Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৬০০ কোটি ডলার বিক্রি

অর্থবছরের ১১ মাস

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২ জুন, ২০২২, ১২:০০ এএম

মুদ্রবাজারে বিরাজ করছে চরম অস্থিরতা। অস্থিরতা কাটাতে ডলার বিক্রি করেই চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক রাখতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে। গত মঙ্গলবারও ১২ কোটি ৩০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে। এর ফলে রিজার্ভ কমে ৪২ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। সব মিলিয়ে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ১১ মাসে (২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২২ সালের ৩১ মে) প্রায় ৬০০ কোটি (৬ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর বিপরীতে বাজার থেকে ৫৩ হাজার কোটি টাকার (প্রতি ডলার ৮৯টাকা) বেশি তুলে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এত ডলার বাজারে ছাড়া হয়নি। এরপরও বাজারের অস্থিরতা কাটছে না। আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় এই সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এদিকে গতকাল বুধবার দিনভর কার্ব মার্কেটে ৯৫ দশমিক ৫০ থেকে ৯৬ টাকায় ডলার কেনা হয়েছে। বিক্রি হয়েছে ৯৬ দশমিক ৫০ থেকে ৯৭ টাকায়। আগেরদিন মঙ্গলবার ৯৫ দশমিক ৫০-৯৫ দশমিক ৮০ টাকায় কিনে ৯৬-৯৬ দশমিক ৩০ টাকায় বিক্রি করেছিল মানি এক্সচেঞ্জগুলো। সে হিসাবে একদিনের ব্যবধানে ডলারের দাম বেড়েছে ২০-৫০ পয়সা। মতিঝিলের দোহার মানি এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল হাদী জানিয়েছেন, বাজারে এখন ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, আমরা কিছু ডলার বিক্রি করতে পারলেও এক ডলারও কিনতে পারিনি। এমন অবস্থা চললে সামনে ডলারের দাম আরো বাড়তে পারে।

বাজারে চাহিদার তুলনায় ডলারের সরবরাহ কম। সে কারণে প্রতিদিনই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আন্তব্যাংক দরে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সামাল দিতে সবশেষ গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার মান আরেক দফা কমিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ দফায় এক ধাক্কায় টাকার মান ১ টাকা ১০ পয়সা কমিয়ে সব ব্যাংকের জন্য ডলারের একক দর ৮৯ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।

ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দরে ডলার কেনাবেচা করলেও সাধারণ মানুষের কাছে নগদ ডলার বিক্রি করছে সাড়ে ৪ টাকা থেকে ৭ টাকা বেশি দরে। খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে বিক্রি হচ্ছে আরও বেশি দামে। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক গত মঙ্গলবার ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে। জনতা ব্যাংক থেকে ১ ডলার কিনতে লেগেছে ৯৩ টাকা ৯০ পয়সা। অগ্রণী ব্যাংক বিক্রি করেছে ৯৩ টাকা ৫০ পয়সায়। বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংক থেকে ১ ডলার কিনতে লেগেছে ৯৬ টাকা। প্রাইম ব্যাংক নিয়েছে ৯৫ টাকা। খোলাবাজারে প্রতি ডলার ৯৭ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

অস্থির বাজারে ১৭ মে খোলাবাজারে ডলারের দর ১০০ টাকা ছাড়িয়ে ১০২ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। ১৮ মে ১০০ টাকার বেশি দরে কার্ব মাকেটে ডলার বিক্রি হয়। ১৯ মে অবশ্য ডলারের দর ১০০ টাকার নিচে নেমে এসে ৯৬ টাকা ২০ পয়সা থেকে ৯৬ টাকায় ৩০ পয়সায় বিক্রি হয়। এরপর থেকে কার্ব মাকেটে ডলার ৯৬ টাকা থেকে ৯৮ টাকার মধ্যেই কেনাবেচা হচ্ছে। ওই কয় দিন ইস্টার্ন ও প্রাইম ব্যাংক ৯৮ টাকা দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে।
ব্যাংকগুলোর দাবির পরিপেক্ষিতে গত রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তব্যাংক কেনাবেচার ক্ষেত্রে ডলারের দাম ৮৯ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। পাশাপাশি আমদানিকারকদের কাছে বিক্রির ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের দাম ৮৯ টাকা ১৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। ব্যাংকগুলো অবশ্য আন্তব্যাংক লেনদেনে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৯ টাকা ৮০ পয়সা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছিল। ব্যাংকগুলো গত সোম ও মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া ৮৯ টাকা দরে নিজেদের মধ্যে ডলার কেনোবেচা করেছে। আমদানিকারকদের কাছে বিক্রির ক্ষেত্রেও ৮৯ টাকা ১৫ পয়সা নির্ধারণ করা দর মেনেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, বাজারে ডলারের চাহিদা মেটাতে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের গত মঙ্গলবার পর্যন্ত অর্থাৎ অর্থবছরের ১১ মাসে মোট ৫৯৫ কোটি (৫.৯৫ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক । বিভিন্ন সময়ে আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজার দরে এই ডলার বাজারে ছাড়া হয়েছে। মঙ্গলবার যে ১২ কোটি ৩০ লাখ ডলার ছাড়া হয়েছে তা সোমবার থেকে নতুন বেঁধে দেয়া দর ৮৯ টাকা দরে বিক্রি করা হয়েছে।

করোনা মহামারির কারণে গত ২০২০-২১ অর্থবছর জুড়ে আমদানি বেশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ে উল্লম্ফন দেখা যায়। সে কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যায়। সে পরিস্থিতিতে ডলারের দর ধরে রাখতে গত অর্থবছরে বাজার থেকে রেকর্ড প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারই ধারাবাহিকতায় চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার কেনা হয়।

আগস্ট মাস থেকে দেখা যায় উল্টো চিত্র। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে আমদানি। রফতানি বাড়লেও কমতে থাকে রেমিট্যান্স। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও কমতে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়; বাড়তে থাকে দাম। বাজার স্থিতিশীল রাখতে আগস্ট থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের ৫ আগস্ট আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় বিক্রি হয়। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এই একই জায়গায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর। এরপর থেকেই বাড়তে থাকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রার দর। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, এই ১০ মাসে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার বিপরীতে ডলারের দর বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, করোনার পর দেশে বিনিয়োগের অনুকুল পরিবেশ ফিরে আসায় শিল্পের কাঁচামাল, মূলধনি যন্ত্রপাতিসহ সব ধরনের পণ্যের আমদানি বেড়ে গিয়েছিল। এছাড়া বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব পণের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণেও আমদানি খরচ বাড়ছিল। তিনি বলেন, আমদানি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সরকারও কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। আশা করছি, এখন আমদানি ধীরে ধীরে কমে আসবে। মুদ্রাবাজারও স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী এখন ডলার বিক্রি করছে। গত অর্থবছরজুড়ে বাজার স্থিতিশীল রাখতে ডলার কেনা হয়েছিল। এখন সেই একই কারণে বিক্রি করা হচ্ছে। এই কাজটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব সময়ই করে থাকে। যখন যেটা প্রয়োজন, সেটাই করা হয়।

এদিকে আমদানি বাড়ায় রিজার্ভেও টান পড়েছে। গত মঙ্গলবার দিন শেষে রিজার্ভ ছিল ৪২ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। কয়েকদিন আগেও এই রিজার্ভ ৪২ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। বাজারে ডলার ছাড়ায় তা কমে এসেছে। প্রতি মাসে ৮ বিলিয়ন ডলার আমদানি খরচ হিসেবে বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। অথচ গত বছরের আগস্টে এই রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল, যা ছিল অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ওই সময়ে প্রতি মাসে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি খরচ হিসেবে ১০ মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানোর রিজার্ভ ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুত থাকতে হয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কেন্দ্রীয় ব্যাংক

২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ