Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বিশ্বের সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা বাড়ছে

আবুল কাসেম হায়দার | প্রকাশের সময় : ১৭ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বিশ্বের সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা বাড়ছে। একই সঙ্গে এককেন্দ্রিক অর্থব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে বহুমুখী অর্থনৈতিক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে দেশের অর্থনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র ইউরোপীয় জোটের যে আধিপত্য ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে চীন, রাশিয়া, জাপান এবং ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশ ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত হচ্ছে। আমদানি-রফতানি এবং রেমিটেন্স, প্রকল্প সহায়তায় বৈদেশিক ঋণ, অনুদান, সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) এবং বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণসহ সবকিছুতেই রয়েছে এ প্রবণতা। সাম্প্রতিক সময়ে চীনের প্রেসিডেন্ট এবং বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সফরের পর তা আরও পরিষ্কার হয়েছে। অন্যদিকে গত কয়েক বছরে অর্থনীতির আকারও বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট, গত দুই বছরে বিশ্ব অর্থনীতিতে ১৪ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকারে বর্তমানে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৪তম।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্ক হলে ইতিবাচক। তবে সফরকারী দেশগুলোর সঙ্গে যেসব চুক্তি হয়েছে, তার সফল বাস্তবায়ন জরুরি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, কয়েকটি খাতে সম্পৃক্ততা বাড়ছে। বিশেষ করে চীনের প্রেসিডেন্ট বিশাল আকারের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এছাড়াও বিপুল অংকের ঋণের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এই প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়ন হয়, তা দেখার বিষয়। কারণ জাপানের প্রেসিডেন্ট এসে যে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। তার মতে, অর্থনীতিতে নেতিবাচক দিক রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে রেমিটেন্স উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশের রেমিটেন্স আহরণের দিক থেকে তৃতীয় সর্বোচ্চ দেশ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়াও রফতানি আয় এবং বিনিয়োগেও দেশটির একক অবদান রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিটেন্স ও বিনিয়োগ কমছে। বিপরীতে সাম্প্রতিক সময়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরে বাংলাদেশের সঙ্গে ৩৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয়েছে। এরমধ্যে ২০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ এবং ১৪ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম বাংলাদেশকে ৩ বিলিয়ন ডলার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এরমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের খাতে ২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ এবং শিশুদের জন্য পুষ্টি খাতে ১ বিলিয়ন ডলারের ঋণ। তবে বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক অবদান রয়েছে। কারণ বিশ্বব্যাংকের যে সংস্থা থেকে দরিদ্র দেশগুলোকে সহজে ঋণ দেয় তার নাম ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন বা আইডিএ। এ বড় প্রকল্পের ৪টি বড় দাতা দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি এবং জাপান।
এছাড়া গত বছর বাংলাদেশ সফর করেন জাপানের প্রেসিডেন্ট শিনজো আবে। এ সফরে বাংলাদেশকে ৬ বিলিয়ন ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। অন্যদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরে বাংলাদেশকে ২ বিলিয়ন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। একই সঙ্গে ভারতীয় কোম্পানি আদানি ৮ বিলিয়ন ডলার এবং রিলায়েন্স ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এছাড়াও দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে রাশিয়া। রূপপুরে এ পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে দুই ধাপে ১৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দেবে দেশটি। আরও কয়েকটি প্রকল্পে সহায়তা দিচ্ছে দেশটি।
জানা গেছে, বিশ্বের যে কোনো দেশের অর্থনীতিকে মূল্যায়নের মাপকাঠি হলো জিডিপি। দুটি পদ্ধতিতে জিডিপির আকার মূল্যায়ন করা হয়। এগুলো হল- চলতি মূল্যের ভিত্তিতে (বেইজ অন কারেন্ট প্রাইস) এবং ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে (বেইজ অন পারসেজ পাওয়ার)। সর্বশেষ তথ্য অনুসারে দেশের জিডিপি ২০৫ বিলিয়ন ডলার। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। আর অর্থনীতির যে অংশ বিদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তার আকার ১০৫ বিলিয়ন ডলার। এরমধ্যে আমদানি ৪২ বিলিয়ন ডলার, রফতানি ৩৪ বিলিয়ন, রেমিটেন্স ১৫ বিলিয়ন, এফডিআই ২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন, বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণ ৭ বিলিয়ন ডলার, গত অর্থবছরে প্রকল্প সহায়তায় বিদেশী ঋণ ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন, অনুদান দশমিক ৫৪ বিলিয়ন এবং শেয়ারবাজারের মাধ্যমে পোর্টফোলিওতে বিদেশী বিনিয়োগ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। এর বাইরে এনজিও ব্যুরো এবং বেপজার মাধ্যমে কিছুটা বিনিয়োগ এসেছে।
এদিকে বিশ্বের প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় অর্থনীতির আকারও বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট ইন্ডিকেটরস ডাটাবেইস অনুসারে বিশ্ব অর্থনীতিতে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৪তম। ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে তা ৩৩তম। প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৫ সালে চলতি বাজারমূল্যে বাংলাদেশের জিডিপির আকার ২০৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। অন্যদিকে ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে জিডিপির আকার ৫৭২ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। প্রথম অবস্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি ১৮ হাজার ১২৪ বিলিয়ন ডলার। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চীনের জিডিপি ১১ হাজার ২১১ বিলিয়ন ডলার।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়ছে। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকও বাংলাদেশে অব্যাহত সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে বাজেট সহায়তায় বিভিন্ন প্রকল্প ঋণ ও অনুদান দুটিই বাড়ছে। তিনি বলেন, আগামীতে এ সহায়তার পরিমাণ আরও বাড়বে।
যে সকল বিষয় গুরুত্ব দেয়া দরকার
১) বিদেশী বিনিয়োগ দ্রুত আমাদের দেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে আরও ভালো ভালো বিদেশী বিনিয়োগের প্রস্তাব আসবে। তবে বিদশী বিনিয়োগ শর্ত বড়ই জটিল। শর্তসমূহ অধিকাংশ ঋণদাতা দেশসমূহের পক্ষে। কিছুদিন পূর্বে প্রতিবেশী বন্ধু দেশ ভারত ২০০ কোটি টাকার শর্ত আমাদের কাবু করে ফেলেছে। এবারও চীন ৩৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের শর্তসমূহ দেখা দরকার। এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারী ও বিনিয়োগ গ্রহণকারী উভয়ের যুক্তিতর্কে নির্ভর করে বিনিয়োগে লাভের অংশ কে বেশি পাবে। দক্ষতার সঙ্গে আলোচনা না করতে পারলে এসব বিনিয়োগ থেকে সহজে লাভ আসবে না। সুদের হারও একটি বড় বিষয়। বিশ্বব্যাংক যে হারে সুদে আমাদের ঋণ দেয়, সরাসরি দেশসমূহ যারা বিনিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে আসে, তাদের সুদের হার বিশ্বব্যাংক থেকে অনেক বেশি। দক্ষতার সঙ্গে দর কষাকষি করতে না পারলে আমরা লাভবান হতে পারবো না।
২) আমাদের আমলাদের আরও বেশি দক্ষ হতে হবে। দক্ষতার জন্য প্রয়োজন অভিজ্ঞতা। আমাদের আমলাদের অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকলে বিদেশী বিনিয়োগ নিয়ে সমস্যায় পড়তে হবে। সরকারকে বিশেষ কর্মসূচি নিয়ে কতক আমলাদের দ্রুত ট্রেনিং করিয়ে আনতে হবে। এই জন্য অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি জন্য ট্রেনিংয়ের বিকল্প নেই। এই কাজটি যত দ্রুত করা যাবেÑ ততোই মঙ্গল।
৩) আমাদের দেশে যারা বেশি মেধাবী তাদের অধিকাংশই বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। দেশে উপযুক্ত কর্ম পরিবেশ, পরিশ্রমী না পাওয়ার কারণে অধিক মেধাবীগণ দেশে ফিরে আসছে না। সরকারকে এই বিষয়টি খুবই গুরুত্ব দিতে হবে।
অন্যদিকে রাজনীতিতেও মেধাবী মুখ খুব কম দেখা যাচ্ছে। মেধাবী আমলাকে পরিচালনা করতে হলে মেধাবী রাজনীতিবিদ প্রয়োজন। কম শিক্ষিত, মেধাহীন ব্যক্তিগণ রাজনীতিতে আসার কারণে মেধাবী আমলাগণ কাজ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা না থাকলে মেধাবী ছাত্রছাত্রী বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কর্ম ক্ষত্রে আসতে পারবে না। মেধা সংগ্রহের ক্ষেত্রে রাজনীতিকে বাদ দিতে হবে। দলমত নির্বিশেষে মেধাবীদের বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার নিরপেক্ষ সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে।
৪) দেশের অর্থনীতিতে বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি খুবই সুখবর। তবে এই ক্ষেত্রে দুর্নীতি মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। কয়েক দিন পূর্বে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কটি প্রতিনিধি দল ৩৯টি প্রকল্পে যে সকল অনিয়ম, দুর্নীতি পেয়েছে তা সংশোধন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু এই সকল তদন্ত প্রতিবেদনের প্রতি মন্ত্রণালয়গুলো কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না। তাই প্রকল্পগুলো বিলম্বিত হচ্ছে, ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। তাই দুর্নীতিমুক্ত বিনিয়োগ সকল শর্তের মধ্যে প্রথমে রাখা প্রয়োজন। দুর্র্নীতি, অনিয়ম করা যাবে না। যে দুর্নীতি, অনিয়ম, ঘুষ বাণিজ্য করবে তার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের নিয়ম কার্যকর থাকতে হবে। আইনের সুশাসন কায়েম করতে হবে। আইনকে এই ক্ষেত্রে একেবারে তার গতিতে চলার বা কার্যকর করার সুযোগ দিতে হবে। আইনের শাসন কায়েম না করতে পরলে বিদেশী বিনিয়োগ এসেও দেশের মানুষের কল্যাণ হবে না। দেশ উন্নত হবে না। দেশকে ২০২১ সালে মধ্যমআয়ের দেশে পরিণত করতে হলে দুর্নীতিকে এখনই ‘না’ বলতে হবে।
য় লেখক : সাবেক সহ-সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমএ, বিজেএমইএ এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ