতিবিদরা বলেন, বৈশ্বিক কারণে বর্তমানে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এখন গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন পণ্যের দাম আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে গ্যাসের এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। তাদের বাজেটে (খরচ) কাটছাঁট করতে হবে। তারা বলেন, বর্তমানে সরকার গ্যাসের দাম না বাড়িয়ে ভর্তুকি দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারতো। যেহেতু গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে, তাই অদূর ভবিষ্যতে যেন আবার দাম বাড়াতে না হয়ে সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। সিস্টেম লস কমিয়ে আনতে হবে।
এর আগে গত রোববার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরিন কমিশনের (বিইআরসি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবু ফারুক গ্যাসের দরবৃদ্ধির ঘোষণা দেন। ঘোষণা অনুযায়ী, পাইপলাইনের গ্যাসের পাইকারি মূল্য ৯ টাকা ২০ পয়সা থেকে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ বাড়িয়ে ১১ টাকা ৯১ পয়সা করার ঘোষণা দেন। চলতি জুন মাস থেকেই তা কার্যকর হবে বলে জানানো হয়।
পাইকারিতে দাম বাড়ানোর পাশাপাশি যানবাহনে ব্যবহারের সিএনজি বাদে খুচরা পর্যায়েও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে বাসাবাড়ির দুই চুলার (ডাবল বার্নার) মাসিক বিল ৯৭৫ থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৮০ টাকা করা হয়েছে। এক চুলার মাসিক বিল ৯২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৯৯০ টাকা।
প্রিপেইড মিটারে প্রতি ইউনিটের খুচরা মূল্য ১২ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৮ টাকা। বাণিজ্যিক গ্রাহকদের (হোটেল, রেস্তোরাঁ) ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিটের দাম ২৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৬ টাকা ৬৪ পয়সা করা হয়েছে।
এছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৪ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৫ টাকা ২ পয়সা, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ১৩ টাকা ৮৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৬ টাকা, সার কারখানার জন্য ৪ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৬ টাকা করা হয়েছে।
বৃহৎ শিল্পে প্রতি ঘনমিটার গ্যাস ১১ টাকা ৯৮ পয়সা, মাঝারি শিল্পে ১১ টাকা ৭৮ পয়সা এবংক্ষুদ্র শিল্পে ১০ টাকা ৭৮ পয়সা হয়েছে। যা আগের ছিল শিল্প কারখানার জন্য ১০ টাকা ৭০ পয়সা। আর সিএনজি স্টেশনে গ্যাসের দাম আগের মতোই প্রতি ঘনমিটার ৪৩ টাকা রাখা হয়েছে।
গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা বলেন, বাজারে চাল, ডাল, তেল, মাছ, মুরগী, চিনি, আলু, ডিমসহ সবকিছুর দাম বাড়তি। সম্প্রতি সাবান, শ্যাম্পু, রুটি, বিস্কুটসহ সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাড়তি দামের কারণে এমনিতেই সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এর মধ্যে গ্যাসের জন্য বাড়তি খরচ আমাদের মতো স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’। তিনি বলেন, মাসপাঁচেক আমাদের বাসার গ্যাস মিটার সিস্টেম করে দিয়েছে। এতে গ্যাসের খরচ কিছুটা কমে এসেছিল। কিন্তু এখন প্রি-পেইড মিটারের গ্যাসের এক লাফে প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এটা কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়।
কাফরুলের বাসিন্দা জিশান আহমেদ বলেন, এতদিন দুই চুলার গ্যাসের বিল দিয়েছি ৯৭৫ টাকা। আমার হিসেবে গ্যাসের এই বিল অনেক বেশি। এখন তা বাড়িয়ে ১০৮০ টাকা করা হলো। অর্থাৎ গ্যাস বিল বাবদ মাসে আরও ১০৫ টাকা বেশি দিতে হবে। আমাদের তিনজনের সংসারে যে গ্যাস ব্যবহার তার মূল্য কিছুতেই এতো হতে পারে না। গ্যাসের চুলা না জ্বালালেও মাসে এই বিল দিতে হবে।
তিনি বলেন, গ্যাসের দাম বাড়িয়ে সরকারের উচিত চুরি বন্ধ করা। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে যে পরিমাণ গ্যাসের বিল নেওয়া হয়, প্রকৃতপক্ষে তার থেকে কম মূল্যের গ্যাস ব্যবহার হয়। কিন্তু গ্যাস চুরি বন্ধ না করে বারবার গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে ভুগতে হচ্ছে।
গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ফলে কি ধরনের প্রভাব পড়তে পারে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সরকার হয়তো ভর্তুকি কমানোর জন্য গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের বাজেটের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। এমনিতে দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে মানুষের সংখা বেড়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে নতুন করে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যেহেতু গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েই গেছে, অদুর ভবিষ্যতে যেন আবার দাম বাড়াতে না হয় সেজন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। অবৈধ যেসব সংযোগ আছে তা চিহ্নিত করে লস কমিয়ে আনার ব্যবস্তা করতে হবে।
বিইআরসির দাম বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত ‘সনাতনী ও গতানুগাতিক’ বলে মন্তব্য করেছেন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর এম শামসুল আলম। তিনি বলেন, বিইআরসি গতানুগতিক ও সনাতনী পদ্ধতি অবলম্বন করে মূল্যহার বৃদ্ধির আদেশ দিয়ে দিল। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশনের এই উপদেষ্টা বলেন, বিইআরসির মূল্যবৃদ্ধির আদেশ ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারে না। এখানে ভোক্তাদের স্বার্থ ভয়ঙ্কর রকমের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভোক্তাদের জ্বালানি অধিকার বিপন্ন হয়েছে। জ্বালানির যে নিরাপত্তা সেটাও অনিশ্চিত হচ্ছে, যদি এই অবস্থা অব্যাহত থাকে।
বিভিন্ন দলের প্রতিবাদ অব্যাহত : গ্যাসের নতুন দাম প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব। এক বিবৃতিতে তিনি উল্লেখ করেন, ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে বাসায় রান্নার খরচ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সার কারখানা ও শিল্পের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। বাসায় প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারীদের মাসে খরচ বাড়বে প্রায় ৪৩ শতাংশ। নতুন করে দাম বৃদ্ধিতে নানা সঙ্কটে বিপর্যস্ত জনজীবনকে আরও দুর্দশাগ্রস্ত করে ফেলবে।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম প্রায় ২৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। প্রিপেইড মিটার গ্রাহকের ক্ষেত্রে বাড়ানো হয়েছে ৪৩ শতাংশ। যখন দেশের জনগণ দৈনন্দিন বাজারের খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে সরকার জনগণের সঙ্গে তামাশা করছে। এ সরকার যে জনগণের সরকার নয় এটা আবারও প্রমাণ হয়েছে।
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন : গ্যাসের মূল্য শতকরা ২২.৭৮ ভাগ বৃদ্ধিকে জনসার্থ বিরোধী উল্লেখ করে এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন প্রধান আমীরে শরীয়ত আল্লামা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন গ্রাহকদের গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত না করে বারবার গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করে সম্পূর্ণ অন্যায় ও অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে নতুন করে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। জনগণের কষ্ট ও দুর্ভোগ ব্যাপকহারে বাড়বে। গতকাল সোমবার রাজধানীর কামরাংগিরচরস্থ জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়ায় ছাত্রদের প্রশিক্ষণ মূলক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
ইসলামী ঐক্যজোট : এদিকে, ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি অ্যাডভোকেট মাওলানা আব্দুর রকিব গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত অমানবিক। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে অন্যান্য পণ্যসামগ্রির দাম বেড়ে যাবে। এতে সাধারণ ক্রেতারা জুলুমের শিকার হবে। অবিলম্বে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে হবে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ : গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে দেশের অর্থনীতিতে বিরুপ প্রভাব পড়বে এবং জনসাধারণের ভোগান্তি চরমে পৌঁছবে বলে মন্তব্য করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ Ñএর মহাসচিব প্রিন্সিপাল হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ। এক বিবৃতিতে তিনি এর প্রতিবাদ জানিয়ে বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহারের দাবি জানান।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জনমনে হতাশা ও ক্ষোভ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ